‘আমার বেদনা লহ বুঝি’
রবীন্দ্রনাথই কিন্তু ঐ বাড়ির একমাত্র পণ্ডিত নন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিংবা দিনেন্দ্রই বা কম কিসে। গেলবছরের অনুষ্ঠানটি ছিল জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের গান নিয়ে আর দুইদিন আগে প্রকাশিত হলো সুকান্ত অভিজিতের নতুন গানের এলবাম –দিনেন্দ্রনাথের গান। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সংকলন নিয়ে সুকান্ত চক্রবর্তী ও অভিজিৎ মজুমদার এর কন্ঠে ‘আমার বেদনা লহ বুঝি’ শিরোনামের অ্যালবামটি এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এই অ্যালবামে ওরা দিনেন্দ্রনাথের ৯টি গান গেয়েছে – পথপাশে মোর রচিনু দেউল, পলাশরাঙা বাসনাগুলি, আজি আঁধার সাগর মগন, তোমার সুতায় গেঁথে লব, বুঝেছি বুঝেছি তব বাণী, আজি এ নিশীথে জাগে একাকী, তারে কেমনে ধরিব হায়, যারে ভালবেসেছিলি এবং বলা যদি নাহি হয় শেষ।
তো, কে এই দিনেন্দ্রনাথ?
তবে, শুরুতে দিনেন্দ্রনাথের নামটি ছিল দীনেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তাকে ডাকতেন দিনু বলে এবং সেজন্য নামটি হয়ে গেল দিনেন্দ্রনাথ। ঠাকুর বাড়ির বড়ো ছেলেদের নাম “দ” দিয়েই শুরু হতো। দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, দ্বীপেন্দ্রনাথ হয়ে অনুক্রমের শেষ প্রান্তে দিনেন্দ্রেনাথ!
তো, দিনুর নিজেরই তো অনেক প্রতিভা। বটবৃক্ষের ছায়ায় নিজেকে আটকে রেখেছিলেন বলে সেভাবে জানা হতো না। সুকান্ত আমাকে জানাচ্ছেন- “কিন্তু এই দিনেন্দ্রনাথকে নিয়ে আগ্রহবশতই কাজ কররতে গিয়ে পেয়ে গেলাম দুর্লভ কিছু গান। অনেকদিন আগে থেকে মানসিকভাবেই চিন্তা করছিলাম কিভাবে এই গানগুলো মানুষের সামনে আনা যায়। বেঙ্গল ফাউণ্ডেশন সেই কাজকে বাস্তব রূপ দিল। তবে এ নিয়ে যাবতীয় সুর সংগ্রহ, উপর্যুপরি গবেষণা, চর্চা ও রীতিমত গানগুলোকে অনেকদিন চর্চার পর আমরা গলায় ধারণ করে সিডি করার পথে এগিয়েছি।”
গানগুলো কীভাবে যোগাড় হলো সে গল্পও আমি শুনলাম- “দিনেন্দ্রনাথের অদ্ভুত কিছু স্বভাব ছিল! গান লিখতেন ও সুর করতেন অসাধারণ কিন্তু, তা প্রকাশে কেন যেন ভীষণ কুণ্ঠা বোধ করতেন এই সুরশিল্পী! রবীন্দ্রনাথের মত বটবৃক্ষের মগডালে যাঁর বাস তিনি পাছে গানে কোনো খুঁত থাকে সেই দ্বিধায় কিছুই প্রকাশ করতেন না। বিভিন্নসময়ে গান লিখতেন, গাইতেন, ছিঁড়ে ফেলতেন! তাঁর মৃত্যুর পর এমন চৌদ্দটি গানের সংকলন পাওয়া যায় দিনেন্দ্র রচনাবলীতে!আমাদের খুঁজে পেতে রীতিমত বেগ পেতে হয়েছে এই বই, যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!সেই চৌদ্দটি গানের মধ্য থেকে ন’খানি গান আমরা বেছে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি!”
গানগুলো ধারণ করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ঠ বেহালা যন্ত্রশিল্পী অম্লান হালদারের সঙ্গীতায়োজনে হারমনি স্টুডিওতে হয়েছে এর রেকর্ডিং! বাদ্যে পন্ডিত বিপ্লব মণ্ডল, সেতারে সুভাষ বোস, পিয়ানোতে রানা দত্তের মত জনপ্রিয় ও গুণী শিল্পী! শব্দ ধারণ , নির্দেশনা ও মিশ্রণে ছিলেন চন্দন ঘোষ!
বাংলাগানের সামনের দিনগুলোর জন্য ইতিহাসের আশ্রয়টা বড় দরকার। নিজেদের গবেষণার কথা বলতে গিয়ে সুকান্ত জানালো – “আমাদের ইতিহাস আমাদের অনুপ্ররণা! আমাদের নতুন প্রজন্মের একটি বেশ দুর্নাম আছে যে, আমরা আমাদের অতীত জানি না, ইতিহাস জানি না! অথচ কথাটি একদম সত্য নয়! আমি তো বলব, আমরা পুরানোদের চেয়ে অনেক বেশি অতীতকে নিজেদের জানি, কেননা, প্রযুক্তির উন্নয়নের হাত ধরে আমরা এখন আমাদের পুরানো গানের যে বিশাল সম্ভার শুনতে পাই, আমাদের অগ্রজরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত! আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য প্রথমত, এমন কাজের দায়িত্বদের অগ্রজরা করছেন না , তরুণোরা করছেন সেটি সবার সামনে বাস্তবতা সহ উপস্থাপন! দ্বিতীয়ত, এই গবেষণাগুলো আমাদের সঙ্গীত ইতিহাসে এই গানগুলোর একটি সংরক্ষণ-মূল্য শুধু মূল্যবান নয়, বরং অমূল্য! আর সবার শেষে বলব, এই পুরানো গীতরচয়িতাদের গান আমাদের অনেক দিয়েছে, তাঁদের গান না গাইলে যে এই অবদানের দায়মুক্তি ঘটবে না বাঙালির– সেই কথা সবাইকে আরেকটিবার মনে করিয়ে দিতে পারলেই আমরা সার্থক!”
তবে এই শুধু দায়মুক্তির ব্যাপার নয়। আমার মতো “গানের কান নাইযাদের” তারাও কিন্তু গানগুলো শুনতে পারেন। গানগুলো অত্যন্ত শ্রুতিমধুর, গভীর! আশা করি, ভালো লাগবে সবার!
এই গানগুলো এখনই ইয়ু টিউবে পাওয়া যাবে না। তবে, সুকান্ত আর অভিজতের কিছু গান সেখানে পাওয়া যাবে।
তেমন একটা আমার বড় পছন্দের-