একটি জ্ঞানগ্রামের গল্প
বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের শ্রীফলতলা হলো সেই গ্রাম। বাগেরহাট আমাদের দক্ষিণের জেলাগুলোর একটি। সুন্দরবন যেমন এই জেলার গর্ব, তেমনি সেখানে লোনা পানির অত্যাচারও কম নয়। সুন্দরবনের প্রভাবেই কিনা কে জানে, বাগেরহাট জেলাবাসীর উদ্ভাবনী শক্তি ম্যালা। বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালুর শুরুর দিকে বাগেরহাটের এক তরুণ ইন্টারনেটসেবার এক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। সেটির নাম দেওয়া হয় বাগেরহাট অনলাইন। তরুণটি একটি সার্ভারের সঙ্গে একাধিক ডায়ালআপ ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করেন। এরপর তার দিয়ে সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করেন অন্য ব্যবহারকারীদের! সে সময়ে বাগেরহাটে দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাতো এক দিন পর।
উন্নয়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ধারণাটি একেবারেই নতুন নয়। আমাদের দেশেও এ ধারণার নানামুখী প্রয়োগ আমরা দেখছি। একটি সত্যিকারের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি এখন তাই আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। সেই তথ্যপ্রযুক্তিকে উন্নয়নের জন্য হাতিয়ার করে বেশ কয়েক বছর আগে শ্রীফলতলায় চালু হয় আমাদের গ্রাম-উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের জন্য জ্ঞানকে উপজীব্য করে একটি সমাজ কাঠামোর জন্য সংগ্রাম করা।
শ্রীফলতলা গ্রামসহ রামপাল ইউনিয়নের সব স্কুলের ডেটাবেইস আছে। স্কুলটি কবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, কে এর প্রতিষ্ঠাতা—সবই ডেটাবেইস থেকে পাওয়া যায়। আছে সেখানকার লোকদের নানা তথ্য। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এ তথ্যগুলো তাদের কাজে লাগে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ওখানে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষক-কর্মীদের সবাই স্থানীয়। সে কারণে আপনি দেখবেন, গৃহবধূ মহুয়া সামাল দিচ্ছেন জ্ঞানকেন্দ্রের হিসাব-নিকাশের কাজ।
এ রকম একটি ইউনিয়নে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকবে, সেটা বলা বাহুল্য। ইউনিয়নের স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষক, গণিতশিক্ষক ও কম্পিউটারশিক্ষকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে পেড়িখালী উচ্চবিদ্যালয়ের কম্পিউটারশিক্ষক জানান, তাঁদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার কথা। তিনি লক্ষ করেন, নবম শ্রেণী থেকে কম্পিউটার বিষয় নিয়ে অধ্যয়নে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা হয়। কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচিত হতে, ভয় কাটাতেই অনেক সময় চলে যায়। কাজেই তাঁরা ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেন। এ জন্য নিজেরাই ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সিলেবাস প্রণয়ন করেন এবং নিজেরাই এর জন্য বই লিখে ফেলেন। এখন ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই কম্পিউটারশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সারাদেশে যখন আমরা তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ছড়িয়ে দেওয়ার নানা উদ্যোগের কথা ভাবছি, তখন রামপালের জ্ঞান উদ্যোগ আমাদের সামনে বড় উদাহরণ হতে পারে।
গণিতশিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বেশি করে উঠে এসেছে পাঠ্যসূচি ও প্রশিক্ষণ উপকরণের দুর্বলতার কথা। এক শিক্ষক জানান, সরকারের টিকিউআই প্রকল্প থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের যে ম্যানুয়ালটি দেওয়া হয়েছে, সেখানেই রয়েছে গুরুতর সব ভুল। তিনি আরও জানান, প্রশিক্ষণের সময় সেই ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া হলেও প্রশিক্ষকেরা সেটি এড়িয়ে যান। একজন গণিতশিক্ষক সভায় আসার আগে পাঠ্যপুস্তকের ভুলগুলোর একটা তালিকা করে এসেছেন। তাঁদের বক্তব্য, তথ্যপ্রযুক্তির প্রথম বিষয় হলো তথ্য। সেই তথ্যই যদি নির্ভুল না হয়, তাহলে কেমন করে গড়ে উঠবে তথ্যপ্রযুক্তির সৌধ?
শিক্ষার প্রায়োগিক দিক নিয়েও তাঁরা ভেবেছেন। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ইউক্লিডীয় প্রমাণ মুখস্ত করার চেয়ে যে ওই উপপাদ্যের প্রয়োগটা বেশি জরুরি, সেটা তাঁরা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে সেই সঙ্গে তাঁরা এও বলেছেন, ইচ্ছা থাকলেও তাঁরা শিক্ষার্থীদের ভুল শেখা থেকে বিরত করতে পারেন না। কারণ বোর্ডের প্রশ্ন এবং বোর্ডের বই।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানোন্নয়নের বিষয়টিও এসেছে প্রবলভাবে। বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণগুলো আরও কার্যকরী হওয়া দরকার। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা প্রকৃত প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে স্কুলে আসে না। ফলে তাদের সামনে এগিয়ে নিতে কষ্ট হয়। গণিত শিক্ষার দুর্বলতার কারণেই শিক্ষার্থীদের অনেকে গণিতকে ভীতিকর বিষয় হিসেবে দেখছে বলে তাঁরা অভিমত দেন।
সত্যিকারের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে জ্ঞানকে মুখ্য করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। তথ্যপ্রযুক্তি এর একটি অন্যতম হাতিয়ার। শ্রীফলতলা গ্রামের এক মাদকাসক্ত তরুণ কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাদকমুক্ত হয়েছে। জ্ঞানের বিকাশই যে নানা ধরনের অন্ধকার দূর করতে পারে, এটি এর একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র।
গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনে তথ্যপ্রযুক্তি কতটা পরিবর্তন সূচিত করতে পারে, এর উদাহরণ শ্রীফলতলা—আমাদের গ্রাম। আমাদের গ্রামের অধিবাসীদের এবং আমাদের গ্রাম প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই। বিশেষ করে, এ প্রকল্পের পরিচালক রেজা সেলিম; যাঁর কারণে এখন গ্রামের চা-বিক্রেতারাও কমবেশি কম্পিউটার চালাতে পারে এবং জানে। ‘ইন্টারনেট হলো কম্পিউটারের সঙ্গে মহাকাশের সংযোগ। এর মাধ্যম ঘরে বসেই নানা ফল পাওয়া যায়। এ জন্য আর সদরে যেতে হয় না।’ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণে শ্রীফলতলার উদাহরণ অনুসরণ করে আমাদের গ্রামগুলো সত্যিকারের জ্ঞানগ্রাম হয়ে উঠুক। আশা এমনটিই।
2 Replies to “একটি জ্ঞানগ্রামের গল্প”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
A great real and sustain initiative in Bd indeed. During my university internship (http://hdl.handle.net/10361/165) and GKP Fellowship, when at first I have discussed with those computer teachers and some students in Rampal in 2004, found that students are interested on this subject and teachers were discouraging them to take this subject as most of them (computer teachers) are not prepare themselves for teaching computer according to the new syllabus. However, I had designed a ToT and share with my respected mentor (Mr. Reza Salim) and he gave me full support and encourage me a lot to implement that ToT in Rampal, I have also made a video on the participants interview of the ToT. However its really my pleasure to know about there tremendous progress on computer literacy!
Thanks a lot for this report.