আর ইয়্যু ম্যাড?

Spread the love

ব্ল্যাকবেরি ছাড়ার পর থেকে আমি মোবাইল ইন্টারনেট খুব সহজে ব্যবহার করিনা। কয়েকটা কারণ আছে। প্রথম আমার বাসা এবং অফিসে নেট আছে। আমাকে অনেক সময় সেখানে কাটাতে হয়। কাজে পথ-চলতি নেট দরকার নাই। দ্বিতীয়ত মোবাইল ইন্টারনেট ম্যালা টাকা। সেটাও আমাকে বাঁচাতে হয়।
তারপরও গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর পরই মনে হল এবার একটা প্যাকেজ নেওয়া যাক। প্রথমে ২ টাকার একটা নিলাম যা একটু পরই শেষ হয়ে গেল। তারপর ১৫ টাকার একটা নিলাম। তাও হলো না। শেষমেষ ৩০ টাকার আর একটা নিয়েছি। এরিস্টোক্র্যাটে খেয়ে দেয়ে যখন চলন বিলের মধ্যে তখনই যোগাযোগ হল আমার এক পুরাতন বন্ধুর সঙ্গে। প্রবাসী।
জানতে চাইলো শীত শুরু হয়েছে কী না? বললাম ঢাকার দিকে এখনো আসে নাই। তবে, উত্তরবঙ্গে ভালই শীত।
জানতে চাইলো আমি কী করছি এখন। বললাম – একটা মাইক্রোবাসে করে রাজশাহীর পথে।

“নিশ্চয়ই বাচ্চারা আর ভাবী আছে। ফ্যামিলি ট্যুর।”

বললাম – না বউ বাচ্চারা নাই। তবে ফ্যামিলি ট্যুর।

“ভাবী ছাড়া ফ্যামিলি ট্যুর!!!”
বললাম – বউ-বাচ্চা নিয়ে যে ফ্যামিলি তার বাইরেও আমার আরও তিনখান ফ্যামিলি আছে। গণিত অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান আর উদ্যোক্তা। এখন গণিত অলিম্পিয়াড ফ্যামিলির ট্যুর।

তারপর তাকে বুঝিয়ে বললাম আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড কী। তারপর জানালাম পরের পাচদিন আমি রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা আর ফরিদপুরে গণিত উৎসব করে ঢাকায় ফিরবো। প্রায় ১০০০ কিলোমিটারের জার্নি। প্রতিদিন ভোরে ওঠে মাঠে যাবো। সেখানে উৎসব শেষ করে পরের শহরে যাত্রা।
ও মোটামুটি রাস্তাঘাটের হিসাব করলো। তারপর দিনক্ষণ হিসাব করে বললো – তাইলে তো টিএ-ডিএ নিয়ে অনেক টাকা পাবি রে। এবার আসলে আমাকে খাওয়াতে হবে।

“সে আমি খাওয়াবো। তবে, এই উৎসব থেকে আমি কোন টাকা পয়সা পাবো না। আমরা কেও সেটা পাই না। গণিত অলিম্পিয়াড চলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।

 

আর ইয়্যু ম্যাড?

 

এই প্রশ্ন আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে শুনছি তাই অবাক হলাম না। প্রথম শুনেছিলাম এক মায়ের কাছে। প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডে তার ছেলেকে আনতে গিয়েছিলাম। সব শুনে উনি বলেছিলেন – পাগলামি আর কী!

পরে শুনেছি গোরাঙ্গ স্যারের কাছ থেকে। সেটা গণিত অলিম্পিয়াড শুরুর পর। যেদিন উনি প্রথম আইএমওর প্রশ্ন দেখেন সেদিন রাতেই ফোন দিয়ে বলেছিলেন – আপনি তো পাগল মুনির সাহেব। এই অংক তো আমাদের সিনিয়র স্টুডেন্টরাই পারবে না। আপনি ভাবছেন এগুলো এসএসসি-এইচএসসির ছাত্ররা করে ফেলবে। আপনি কী পাগল?

আমি বলেছি। স্যার আমাদের ছেলে-মেয়েদর দেখিয়ে দিলে ওরা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিতে পারবে।
সেও এক দশক হয়ে গেল। গত কয়েক বছরে আমাদের এই পাগলামিটা স্বত:সিদ্ধ হিসাবেই মেনে নিয়েছে আমাদের পরিচিত জনেরা। তাই আর এই প্রশ্ন করে না।

কাজে, মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে এই লেখা দেখে একটু চমকে গেলাম।

গত ১৫ বছরে আমরা তিল তিল করে একটা প্রবলেম সলভিং কালচার তৈরির চেষ্টা করছি। শুরু করেছি গণিত দিয়েই। কারণ সেটাই বিজ্ঞানের প্রাণভোমড়া। সেটি করতে গিয়ে আমরা এক আশ্চর্য জগতের সন্ধান পেয়ে গেছি।  জাফর স্যারের ভাষায় এটা হল দুই ইঞ্চি থিউরি। ড. মাহবুব মজুমদারের ভাষায়- ওরা এক একটা জিনিয়াস।

এটা হল যারা একটু বেশি জানে তাদের দিয়ে যারা একটু কম জানে তাদের শেখানো, দলবেধে পড়ার অভ্যাস তৈরি করা এবং বিষয়কে প্রবলেম সলভিং-এ টেনে নামানো। সেই কাজটা করে ফেলাতে আর একটা মজার ঘটনাও ঘটে গেল। তা হল আমাদের শিক্ষার্থীরাই গণিতের কঠিন সব বিষয়ে বই লিখতে শুরু করে দিল। এমনকি কেউ কেউ তাদের এইচএসসসি বৈতরনি পার হওয়ার আগেই বই লিখে ফেলল। আর সেটা নাম্বার থিউরি বা কম্বিনেটরিক্সের ওপর, যে বিষয়ে কীনা বাংলাতে মাত্র ১/২টা বই আছে!

আমি বুজলাম আমি একটা পাগলের খনি পেয়ে গেছি যা একটা সংক্রামক ব্যাধি।

সময় প্রকাশনীর ফরিদ আহমেদ আমাকে বেঁধে ধরে একটা বই লিখিয়ে নিলেন – আমাদের গণিত উৎসব নামে। সেই সময় পরিচয় হল ফরিদ ভাই-এর ভাগনে রনির সঙ্গে। রনি পরে নিজেই তার একটা প্রকাশনী খুলে বসে, তাম্রলিপি প্রকাশনী। একদিন এসে আমাকে বললো – স্যার আমি প্রতিবছর বিজ্ঞান আর গণিতের বই বের করতে চাই।

আমি ভাবলাম পাগল বলে কী। পরীক্ষা নেওয়া যাক!

আমার হাতের কাছে ছিল যাদব চক্রবর্তীর পাটিগণিত। বললাম – এটা যদি বের করতে পারো তাহলে তোমার বিষয় আমরা বিবেচনা করবো। এ ঢাউশ বইটি নিশ্চয়ই শ’খানেক কপিও বিক্রি হবে না। কাজে রনি সেটা প্রকাশও করবে না। আমাকেও আর জ্বালাবে না। কিন্তু আমি তখনো পাগল চিনতে শিখি নাই। কয়েকদিন পরে এসে জানালো বই-এর কাজ শেষ। আমি একটা ভূমিকা লিখে দিলে বইটা প্রকাশ হবে। দাম মাত্র ৭০০ টাকা। দামটা তো মুখ্য না। মুখ্য হল আমি আটকা পড়েছি আমার কথায়।
তারপর থেকে রনি একাই মনে হয় বাংলা ভাষায গণিতের সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ করে ফেলল। এবছর এরই মধ্যে তিনখান বই বের হয়ে গেছে। একটা লিখেছে আমাদের এইচএসসি উত্তীর্ণ আইওমও প্রতিযোগী মুতাসিম মিম। বাকী দুইটি ছোটখাটো গড়নের সদ্য প্রকৌশলী দিপ সরকার ও দুই বুয়েট ছাত্র! আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটরও তুষার চক্রবর্তীও আছে এই লাইনে!

এর মধ্যে মাহবুব মজুমদার আমার কাছে একদিন জানতে চাইলেন – আমাদের মেধাবীরা কেন এমআইটি-হার্বার্ডে পড়তে যায় না। আমি জানালাম – যায় তো। মাস্টার্স পিএইচডি করতে। মাহবুব বললেন – তা কেন হবে। ওরা তো ইচ্ছে করলে আন্ডারগ্রেডেও যেতে পারে। আমি বললাম – আপনি কি পাগল নাকি?

তো, দেখা গেল এখানেও অনেক পাগল এসে জুটে গেল। প্রথম সৌমেন আর তানভীর, তারপর নাজিয়া আর নায়েল আর এখন তো আমাদের কেও না কেও যাচ্ছে প্রতিবছর এমআইটি, হার্বার্ড, ওয়াটারলুতে!

আর এদিকে আইওমওতে আমরা আস্তে আস্তে ওপরে উঠতেও শুরু করেছি। বাংলা-আইটি নামে একটি ইয়াহু গ্রুপে ২০০৫ সালে আমার গুষ্টি উদ্ধার করা হয়েছিল যে কেন আমি আইওমওতে টিম পাঠানোর মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছি। আমি কিছু বলি নাই। কারণ আমি জানতাম আমাদের খুদে পাগলরা এই সব ছেঁদো প্রশ্নের জুৎসই উত্তর দিয়ে দেবে। দিয়েছেও তারা। ২০১৫ সালে আমাদের পাগলেরা দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ফেলেছে।

শুধু যে নতুন জেনারেশনের পাগল জুটেছে তা না। আমরা দেখলাম জাফর স্যার, কায়কোবাদ স্যারের মত পাগলেরাও এক শহর থেকে অণ্য শহরে ছুটে যাচ্ছেন। যে বিষয়টাকে সবাই অঙ্ক বলতো সেটা টিকঠাকভাবে গণিত হয়ে গেল।

আর অলিম্পিয়াড তো হয়ে গেল “সব পেয়েছি”র একটা কিছু। আমি একদিন দাওয়াত পেয়েছি “নির্বাচনী অলিম্পিয়াডের”।

অন্য পাগলরা এসে এখন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, সায়েন্স অলিম্পিয়াড শুরু করে দিয়েছে।

আমরাও প্রবলেম সলভিং-এর ব্যাপারটাকে গনিত থেকে বের করতে শুরু করলাম। প্রথমে বিজ্ঞান। শুরু হল সায়েন্স ওয়ার্ল্ড, সায়েন্স কংগ্রেস এবং সবশেষে জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড। এই তো সেদিন প্রথম বারের মত আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে বগুড়ার ফারহান একটা ব্রোঞ্জপদক জয় করে ফেলেছে! সায়েন্স-এর প্রোগ্রামগুলোর জন্য আমাদের কোন স্পন্সরও নাই। ওরা গেছে নিজ নিজ টাকায় যেখানে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছ চার হাজার কোটি টাকাও কোন টাকা নয়!

এরপর ২০১৫ তে শুরু করেছি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রোগ্রামিঙ কনটেস্ট, মেয়েদের জন্য ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং কনটেস্ট! আর এখানেও পাওয়া গেল আর এক পাগল মাহমুদুর রহমানকে। নিজের গাটের প্রায় বিরাট অংকের টাকা খরচ করে সে বানিয়ে রেখেছে কোডমার্শাল নামের একটা জাজিং প্ল্যাটফর্ম যা ব্যবহার করছে অন্যদেশের আয়োজকরাও।

এটুকু ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ি চলনবিল থেকে বের হয়ে এসেছে।

আমি দ্রুত হাতে  স্ক্রিনে টাইপ করলাম।

ইয়েস। ইনডিড। আই অ্যাম ম্যাড। উই আর ম্যাড।

এন্ড উই লাভ আওয়ার ম্যাডনেস!!!

সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।