চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার শিক্ষা

Spread the love

‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।’ কথাগুলো টম গুডউইনের। বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বোঝানোর জন্য টম গুডউইনের এই বাক্যগুচ্ছের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এমন কিছু, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অপরিচিত মোটরসাইকেলচালকের পেছনে বসে আমাদের মেয়েরা যাতায়াত করেন, কেনাকাটায় রকেট-বিকাশ এখন অনেকের সঙ্গী, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাস্তব’ নির্বাচনে সবচেয়ে প্রভাব ফেলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল ফেসবুক’! এসবই সম্ভব হচ্ছে কারণ বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগৎ একাকার হয়ে যাচ্ছে!
২০১৬ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কর্তাব্যক্তি ক্লাউস শোয়াইব প্রথম এই বিপ্লবের কথা বলতে শুরু করেন। প্রথম শিল্পবিপ্লব হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন। পানি আর বাষ্পের ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব হলো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গণ-উৎপাদন। ইলেকট্রনিকস আর তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে গেল শতকের মাঝামাঝি সময়ে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের পর শুরু তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। আর এই তৃতীয় বিপ্লবের ওপর ভর করেই এখন নতুন এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে। এই হচ্ছে প্রযুক্তির একধরনের মিথস্ক্রিয়া, যার ফলে ভৌত জগৎ, ডিজিটাল জগৎ আর জীবজগতের মধ্যে পার্থক্যটা হয়ে যাচ্ছে বায়বীয়। কয়েক শ কোটি লোকের মুঠোফোনের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকা, অকল্পনীয় প্রসেসিং আর স্টোরেজ ক্ষমতা এবং সহজে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশাধিকারের ফলে সভ্যতা যে কোথায় যাবে, তা চিন্তা করাও কঠিন বটে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবে সবকিছুতে একটা গোলমাল লেগে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, নিজে চলা গাড়ি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিমেষে হাজার হাজার লোকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে। পাঁচ কোটি লোকের কাছে রেডিওর পৌঁছাতে লেগেছে ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। অথচ ইন্টারনেটের লেগেছে ৪ বছর। আইপডের জন্য সময়টা মাত্র ৩ বছর আর ফেসবুকের? ২৪ মাস!

এই পরিবর্তন আর উন্মাদনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে এমন জনগোষ্ঠী দরকার, যারা এর উপযোগী, যাদের রয়েছে বিপ্লব মোকাবিলার শক্তি, রয়েছে সেটিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উন্নতি করার উপায়। কর্মবাজারের কথাই ধরা যায়। পিডব্লিউসি নামের চিন্তক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিকসের পাল্লায় ২০৩০ সালে বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরিই নাই হয়ে যাবে। এই ঝড় মূলত বয়ে যাবে শ্রমনির্ভর কাজের বেলায় এবং স্বভাবতই আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। অন্যদিকে নতুন ১০০ কোটি কর্মসৃজন হবে, তবে সেগুলো কেমন, তার বেশির ভাগই আমরা কল্পনা করতে পারছি না। মাত্র এক দশক আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লোককে ‘ফেসবুকে নজর রাখা’র জন্য চাকরি দেওয়া হবে!

আগামী সময়ে ঠিক কী হবে, সেটি ঠিকমতো যদি বলতে পারা না যায়, তাহলে তার জন্য নতুন প্রজন্মকে আপনি কেমন করে তৈরি করবেন? কেমন করে তাদের যুগোপযোগী দক্ষতায় শাণ দেওয়াবেন?

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বেশ কিছুদিন ধরে চলমান ও আগামীর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার একটি তালিকা করে চলেছে। গুরুত্ব অনুসারে এমন ১০টি দক্ষতা হলো জটিল সমস্যা সমাধান, তুরীয় চিন্তা, সৃজনশীলতা, জনব্যবস্থাপনা, অন্যদের সঙ্গে কাজের সমন্বয়, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সেবা প্রদানের মানসিকতা, দর-কষাকষি এবং চিন্তায় স্বচ্ছতা। বলা বাহুল্য, এগুলোর কোনোটিই কিন্তু বিষয় বা জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতাকে নাকচ করে না, বরং সেটিকে জোরদার করে। মোদ্দাকথা হলো, আগামী দিনের পেশাজীবীকে নিজ দক্ষতার পাশাপাশি সেটিকে প্রকাশযোগ্য করে তোলা, তার কাজের ফলে সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং সর্বজনীন মঙ্গলের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। এরই মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং ইন্টারনেটের বিকাশ তথ্যের প্রাপ্যতাকে সহজ করে তুলছে ক্রমাগত। দুই দশক আগেও কোনো কোনো সমস্যার সমাধানে তথ্যের প্রাপ্যতা এবং তার প্রয়োগ ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন হাতের মুঠোয় তথ্যের প্রাপ্যতা সমাধানকারীকে ‘তথ্য মুখস্থ’ রাখা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ফলে, সমাজ এখন আর তার কাছে উগান্ডার রাজধানীর নাম মুখস্থ রাখার যোগ্যতা আশা করে না বরং উগান্ডায় ‘পুকুর কাটার জ্ঞান কীভাবে আমাদের দেশের পুকুর কাটাতে কাজে লাগানো যাবে’, সে বিষয়ে ব্যুৎপত্তি আশা করে। এবং এটিও আশা করে এ জন্য যে উগান্ডায় উড়ে যাবে না।

আগামী দিনের সৃজনশীল, তুরীয় চিন্তার অধিকারী, সমস্যা সমাধানে পটু জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার উপায় হলো শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো, যাতে এ দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এবং কাজটি করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে।

সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশ কেমন করে হবে? সহজ উপায় হলো কৌতূহলকে উসকে দেওয়া, যা কিনা কেবল পঠনপাঠনে সম্ভব নয়। এমন কিছু করতে হবে, যা তাকে আনন্দের সঙ্গে, খেলার ছলে সমস্যা সমাধানে উৎসাহী করে তুলবে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা তাই হয়ে উঠছে অ্যাকটিভিটিনির্ভর। মুখস্থের পরিবর্তে বিশ্লেষণ, সূত্রের চেয়ে প্রথম নীতির প্রয়োগ এবং সর্বোপরি শ্রেণিকক্ষে দলীয় কাজের পরিমাণ বাড়ানোই একমাত্র উপায়। বর্তমানে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার মূল অংশই হলো তথ্য মুখস্থ করানোর চেষ্টা। এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষকের আসন থেকে শিক্ষকদের বরং হয়ে যেতে হবে ফ্যাসিলিটেটর। ছোটবেলা থেকে তারা যেন উপাত্তের ভিজুয়ালাইজেশনে আগ্রহী হয়, সে জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। যেমন ধরা যাক লেখচিত্রের কথা। শিক্ষার্থীকে সরাসরি লেখচিত্রের ধারণা দেওয়ার পরিবর্তে তাকে একাধিক উপাত্ত সেটকে (এক ঝুড়ি আম ও পেয়ার সংখ্যার মধ্যে তুলনা হতে পারে) প্রথমে সাংখ্যিক এবং পরে চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশে সহায়তা করতে হবে। আর তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামনে উন্মোচন করতে হবে লেখচিত্রের জগৎ!

একই ধরনের পরিবর্তন হতে হবে উচ্চশিক্ষার স্তরে। শিক্ষার্থীদের প্রচলিত প্রশ্নোত্তর থেকে বের করে এনে তাদের কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মূল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকাশযোগ্যতা, দলীয় কাজে দক্ষতা তৈরির জন্য ওই সব কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা প্রজেক্টের উপস্থাপনাকে করতে হবে বাধ্যতামূলক। এবং সেটি শুধু নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে নানা অঙ্গনে। উচ্চশিক্ষার সব স্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিশী কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতেকলমে শিখতে পারে। এ তো গেল শিক্ষা কার্যক্রমের পদ্ধতি।

ঢেলে সাজাতে হবে বিষয়ভিত্তিক উচ্চশিক্ষাকেও। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে প্রযুক্তিভিত্তিক বিষয়াবলিতে আসনসংখ্যা বাড়াতে হবে। গত অক্টোবর মাসে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, আইসিটিভিত্তিক স্নাতকদের চাকরি পাওয়ার হার অন্যান্য বিষয়ের স্নাতকদের দ্বিগুণ! কাজেই দেয়ালের লিখন পড়তে পারতে হবে। একই সঙ্গে পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল শিক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এই শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণে বিরূপ ধারণা রয়েছে। কারিগরি শিক্ষার্থীদের অনেক দিন ধরে বৃত্তি দেওয়া হয় বলে অনেকেই মনে করেন, এই শিক্ষা কেবল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। ফলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি কখনোই তাদের সন্তানদের কারিগরি শিক্ষায় পাঠাতে চায় না। এই চিত্রও আমাদের বদলাতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করে এটিকে আশঙ্কার পরিবর্তে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। তবে, সেটি গুটিকয় লোকের একটি সভার মাধ্যমে না করে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে করা প্রয়োজন।

নতুবা ২০৩০ সালে আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করব, সমাজে যাদের কোনো চাহিদাই থাকবে না।

2 Replies to “চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার শিক্ষা”

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version