বিশ্বাসঘাত ৮ : সিলিকন ভ্যালির সূচনা
These were, by their résumés, very superior people. And I thought, gee, maybe there is something here, something more valuable than just being an employee.”
– Arthur Rock, Venture Capitalist
১৯৫৭। গ্রীস্মের সকাল। সানফ্রান্সিস্কোর ক্লিফ্ট হোটেলে একে একে জড়ো হলেন আটজন বিজ্ঞানী। সবাই তুখোড় এবং আমেরিকার একটি বিশেষ ক্ষেত্রের সেরা বিজ্ঞানী। নিজেরা ছাড়া কেউ এই মিটিং-এর খবর জানে না। আটজনের সবাই মোটামুটি নার্ভাস। কারণ তারা যা করতে চান সেটি হলে তাদের প্রতিমাসের নিশ্চিত বেতনটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় তারা জানতেন এক অপার সম্ভাবনার কথা।
আটজনই তখন পলো আলটোর (??) বাইরে একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কাজটা একেবারেই নতুন। সেটি হলো সিলিকন সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির উন্নয়ন। তারা সবাই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলিয়াম শকলি’র প্রতিষ্ঠিত শকলি সেমিকন্ডাক্টরের কর্মী। শকলি বিজ্ঞানী হিসেবে ব্রিলিয়্যান্ট হলেও ম্যানেজার হিসেবে মোটেই সুবিধার নন –অস্থির, কাউকে বিশ্বাস করেন না, বদমেজাজী। এমনকি তিনি কর্মীদের ওপর গোয়েন্দার নজরদারি ও লাই-ডিটেকটরও চালু করেছেন। তুখোড় বিজ্ঞানীরা তাই বিরক্ত, হতাশ এবং সংক্ষুব্দ!
নানা রকম সম্ভাবনা বিবেচনা করে তারা ঠিক করলেন নিজেরাই একটা কোম্পানি করবেন। নেতা হিসেবে ঠিক করা হলো এমআইটি গ্র্যাজুয়েট রবার্ট নয়েসকে। চার্মিং নয়েসের বয়স মাত্র ২৯ বছর। সদ্য বিয়ে করেছে। কাজে ‘গ্যারান্টিড পে চেক’ বাদ দিয়ে আসবে কিনা এটাও ভাবতে হবে। কারণ নতুন এই কোম্পানিটার সামনে কোন মডেল নাই। পুরোটাই গড়তে হবে সম্মিলিতের জ্ঞান, বিশ্বাস, আইডিয়া ও ধৈর্য দিয়ে।
এ নিয়ে টম ওলফ তার বিখ্যাত Esquire বইতে লিখেছেন – “তারা বুঝতে পারলেন ব্যবসার জন্য প্রচলিত সম্পদ বা কারখানা, যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল বলতে যা বোঝায় সেটি এখানে নাই। তাদের দরকার শুধু বড় একটা কাজের টেবিল। যন্ত্রপাতি বলতে দরকার কিছু ক্লিনস, গগলস, অনুবীক্ষণ যন্ত্র, টুইজার এবং হীরক কাটার। কাঁচামাল হলো সিলিকন (বালি) ও জার্মেনিয়াম আসবে বালি আর কয়লা থেকে। মস্তিষ্কের শক্তিই হলো আসল ফ্র্যানচাইজ!
মিটিং-এর পর তাদের প্রথম কাজ হলো শকলি’র বিনিয়োগকারী আর্নল্ড ব্যাকম্যানকে এপ্রোচ করা। ব্যাকম্যান শকলির সঙ্গে কিছুদিন ধরে রিসার্সের খরচ বেড়ে যাওয়ার জন্য অনুযোগ করছিলেন। শকলি তাকে ধাতানি দিয়ে বলছেন –এরকম করলে শকলি তার টিম নিয়ে অন্যত্র চলে যাবেন। আটজন বেকম্যানকে জানালেন তারাই বরং শকলিকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ভাল মিটিং হওয়ার পরও বেকম্যান শকলির সঙ্গেই থাকবেন ঠিক করলেন।
সৌভাগ্যক্রমে আটেরা আরও কয়েকজনের দ্বারস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে ছিলেন ৩০ বছর বয়সী নিউ ইয়র্কের বিনিয়োগকারী আর্থার রক। রকের কাছে তারা তাদের অবস্থা লিখে চিঠি পাঠান।
তাদের চিঠিটা আর্থার রককে কৌতুহলী করে তোলে। বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও অভিজ্ঞতা দেখে রকের মাথা তো পুরাই নষ্ট। রক তাদেরকে জানায় সে তাদের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার টেকা-টুকা যোগাড় করে দিবে। তাদের সঙ্গে আর্থার বসলেন। সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কপি। ৩৫টি আমেরিকার বড় কোম্পানির একটা তালিকা করা হলো।
পরবর্তী কয়েক মাস আর্থার রক রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায়কে সম্বল করে একে একে সব কোম্পানির কাছে যান। এবং সবাই সাফল্য ও আনন্দের সঙ্গে তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ব্যর্থ আর্থার যখন একেবারে হতাশ তখন তার এক সহকর্মী তাকে সারমন ফেয়ারচাইল্ডের খোঁজ দেন। ফেয়ারচাইল্ড আইবিএমের প্রথম চেয়ারম্যানের ছেলে এবং একজন উদ্যমী, বর্ণিল উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী যে কিনা ব্যতিক্রমী ও অপ্রচলিত ধারণায় বিশ্বাস করেন। ইতোমধ্যে ফেয়ারচাইল্ড ক্যামেরা ও ইনস্ট্রুমেন্টের প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর্থারের কাছে সব শুনে তিনি সম্ভাবনাটা ঠিকই ধরতে পারেন। দেরি না করে মাত্র ১.৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে তিনি আট বিজ্ঞানীর পাশে দাড়ান।
আট বিজ্ঞানীর কাছে চুক্তি করার মতো কোন কাগজপত্র ছিল না। ১৯৫৭ সালের জুন মাসের সকালে তাই তারা একটি ১ ডলারের নোটের ওপর সবাই সই করলেন – রবার্ট নয়েস, জুলিয়াস ব্ল্যাংক, ভিক্টর গ্রিনিচ, জিন হোয়েরনি, ইউজিন ক্লেইনার, জে লাস্ট, গর্ডন মুর ওবং শেলডন রবার্ট। এভাবে তারা সবাই একত্রিত হলেন একটা নতুন কোম্পানির ছায়ায়। ঠিক করলেন প্রত্যেকে নিজেদের উজাড় করে দিবেন, নিজ নিজ কাজে।
ফেয়ারচাইল্ডের টাকা দিয়ে আট উদ্যমী প্রতিষ্ঠা করলেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর। শকলির প্রতিষ্ঠান থেকে এটি মাত্র ১২ ব্লক দূরে। “সিলিকন ভ্যালি স্টার্টআপ” শব্দ চালু হওয়ার কয়েক যুগ আগে, ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকা নতুন ও উদ্ভাবনী আইডিয়ার বৈশ্বিক রাজধানী হওয়ার অনেক আগেই তারা শুধু একটি নতুন কোম্পানিই সৃষ্টি করলেন না। বরং নতুন এক সংস্কৃতির সূচনা করে ফেললেন। আর ধীরে ধীরে সেখানে দানা বাধলো এক নতুন দুনিয়ার।
বিক্ষুব্ধ শকলি তাদের নাম দিলেন – বিশ্বাসঘাতক আট (“traitorous eight,”)।
আর্থার রক নিজের অজান্তেই মাল্টিবিলিয়ন ডলার টেক ইন্ডাস্ট্রির সূচনা করে ফেলেন। নিজেও বিনিয়োগ করেন অ্যাপলে। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস রবার্ট নয়েসকে মানতেন মেন্টর হিসেবে। অনেকেই বলেন নয়েসকে জবস নিজের “সারোগেট পিতা” হিসেবেই মানতেন!
আট+একের এই কম্বিনেশন হয় নিজেরা অথবা অন্যদের সহায়তা করে শতাধিক নতুন কোম্পানি ও প্রযুক্তির সূচনা করেন।
চেতনা ও সৃজনশীল সম্পদের এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়ে গেল তাদের হাত ধরে।
[আরও বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ আমার বিলিয়ন ডলার সিরিজের নতুন বই যা নিয়ে কাজ করছি এখন। এই বইতে দেখার চেষ্টা করছি সিলিকনভ্যালি মডেল যার আসল সূচনা একজন বাঙ্গালী বিজ্ঞানীর হাতে। কিন্তু সেটা বিকশিত হলো সাড়ে আটহাজার মাইল দূরে। এই বইতে সিলিকণ ভ্যালিসহ তার বাইরের এমনকি এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতেও আমি খুজেছি ইউনিকর্নের। শুধু প্রযুক্তি বা এআই নয়। খুঁজেছি বাচ্চাদের কিংবা মেয়েদের পোষাকে, এমআরএন-এ হয়ে ভ্যাকসিনে, পুরাতন লক্করঝক্কর জিনিষ বেচা কেনাতে। বোঝার চেষ্টা করেছি প্রত্যেকটা গল্প থেকে কী শেখার আছে। এখনও বেশ কয়েকটা কেস স্টাডি লেখার বাকি আছে। তবে, এ যাত্রা লিখে ফেলবো, ইনশা আল্লাহ। তারই অংশ বিশেষ নিয়মিত শেয়ার করবো আমার সাইটে। ]