একটি মসজিদ দেখবো বলে…

Spread the love
ছবি – উইকিপিডিয়া। ছবি তুলেছেন – ফাওজুল লতিফ চৌধুরী

২০১৬ সালে আগা খান পুরস্কারের ঘটনার আগে বাইতুর রউফ মসজিদের কথা আমি শুনি নাই যতদূর মনে পড়ে। পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হওয়ার পর সেবারের দুইটা স্থাপনা নিয়ে প্রথম আলো’র মোর্শেদ নোমান ভাই দুইটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। দুইটি স্থাপনাই পুরস্কার পেয়েছে সেবার। এর পর থেকে বাইতুর রউফ মসজিদ দেখা এবং সেখানে নামাজ পড়ার একটা আগ্রহ তৈরি হয়। যে সব ছবি আর ভিডিও দেখি সেখান থেকে কাছে থেকে দেখার একটি আগ্রহ আরও বাড়ে। কিন্তু মিলছিল না কিছুতেই। যাবো যাবো করে যাওয়াও হয়নি আর।
তবে, এর মধ্যে আমার ছেলে রুবাই জানালো তারা তাদের স্কুলে টেড বক্তৃতা আয়োজনের একটা উদ্যোগ নিয়েছে। স্বভাবতই আমার ছেলে সেটার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। নিজেরা মিটিং করে তালিকা বানায় এবং লোকজনকে দাওয়াত দিতে শুরু করে। এর মধ্যে একদিন জানায় স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম (এমটি নামেই বেশি পরিচিত) তাদের অনুস্ঠানে আসতে রাজি হয়েছেন। প্রথম আলো যেহেতু এই টকের অন্যতম স্পন্সর কাজে আমি ঠিক করে রাখি আমি সেখানে যাবো। তার আগেই হার্বার্ড ইউনিভার্সিটিতে মেরিনা তাবাসসুমের একটি বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শুনে ফেলি যদিও স্থাপত্য কলা না বিজ্ঞান এ নিয়ে আমার নিজের দ্বন্ধ এখনো কাটেনি।

রুবাইদের স্কুলের টেড বক্তৃতায় মেরিনা তাবাসসুম কথা বলেন তার এই মসজিদ নিয়ে। বিশেষ করে এর স্থাপত্য ডিজাইনের নানা দিক নিয়ে। তখন থেকে আবারও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হতেই থাকে।
করোনাকালে সময় কাটানোর জন্য একটি ভিন্ন রকম আলাপচারিতার অনুস্ঠান নিয়ে ভেবেছি। সেটারই ফসল হল টপটক নামে একটি অনুস্ঠান। এই অনুস্ঠানটির অনুপ্রেরণা আমার বস স্টিফেন হকিং। স্টিফেন হকিং-এর প্রেমে পড়ি আমি ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন থেকে আমাদের বিজ্ঞান চেতনা কেন্দ্র (জুলফিকার হাফিজ জুয়েল ভাই-এর ভাষায় বিস্কুট চেতনা কেন্দ্র) গড়ে ওঠে। হকিং খুব শাদামাটাভাবে বিজ্ঞানের লক্ষ্য ঠিক করেছেন – ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কেন? কারণ তাহলে আমরা বুঝতে পারবো দুনিয়া জুড়ে কেন পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মকানুনগুলো একই রকম।
টপটক সাজানোর সময় আমি তাই ভাবি এই আলাপচারিতায় আমরা বরং আমাদের অতিথির ‘মন’ বোঝার চেষ্টা করি। ফলে এই আলোচনায় আমরা তাঁর চিন্তার ধরণ, কাজের স্টাইল ইত্যাদি নিয়ে জানতে চাই। বুঝতে চাই কেন ১০ জনের সঙ্গে থেকেও তিনি হয়ে উঠেছেন একেবার দশম, অনন্য। কাজে এক একটা পর্বের জন্য প্রস্তুতি নিতে আমার নাভিশ্বাস উঠে যায়। এই যেমন সালমান খান ওরফে স্যালখানের সঙ্গে আলাপচারিতা। তাঁর জন্য প্রশ্ন সাজাতে আমার প্রায় শ’খানেক পৃষ্ঠা পড়তে হয়েছে। আর ইকবাল কাদিরের জন্যতো আস্ত একটা বই
সেই অনুস্ঠানের জন্য মেরিনা তাবাসসুমকে এপ্রোচ করি মাস খানেক আগে। জানতাম উনি তেমন একটা ইন্টারভিউ দিতে চান না। কিন্তু বলেছি এই আয়োজনটা যতো না ওনার জন্য তার চেয়ে বেশি আমাদের তরুণদের জন্য যাদের মধ্যে ভবিষ্যতের মেরিনা তাবাসসুম বা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মেয়েটি বা ছেলেটি রয়েছে। এমটি রাজি হওয়ার পর আমার প্রথমই মনে হল হায় হায় মসজিদই তো দেখা হয়নি এখনো।
কাজে মাস্ক-টাস্ক লাগিয়ে আমি, আমার মেয়ে বিদুষী এবং আমার প্রথম আলো’র সহকর্মী মাকসুদা আজিজ একদিন রওনা হলাম মসজিদ দেখার জন্য। মেরিনা তাবাসসুম আমাদের বাসার আইকন। নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে বিদুষী তাই রাজি হয়েছে। গৃহকত্রীও যেতে চান তবে অফিসের কারণে সময় বের করতে পারলেন না।
গুগল ম্যাপ ধরে যাওয়ার চিন্তা করলেও সেটা বাদ দিলাম। কারণ ম্যাপে আমাকে দেখানো হলো আমি যেন মাস্কট প্ল্যাজা দিয়ে বামে ঢুকে যাই। সেখানে ঘুরে ঘুরে ভেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে যেন আবদুল্লাহ পুরের দিকে আগাই!!! যাই হোক জায়গাটা আগে থেকে চিনি বলে ঐ রাস্তাতে যাইনি। তবে, ফায়েদাবাদের কাছে এসে হোঁচট খেলাম। কারণ ম্যাপে দেখানো পেট্রোল পাম্পের টিকিটি পাওয়া গেল না। কাজে শেষ মুহুর্তে মানুষের শরণাপন্ন হতে হলো।
‘লাল মসজিদ? সামনে গিয়ে বামে ঢুকে যাবেন”।
সেই লক্ষণ সেনের আমল থেকে বাঙ্গালি অতিথিপরায়ণ। কাজে আমরা মোড় ঘরে একটু এগোতেই আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে উঠলো পুরস্কার বিজয়ী মসজিদটি।

মাইক্রোবাস থেকে নেমে এগোতে এগোতে খেয়াল করলাম মসজিদের সামনে বেশ কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মূল রাস্তা থেকে যথেষ্ট ওপরে এর প্লিন্থ লেবেল। মসজিদের সামনে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাচারির মতো। সেখানে বসার জায়গা আছে এবং কয়েকজন মুরুব্বী সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তবে, আলো ফুরিয়ে আসছে দেখে দ্রুত মসজিদে ঢুকতে চাইলাম। আমাদের দেখে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন চাচা মিয়া। চাচা মিয়া এই মসজিদের দেখভাল করেন। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। আমাদের মতো অতিথিরা হরদম আসেন বলে মনে হলো। আসরের নামাজ পড়াটা প্রথম কাজ আমার আর বিদুষীর। কাজে ভিতরে ঢুকে আমি প্রথমেই খুঁজে নিলাম ওজু করার জায়গাটি। বেশ প্রশস্ত জায়গা। খেয়াল করলাম একটা ভিন্ন বিষয়। সচরাচর ওজুর স্থানে আলাদা করে বসার জায়গা থাকে না। কিন্তু এখানে দেখলাম আছে। প্রথম দফায় মনে হতে পারে বসার জায়গাগুলো পরে স্ল্যাব বসিয়ে করা হয়েছে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় সেটি নয়। এটি ডিজাইনেরই অংশ। ওজু করে মসজিদের মূল নামাজ ঘরে ঢুকলাম।
বিশাল হল রুম। প্রথমেই চোখ গেল চারদিকে। না মাঝখানে কোন পিলার নেই। জিপিএইচ ইস্পাত আর প্রথম আলো মিলে একটা কাঠামো প্রকৌশলের কম্পিটিশন করছি আমরা ইন-জিনিয়াস নামে। সেই কারণে আমার স্ট্রাকচার প্রকৌশলী বন্ধু মাহবুব মোর্শেদের সঙ্গে আমার বেশ খাতির এখন। তার কাছ থেকেই শুনেছি এরকম প্রশস্ত হল ঘরের মাঝখানে যদি পিলার না দিতে হয় তাহলে চারপাশের পিলারগুলোকে দশাসয় হতে হয়। কাজে খালি ঘর দেখেই দৃষ্টি ঘুরে আসলো চারদিকে।
চারদিকে মোট আটটি কলাম, দশাসই। বুঝলাম ওর ওপরই আছে এই ছাদটা। আমরা যখন গিয়েছি তখন পড়ন্ত বেলা তারপরও দেখলাম আলো আছে অনেকখানি। ছাদের দিকে তাকিয়ে আলো আসার কুঠরীগুলো আবিস্কার করলাম। চাচামিয়া জানালেন কুঠরিগুলোর ওপরের অংশ কাঁচ দিয়ে আবৃত ফলে আলো আসলেও পানি আসতে পারে না।
পানি আসতে না পারার কথা শুনে একটু মন খারাপ হলো। শুনেছি যে, এখানে বর্ষার সময় পানি পরে? ভালমতো খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম এর অন্য রকম সৌন্দর্য। চারদিকে চারটি অর্ধবৃত্তাকার জায়গা আছে। ওখনে দিয়েই বাদলের ধারা ঝর ঝর করে পড়তে পারে। চমকে উঠেছি। কারণ আধুনিক স্থাপত্য মানেই তো খালি বান্ধাবান্ধি। লুই আই কানের জাতীয় সংসদের বড় বড় খোলা স্পেস দেখেও দেখি না আমরা। চেষ্টা করি সবকিছুকে একটা বাক্সের মধ্যে ঢোকাতে। হয় ইট-সুরকি না হলে নিদেন পক্ষে কাঁচ দিয়ে বন্ধ করে ফেলি আজকাল। ফল হয় মারাত্মক। কারণ কাঁচের আবদ্ধ ঘর মানেই গ্রীণ হাউস। আলো-তাপ ঢুকতে পারে সহজে কিন্তু ঘরের ভিতরে কিছুটা শোষিত হয়ে পাল্টে যায় এর তরঙ্গদৈর্ঘ। ব্যাস, আটকা পরে ঘরের মধ্যে। ঘর হয়ে উঠে একটা গুদাম, গরম আর গরম। বাধ্য হয়ে কিনতে হয় এসি আর এসি।
বুজলাম এই গরমেও কেন আামাদের তেমন অসস্তি হচ্ছে না। কারণ কেবল অর্ধবৃত্তাকার জায়গা নয়, একটি চারকোনা স্পেসও ফাঁকা আছে যেখান দিয়ে বাতাস আর বৃষ্টি এক সঙ্গেই আসতে পারে। ওখানে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এই লেখার সময় মূল ডিজাইনটা দেখে বুঝলাম একটা চারকোনা জায়গার মধ্যে একটি নল ঢুকিয়ে দিলে যেমন হয় তেমনই একটি ব্যাপার এখানে আছে। বুঝলাম বৃষ্টির দিনে পানি এসে পড়ে প্রবল বেগে। কোথা দিয়ে যায়? দেখলাম সরু নালা আছে। তবে, নালাগুলো ঢেকে দেওয়া নুড়ি পাথর দিয়ে, নালা নালা ভাবটা নেই। বৃষ্টির দিনে জোহর ওয়াক্ত থেকে আছর ওয়াক্ত পর্যন্ত একদিন মসজিদে থাকার ইচ্ছেটা বেড়েই গেল।

ভেন্টিলেশনের ব্যাপারটা খুবই মনোযোগ দিয়ে সামলানো হয়েছে। তবে, মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ম্যাটেরিয়ালেও। লালমাটির ইটের মসজিদ (এ জন্য লোকে লাল মসজিদ বলে হয়তো)। দেওয়ালগুরো আস্তর করা হয়নি। ফলে, রঙ করার বাহুল্য নেই। চাচা মিয়া বললেন এ পর্যন্ত কয়েকবার পুরো মসজিদ ধোওয়া হয়েছে। ফলে ময়লা নেই। আমার মনে হলো প্রতিবছর রঙের পেছনে যে খরচ হতো সে তুলনায় ধোওয়াটা কেবল সাশ্রীয় নয়, বরং এলাকাবাসীকে মসজিদের সঙ্গে এনগেজ করার একটা চমৎকার উপায়ও বটে। চাচামিয়ার কাছে জানতে চাইলাম মেরিনা তাবাসসুমের নানা বাড়িটা কই?
আমাকে চমকে দিয়ে জানালেন – ওনার নানা কখনোই এই এলাকাতে থাকেন নি। কিন্তু এখানে কিছু জায়গা জমি ছিল।
শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল মহিয়সী নারী সুফিযা খাতুনের জন্য। এই আক্রার বাজারে ঐটুকু জমির ম্যালা দাম। আশেপাশে অনেক হাইরাইজ বিল্ডিং সেটাই বলে। কিন্তু মেরিনা তাবাসসুমের নানী, সুফিয়া খাতুন সেই পথে পা বাড়াননি। তিনি তার জমি দিয়েছেন এই অসম্ভব সুন্দর মসজিদটি তৈরি করার জন্য।
ফেরার সময় মুরুব্বীদের আড্ডার জায়গাতে একটু দাঁড়ালাম। মুরুব্বীদের কথা শুনে বোঝা যায় এলাকাবাসী কেমন করে এটি ধারণ করে।

মসজিদ দেখার ঘোর আমার এখনও কাটে নাই। আগামী ১১ আগস্ট টপটকে স্থপিত মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে আলাপচারিতার বড় একটা অংশ এই মসজিদকে ঘিরে হবে এমনটাই মনে হচ্ছে এখন।

প্রথম আলো’র বিশ বছর পূর্তির বিশেষ সংখ্যাতে মেরিনা তাবাসসুম নিজেই এই মসজিদ তৈরি ও তাঁর স্থাপত্য ভাবনার কথা লিখেছেন।  আগ্রহীরা সেটা পড়ে নিতে পারেন

এখন অপেক্ষা একটি আলাপচারিতার জন্য।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version