স্টিফেন হকিং কি নোবেল পুরস্কার পাবেন?

Spread the love

Stephen Hawkingস্টিফেন হকিং-এর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে। তখন আমি বুয়েটে পড়ি। আমাদের একটা স্টাডি সার্কেল আছে, মালিবাগ রেলগেটের পাশে, সিজারদের বাসায়। প্রতি শুক্রবার দুপুরের পর আমরা রাওনা দেই নিজ নিজ ভিটে (হল/বাসা) থেকে। আমরা মানে আমি, দেশের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপ নির্মাতা সিরাজুল হোসেন, কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ড. কোভুর স্বপন বিশ্বাস, সূর্য দীঘল বাড়ির পরিচালক ও স্থপতি মশিউদ্দিন শাকের. তার ভাগ্নে রাহাত, দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাতার সম্পাদক ফরহাদ মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলফিকার হাফিজ (এখন ঢাবি আইআইটির অধ্যাপক), সিজারের ভাই শাহীন প্রমূখ। আরও কয়েকজন আসতেন। আমি প্রথমে হেটে হেটে এলিফেন্ট রোডে স্বপন দা’র বাসায় যেতাম।তারপর মালিবাগ রেলগেট।
আমরা প্রতি শুক্রবার সেখানে বিজ্ঞান চর্চা করতাম। মানে, বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা কিংবা কখনো কখনো দলবেধে একটা লেখা পড়তাম। শুরু করেছিলাম কয়েকবছর আগে আর প্রথম লেখাটা ছিল বস্তু জগতের স্বরূপ। এটি ছাপা হয় দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায়। দেশ পত্রিকা প্রতিবছর একটা সাহিত্য সংখ্যা বের করতো। তারই একটি হয়েছিল আগাগোড়া বিজ্ঞান নিয়ে। সেখানেই পার্থ ঘোষের এই ধ্রুপদী লেখাটা ছাপা হয়েছিল। বলা যায়, এই লেখাটা পড়ে আমার প্রথম পদার্থবিজ্ঞান পড়ার শখ হয়েছিল।
আমরা প্রতিদিন লেখাটা থেকে পড়তাম এবং সাপ্লিমেন্টারি বিষয়গুলো আলোচনা করতাম। সে সময় দলে ফিজিক্স বোঝে এমন লোক বলতে কেবল সিজারই। কাজে তাকেই বেশিরভাগ সময় ব্যাখ্যা করার কাজটা করতে হতো। তবে, অচিরে আমরা বুঝলাম এই লেখাটা ভালমতো বুঝতে হলে আমাদের আরো অনেক কিছু পড়তে হবে। সেটাও আমরা শুরু করলাম। আমাদের আলোচনার বড় অংশ জুড়ে থাকতো আসলে দ্রস্টা নিরপেক্ষ প্রকৃতি আছে কী নেই তার ওপর।

মানে আমরা কী নিউটনের জগতের মানুষ নাকি কোয়ান্টাম জগতের। কোয়ান্টাম জগতে আসলে বস্তুর স্বরুপ বদলে যায় দর্শকের কারণে। যেমন ধরা যাক কোন বস্তুর কোয়ান্টাম দশা যদি জানতে হয় তাহলে তার ওপর আলো ফেলতে হয়। আর আলোর কণা কিন্ত বস্তুটিকে সরিয়ে দেয়। ফলে আমি আলোর কণা দিয়ে যে অবস্থান আর ভরবেগ মাপার চেষ্টা করি সেটি তো ঠিক থাকে না। তো, এই প্রপঞ্চকে যদি আরো এগিয়ে নিয়ে যাই তাহলে কি আমরা বলতে পারবো “আমি না দেখলে আকাশে চাঁদ থাকে না!”। দর্শকই কী তাহলে জগতের নিয়ামক?

এ যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

আমি চোখ মেললুম আকাশে,

জ্বলে উঠল আলো

পুবে পশ্চিমে।

গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,

সুন্দর হল সে।

তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,

এ কবির বাণী নয়।

আমি বলব, এ সত্য,

তাই এ কাব্য।

কিংবা শ্রোয়েডিঞ্জারের বেড়ালটা কী মরে গেছে না বেঁচে আছে। সে সময় আমরা যখন একত্রিত হতাম আমরা প্রথমেই জানতে চাইতাম বেড়ালের আজকের খবর কী?

briefতো, সে সময়ে একদিন সিজারের বাসায় আমি প্রথম হকিং-কে দেখি। মানে হকিং-এর বিখ্যাত সাড়া জাগানো বই – এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম। আমরা বুঝে গেলাম এই বইটাও আমাদের পড়তে হবে। তো, সিজারই প্রথম সেটি পড়তে শুরু করলো এবং আমাদের মূল আলোচনায় সেটি যুক্ত হতে থাকলো।
প্রথমদিন বইটা দেখার পড়দিন শনিবারেই আমি হাজির হলাম ঢাকা নিউমার্টের জিনাত বুক স্টলে। ততোদিনে মালিক আমাকে চেনে। দেখলাম আছে। তবে, দাম দেখে ভড়কে গেলাম। রুমে ফিরে হিসাব করলাম – যদি মাসখানেক সকাল ১০.৩০ এর নাস্তা স্কিপ করি আর রাত ১১টায় পরোটা-ডিমভাজি খাওয়া বাদ দেই তাহলে বইটা কিনতে পারবো। যে ভাবা সে কাজ। পরের মাসে বাবার পাঠানো টাকা পেয়ে প্রথমেই বইটা কিনে ফেললাম এবং তারপর টের পেলাম দুপুরে-রাতে না খাওয়ার কস্ট ঐ বই পড়ার আনন্দের তুলনায় নেহায়েতই তুচ্ছ!
তো, তারপর থেকে আমি হকিং-এ পড়ে থাকলাম দীর্ঘদিন। দেশের প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় আমি হকিং-কে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। প্রথম লেখাটা লিখি সংবাদে। ঐ লেখার বাম কোণায় আবদুল্লাহ আল-মুতী স্যার লিখলেন – “লেখাটা ভাল হয়েছে –আমশ”।

পড়তে দিলাম আনিস ভাইকে (আনিসুল হক, এখন কিশোর আলোর সম্পাদক)। পরে যখন তিনি ভোরের কাগজের মেলা সম্পাদনা শুরু করলেন তখন আমাকে বললেন – মেলার এক পাতা হকিং-কে নিয়ে করার জন্য । আমাকে আর পায় কে? তখনতো ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি। কাজে আমি বাজারে গিয়ে হকিং আর তাঁকে নিয়ে লেখা সব বই কিনে নিয়ে আসলাম আর জানতে শুরু করলাম আশ্চর্য সব উপাখ্যান।
পরে আমি নিজেই ভোরের কাগজে একুশ শতক নামে একটা বিজ্ঞান পাতার দায়িত্ব পেলাম। কাজে হকিং-কে নিয়ে আমার লেখালেখি থেকেই গেল।

তো, হকিং-কে নিয়ে আমার পড়াশোনার একটা পর্যায় থেকে আমার মনে হতো আচ্ছা উনি কি নোবেল পুরস্কার পাবেন না?
একটা ঝামেলা তো নোবেল লাগায় গেছে। শোনা যায় নোবেল যে মেয়েটিকে বিয়ে করবেন ঠিক করেছিলেন সেটি তাঁর ডিনামাইটের অত্যাচারে তাকে ত্যাগ করেছিল। যদিও সে ত্যাগের পেছনে এক তরুণ গণিতবিদ যে কীনা রাতের বেলায় আকাশের তারা দেখতো তার ইন্ধন ছিল। নোবেল এতে খুব দু:খ পেয়েছেন। আমাকে বলতেন তিনি এটার শোধ নেবেনই নেবেন। সেটাই তিনি করেন তার উইলে। পরিস্কার করে লিখে দেন – ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত না হলে বিজ্ঞানের কোন আবিস্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া যাবে না আর তার লিস্ট থেকে “গণিত”কে বাদই দিয়ে দেন!

কাজে আমি যতোই হকিং-এর সম্পর্কে জানি ততোই বুঝি যে কাজটা কেমন কঠিন। এটা যে আমি বুজতে পারি তা না এটা বরং বিশ্বের তাবৎ সাংবাদিকরাও বুজতে পারেন। কোন কোন সময় আসে যখন কোন পুরস্কারের নিজেরই সম্মানিত হওয়ার ব্যাপার ঘটে।
নোবেল পুরস্কার প্রথম বিপাকে পড়েছিল আইনস্টাইনকে নিয়ে। কারণ আপেক্ষিকতা তত্ব তো আর ল্যাবরেটিরিতে প্রমাণ করা যায় না। যদিও আইনস্টাইন একটা সহজ সূত্র দিয়েছিলেন এটি প্রমাণের – যদি তুমি চুলার পাশে বসে থাকো তাহলে ২০ মিনিটকে মনে হবে ১ ঘন্টা আর যদি কোন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে গল্প করো তাহলে ১ ঘন্টাকে মনে হবে ৫ মিনিট!
তো এরকম প্রমাণে বিজ্ঞানের তো কিছুই যায় আসে না। কাজে দিন যায়, আইনস্টাইন আর নোবেল পান না। এরই মধ্যে আপেক্ষিকতার বিশেষতত্ত্ব সাধারণ তত্ব হয়ে গেছে, মিলে গেছে বুধ গ্রহের অপসুর-অনুসুরের হিসাব। স্যার আর্থার এডিংটন ব্রাজিলে গিয়ে সূর্যগ্রহণের আলোর বেঁকে যাওয়াও দেখে ফেলেছেন। আর তো অপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর নাম যখন ওঠে তখনই নোবেল কমিটি নোবেলের উইল পড়ে আর দীর্ধশ্বাস ছাড়ে। সেই সময হঠাৎ করে একজন তাদেরকে বলেন – আরে আইনস্টাইনের জন্য আকাশে খোঁজাখুজির দরকার কী উনিতো আলোর তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন যা দিয়ে এখন কাজকর্মও শুরু হয়ে গেছে। তাতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো নোবেল কমিটি। ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে “তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান এবং বিশেষ করে আলোর তড়িৎক্রিয়ার সূত্র আবিস্কারের জন্য” (“for his services to Theoretical Physics, and especially for his discovery of the law of the photoelectric effect”. )।

তো, এই আইনস্টাইনের জগতেরই মানুষ হকিং। কেমব্রিজে যদি কখনো তাঁর রুমে যান দেখবেন রুমে অন্তত তিনটি আইনস্টাইনের পোস্টার আছে। আর আপনি যদি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের লোক হোন তাহলে গ্রীণবোর্ডটাতে আইনস্টাইনের অনেক হিসাব নিকাশ দেখবেন।

তো, হকিং-কে নিয়েও এমন মধুর সমস্যায় পড়েছে নোবেল কমিটি। বলা যায় ব্যাপকভাবে তাঁর কাজগুলোকে দেখা যাচ্ছে যদি “চিপা-চাপায়” কোন ল্যাবেরেটরির উপাদান পাওয়া যায়!!!
আচ্ছা, লার্জ হেড্রন কলাইডারে কী সিংগুলারিটি তৈরি করা যাবে? ল্যাবরেটিরিতে কী ব্ল্যাকহোল তৈরি করা যাবে?
ভাবছেন প্রথমটার চেয়ে বরং দ্বিতীয়টা অনেক বেশি সহজ! আসলে তা না। যদি একটা ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়ে যায় তাহলে সেটি তার আশেপাশের সবকিছুকে খেয়ে ফেলবে আর আমরাই নাই হয়ে যাবো। তখন নোবেল কমিটিই বা কই থাকবে আর পুরস্কারেরই বা কী হবে?
তাহলে কী স্টিফেন হকিং কখনো নোবেল পুরস্কার পাবেন না?
আমাদের কালের এই মহানায়ককে আমরা কী জগতের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারটা দিতে পারবো না?

দীর্ধদিন পরে, আবারও স্টিফেন হকিং-কে নিয়ে লিখেছি নতুন বিজ্ঞান ম্যগাজিন বিজ্ঞান চিন্তায়

sw2
হকিং নোবেল পুরস্কার পাবেন কি পাবেন না তার একটা চুলচেরা বিশ্লেষন করেছি সেখানে।
জানতে হলে, বিজ্ঞানচিন্তা পড়তে হবে।
আর পড়তে হলে বিজ্ঞানচিন্তা কিনতে হবে। এটির দাম মাত্র ৫০ টাকা। একটি বড় বার্গারের দামের ১০ ভাগের এক ভাগ আর একটা মেক্সিকান পিজার দামের ১৪ ভাগের এক ভাগ মাত্র!

শুভ সকাল।
জয় বাংলা

Leave a Reply