আধুনিক কম্পিউটারের জনক ও তাঁর টেস্ট

Spread the love

ইন্টারনেট কানেকটেড একটা পিসির সামনে চেয়ারে বসে আছে একটি কুকুর। নিবিষ্ট মনে কী জানি করে। মনে হচ্ছে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কী জানি লিখে।
এই সময় আর একটা কুকুর দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ঔ ঘরে ঢুকলো। পিসির সামনে কুকুর দেখে তো অবাক।
“ঐ ব্যাটা কুত্তা। তুই পিসিতে কী করস?”




প্রথম কুকুরটি মুখের কাছে আঙ্গুল নিয়ে বললো-“শশশ! আমি যে কুকুর তা তো ঐ পাশে জানে না!!!”

 

১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত এই কার্টুনটির কথা আমি প্রায়শ আমার বিভিন্ন বক্তৃতায় উল্লেখ করি। এই গল্পে আছে একটা বাস্তব সত্য এবং একটি স্বপ্ন। বাস্তব সত্যটি প্রথমে উপলব্ধি করেন সিসকোর সিইও। তিনি লক্ষ করেন ইন্টারনেট সবার জন্য একটা সমতল ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। কেও একবার কানেকটেড হওয়ার পর তার গায়ের রঙ কিংবা ধর্ম নিয়ে ইন্টারনেটের কিছু যায় আসে না। তখন তিনি বলতে শুরু করলেন ইন্টারনেট হলো “এ গ্রেট ইকুয়ালাইজার”। তবে, আজকের লেখায় গল্পের এই অংশটার তেমন সম্পৃক্ততা নেই। আছে হলো স্বপ্নটার।
স্বপ্নটা হলো এমন একটা কিছু যা কিনা “অন্য পাশের মানুষকে বুঝতে দেয় না যে, অপর পাশে আসলে মানুষ নাই।”

জন্তু জানোয়ারের বেলায় এটা তো আর হবে না। একমাত্র হতে পারে কোন “বুদ্ধিমান যন্ত্র”। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি যে যন্ত্র আমাকে তার যন্ত্রত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে দেয় না, সেটিই আসলে বুদ্ধিমান যন্ত্র। আর যন্ত্রের বুদ্ধিত্ব মাপার এই টেকনিকের কথা প্রথম বলেছিলেন অ্যালান তুরিং নামের এক ব্রিটিশ গণিতবিদ। আর তা থেকে তিনি হয়ে আছেন কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার জনক।

১৬ বছর বয়সে

তুরিং-এর জন্ম লন্ডনে, ১৯১২ সালে। সে সময় তাঁর বাবা ভারতের সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা। ১৩ বছর বয়সে তুরিং-কে পাঠিয়ে দেওয়া হয় একটা বোর্ডিং স্কুলে যেখানে সবাই আবিস্কার করে তার অসাধারণ প্রতিভা। কাজেই সিলেবাসের বাইরে আপেক্ষিকতা তত্ত্বসহ নানান কিছুতেই তার আগ্রহ। বন্ধুবান্ধব বেশি না হলেও ক্রিস্টোফার নামে তার এক বন্ধু হয় এবং সে ব্যাটা একদিন পটল বাগানেও চলে যায়। এই মৃত্যুতে তুরিং-এর মনে একধরনের ছায়াপাত হয়। তার মনে হয় ক্রিস্টির মনের মৃত্যু হয় নাই এবং সেটি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। হাইস্কুলে থাকতে থাকতে তার কেমব্রিজের কিংস কলেজে ভর্তি জুটে যায়। চমৎকার মেধার জন্য ২২ বছর বয়সেই হয়ে যান ফেলো। গণিতবিদ হিসাবে তাঁর সামনে প্রচুর কাজের সুযোগও আসে।
কিন্তু তুরিং-এর মনে ছিল ভিন্ন চিন্তা। ১৯৩৬ সালে তুরিং-এর একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি দেখান মানুষ কীভাবে ধাপে ধাপে কোন একটি কাজ সম্পন্ন করে। আর এটি দেখাতে গিয়ে তিনি আমদানী করেন “ইউনিভার্সাল মেশিন” যা কিনা বিভিন্ন নির্দেশ বুজে তা পালন করতে পারে। এই নিবণ্ধটিকে বলা হয় আধুনিক কম্পিউটারের “জন্ম নিবন্ধ” এবং এই কারণেই তুরিং হলেন আধুনিক কম্পিউটারের জনক। এর দশক পরে তিনি তার এই আইডিয়াকে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরিং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত হোন। বিশেষ করে এনক্রিপ্টেড বার্তা নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেন। এই সময় একজন সতীর্থ মহিলা গণিতবিদের সঙ্গে তার খাই-খাতির হলেও সেটি কোন কিছুতে দানা বাধে নি কারণ তুরিং-এর সমকামিতা। ঐ মহিলার সঙ্গে খাতির ছুটে যাবার পর তিন আরো বেশি সমকামিতায় মগ্ন হয়ে যান।

যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে তুরিং ইলেকট্রনিক কম্পিউটিং মেশিনের বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি ও প্রকাশ করেন। এটি হলো বর্তমান ডিজিটাল কম্পিউটারের প্রথম রূপ যা মেমোরিতে প্রোগ্রাম রাখে এবং নির্দেশ বাস্তবায়ন করে। ১৯৫০ সালে প্রথম এই কম্পিউটারটি বানানো হয়।

অবশ্য তার আগেই তুরিং চলে যান ম্যানচেস্টার ভার্সিটিতে। সেখানে তিনি ভাবতে থাকেন যন্ত্র কীভাবে মানুষের তুল্য বুদ্ধিমান হবে। ১৯৫০ সালে তাঁর একটি নিবন্ধে তিনি প্রকাশ করেন বুদ্ধিমত্তা মাপার টেস্ট, লেখার শুরুর গল্পের মতো। এমন যন্ত্র যা মানুষকে বোকা বানাতে পারে যে যন্ত্রটি আসলে মানুষ! এই টেস্টকে এখন বলা হয় “তুরিং টেস্ট”।

তবে ঝামেলা পাকায় অন্যত্র। তুরিং-এর সমকামিতার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালের আগে ব্রিটেন সমকামিতা অপরাধ। সুতরাং তুরিং-কেও সাজা পেতে হয়। ১৯৫৪ সালের ৮ জুন তাকে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৩ সালে ব্রিটেনের রাজ পরিবার তাঁর “অপরাধ” ক্ষমা করে দেয়।

 

তুরিং-এর ঐ বুদ্ধিমান মেশিন এখনো আমরা বানাতে পারি নাই। তবে, ঐ পথে অনেকখানি অগ্রসর হয়েছি।
আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্ট ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন এক মেশিন আমাকে সত্যি সত্যি বোকা বানিয়ে ছেড়ে দেবে।

 

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version