আমাদের কায়কোবাদ স্যার

Spread the love

আমি বড় হয়েছি গ্রামে, চট্টগ্রামে। আন্দরকিল্লার রাজাদের পাহাড়ের পাদদেশে আমার নানার বাড়ি। রাজা মানে চাকমা রাজা, রাজাকার ত্রিদিব রায়।
আমরা থাকতাম নানীর বাড়িতে। বাড়িটি বানানো হয়েছে ১৯৫১-২ সালে। সম্ভবত ঐ গলির প্রথম দিককার কয়েকটি পাকা বাড়ির একটি। আমার নানা, পূর্ববঙ্গের প্রথম মুসলিম এমবি ডাক্তার চাইলে অনেক বাড়িগাড়ি করতে পারতেন। পারেন নাই। এই বাড়িটা আমার নানী একরকম জোর করেই বানিয়েছিলেন।
সেই বাড়িতেই ১৯৭১ সনে আমরা শিফট করেছিলাম। সেটাও একটা কাহিনী। আমার বাবা-মা আমার দাদা-দাদীর সঙ্গে কাপাশগোলাতে একটা বেড়ার বাড়িতে থাকতেন। ১৯৭০ সালে, আমাদের যখন কয়েক বছর বয়স তখন বাবা ব্যাংকিং নিয়ে কী জানি পড়ালেখা করার জন্য জার্মানীতে যান। এই সময় আমরা মাঝে মধ্যে ৩ রাজাপুকুর লেনের নানা বাড়িতে থাকতাম। বাবা জার্মানী থেকে আসার সময় একটা শাদা-কাল টেলিভিশন, একটা কেক-বেকার, একটি ফ্রিজ ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই আমরা পালিয়ে বাড়ি চলে যাই। সম্ভবত ২৮ বা ২৯ মার্চে আমরা বাড়ি গিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহে দাদা শহরে এসে একটা ঠেলাগাড়িতে করে দামী জিনিষপত্রগুলো নানার বাড়ির দোতলায় স্থানান্তর করেন। এর কয়েকদিন পরে রাজাকাররা আমাদের কাপাশগোলার বাড়িটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধের পর তাই আমরা নানার বাড়িতেই এসে উঠি। পরে সেটার দোতলাতে হয় আমাদের বাস। নানার বাড়ির পেছনে হাতি কোম্পানির বড় মাঠ। সেখানে আমরা খেলতাম। আমি অবশ্য খুবই বাজে খেলোয়াড় ছিলাম। যাকগে এটা আমার গল্প না। এটা হলো আমার আজকের লেখার একটা উপক্রমনিকা। আমার যুদ্ধ-অভিজ্ঞতার অন্য কোনদিন বলা যাবে।

আমাদের বন্ধুবান্ধবের সার্কেলটা অনেক বড়ই ছিল। এর মধ্যে আমরা কেউ কেউ কাজিন। আমাদের আড্ডার অনেকখানি থাকতো স্যারদের কথা। আমাদের কয়েকজন পড়তাম মুসলিম হাই স্কুলে, কেউ কেউ মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাই স্কুলে, আবার কেউ কলেজিয়েটে। কোন স্যার কেমন মারতেন এটাতো আলোচনায় থাকতো। আবার থাকতো সাইদুল হক স্যার , নুরুল ইসলাম স্যারদের কথা। এই স্যারদের কাছে আমরা যেমন বকা খেতাম তেমনি স্যাররা আমাদেরকে অনেক স্নেহও করতেন। কোন অঙ্ক বা প্রবলেম সলভ করতে পারলে নুরুল ইসলাম স্যার ব্রিজ হোটেলের (লালদিঘী পাড়ে, কোর্টি বিল্ডিং-এর পাশে) পরোটা খাওয়াতেন। সাইদুল হক স্যার খাওয়াতেন পাথরঘাটার মিষ্টি। স্যারের বাসা ওখানেই ছিল। ইছহাক স্যার প্রায়শ খোঁজ নিতেন পড়াশোনা কেমন হচ্ছে। স্যারের একটা আতংকের কারণ ছিলাম আমি। তিনি ভয় পেতেন যে, ৪/৫টি লেটার সহ আমি ইংরেজি ফেলের কারনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করে যাবো! (টেস্ট পরীক্ষায় আমি সাফল্যের সঙ্গে ইংরেজি প্রথম পত্রে ২৯ পেয়েছিলাম)।

তা স্কুল জীবনে এমন সব স্যারদের স্নেহাস্পদ থেকে বেড়ে ওঠার পর ঢাকায় যখন বুয়েটে পড়তে আসি তখন বুঝলাম ‘গেছে দিন ভাল’। পড়াশোনার খোঁজ নেবে এমন শিক্ষক খুজে পাওয়া মুশ্কিল হবে। কিন্তু দেখলাম ম্যাথের ইলিয়াস স্যার বা মোস্তফা কামাল স্যার, ইলেকট্রিক্যালের মুজিবুর রহমান স্যার ওনারাও স্কুলের স্যারদের মতো একই ধাতুতে গড়া।

তবে, বুয়েটে পড়ার সময় যে স্যারকে আমার ততোটা জানা হয়নি তিনি কি না এখনো আমাদের গ্রামবাংলার সে স্যারদের মতোই। যিনি নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ফোন করেন, ফোন করে পড়ার অগ্রগতি জানতে চান, কোন সাহায্য লাগলে বলেন। শিক্ষার্থীদের বই পড়তে দেওয়ার সময় তিনি সেভাবে খোঁজ রাখেন না। (এ কথাটা বললাম এজন্য যে, একবার একটি জার্নালের কপি নিতে হয়েছিল আমার একজন শিক্ষকের কাছ থেকে। তিনি একটি খাতায় আমার বংশতালিকা লিখে তারপর আমাকে ম্যাগাজিনটা দিয়েছিলেন। আমি সেটা পলাশী থেকে ফটোকপি করে তাঁকে ফেরৎ দেই। মোটমাট ঘন্টাখানেক সময় ম্যাগাজিনটা আমার হাতে ছিল)।

এই স্যার যে শুধু এটুকু করেন তা নয়। তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য। সে জন্য ওনার হয়তো মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়!!!

আমি আমার শিক্ষক কায়কোবাদ স্যারের কথা বলছি। বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। রিটায়ারমেন্টের পর তিনি এখন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিনগুইশড প্রফেসর।

স্যারের সঙ্গে আমার আলাপ আর সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে যথন আমি তাঁর কাছে জানতে চাই আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা বাড়ানোর কায়দা কী?। সে সময় আমি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারে কাজ করি। স্যার আমাকে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কথা বলেন। বলেন এরকম প্রতিযোগিতা তিনি পূর্ব ইউরোপে দেখে এসেছেন। সেখানকার ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং দক্ষতার মূলে গণিতের দক্ষতা। তিনি আমাকে জন ওয়েবের ঠিকানা দেন এবং বলেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

তাঁর কাছেই শুনি যে, ১৯৮৬ সালে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি বাংলাদেশ গণিত সমিতিকে গণিত অলিম্পিয়াড করার জন্য বলে আসছেন। তবে, পাত্তা পাচ্ছেন না। আমি জন ওয়েবকে ই-মেইল কররে জন ওয়েব আমাকে ড. কায়কোবাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন!!! গণিত অলিম্পিয়াডের পরের ইতিহাস সবার জানা। শুরুর কথাটাও লিখেছি কিছুদিন আগে।

তো, কায়কোবাদ স্যারকে আমি ক্লাশরুমের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছি এলগরিদম ক্লাশে। এই কোর্স করার আগে নিজেকে একজন ভাল মানের প্রোগ্রামার ভাবতাম! ঐ কোর্স করে বুঝছি একটা সমস্যার যেন তেন সমাধান আর তার সৌন্দর্য সমাধানের মধ্যে অনেক পার্থক্য।

স্যার দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসিএম প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা জনপ্রিয় করার চেষ্টা শুরু করলেন। তার চেষ্টায় বাংলাদেশ একটা আঞ্চলিক ভ্যেনু হল। বলা বাহুল্য বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ওয়ার্ল্ড ফাইনালের জন্য নির্বাচিত হতে শুরু করলো এবং শুরু হলো প্লেন ভাড়া যোগাড় করার কাজ। যেহেতু এটি কোন সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম না কাজে আমাদের কর্পোরেটরা যথারীতি মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। আর শুরু হলো স্যারের পকেট থেকে টাকা দেওয়া!!!

একবার বাংলাদেশ ভ্যেনুতে বাংলাদেশ জিততে পারলো না। তখন স্যার আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেলেন কানপুরে। সেখান থেকে ওয়ার্ল্ড ফাইনালের টিকেট পাওয়া গেল। কেবল টিকেটের টাকা নয়, সঙ্গে যাওয়া থেকে শুরু করে আবীরকে জুতা দেওয়ার কাজটাও স্যার করেন। আনন্দের সঙ্গে করেন। কারণ, শিক্ষার্থীর সাফল্যে শিক্ষকের আনন্দ। তিনি সেটা পেতেই ভালবাসেন।

আমাদের দেশে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলে মৌলিক গবেষণা তেমন একটা হয় না। কায়কোবাদ স্যার তার ব্যতিক্রম। তার হাত ধরে সুমন, সৈকতের একাধিক প্রকাশনা হয়ে যায় তাদের গ্র্যাজুয়েশনের আগেই। প্রথম দিন ক্লাসে তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের প্রকাশনার কথা বলেন, রিসার্চের কথা বলেন। স্যারের সঙ্গে কাজ করেছে এমন সৌভাগ্যবানদের মধ্যে মনে হয় আমিই একমাত্র হতভাগা যার কোন পেপার কোন জার্নালে প্রকাশিত হয়নি।

kokoএবার যখন শরিয়তপুর আর রাজবাড়িতে স্যারের সঙ্গে গেলাম তখন স্যার আলাপ করছিলাম কীভাবে জিপিএ ৫ এর সংস্কৃতি আমাদের ভাল শিক্ষার্থীদের মাঝারি থেকে নিচে নামিয়ে আনছে। স্যারের কাছ থেকেই জানলাম আগে যখন স্যার বুয়েটের শাদা কোয়ার্টারে তিনতলায় থাকতেন তখন তিনি প্রায়শ বিকেলে খেলতে আসা ছেলে-মেয়েদর বিভিন্ন গাণিতিক কিংবা যৌক্তিক সমস্যা দিতেন। ওরা সেগুলো চেস্টা করে কয়েকবার করে সিড়ি দিয়ে উঠতো, ঐ দিন না পারলে পরের সপ্তাহে পারতো। এখন স্যার লাল বিল্ডিং-এ থাকেন। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের সমস্যা দিলে তারা তো চেষ্টা করেই না বরং সমাধানটা বলে দেবার জন্য অনুরোধ করে! (স্যারের দেওয়া সমস্যাগুলোর নমুনা আমার এবারের ডায়রীতে দেখা যাবে)

এখন আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণার যে একটো ছো্ট্ট সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সেটার পেছনে স্যারের অবদান কম নয়। বরং অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। স্যারের কারনে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইসিসিআইটি কনফারেন্স! আমাদের আর একজন বরেণ্য শিক্ষক ড. আতাউল করিম এই কনফারেন্সের একাডেমিক চেয়ারের দায়িত্ব পালন করেন।

স্যার সবসময় সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করেন। শিক্ষার্থীকে সম্মান জানানোর এটি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি। (আমার মনে আছে চট্টগ্রাম কলেজে জয়নাব ম্যাডামও এই সংস্কৃতির ধারক ছিলেন)। স্যারের মতো শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন এমন শিক্ষক আমাদের অনেক দরকার। স্যারের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। এখনো শিখছি।

স্যার, আপনি দীর্ঘায়ু হোন। আপনার ছায়ায় আমাদের বেড়ে ওঠা সার্থক হোক, আলোকিত হোক।

আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।