জাহিদ হাসান : অধরা কণার বিজ্ঞানী
জন্মদিনের পাওয়া উপহারগুলো খুলে খুলে দেখছিল ছোট্ট জাহিদ। একটা ছোট্ট কাঁটা ওর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। কাটাকে যে ভাবেই ঘুরিয়ে দেওয়া হোক না কেন, সেটা সব সময় উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে!!! এরই মধ্যে জাহিদ জেনেছে এটাকে কম্পাস বলে। কিন্তু বুঝতে পারছে না কোন শক্তি এটাকে এভাবে একমুখো করে রেখেছে। খুলে দেখার জন্য জাহিদ কম্পাসের কাটাটিকে দুই টুকরো করে ফেললো এবং অবাক হয়ে দেখলো দুটো টুকরোই কিন্ত অখন্ডটার মতো উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে!!!
কেমন করে এর রহস্য ভেদ করা যায়?
ছোট্ট জাহিদ জেনে গেল বিজ্ঞানই হলো এই রহস্যভেদের মূল মন্ত্র। তখন থেকেই বিজ্ঞানের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃস্ঠে বেধে ফেলে জাহিদ। কিছুটা এগিয়ে বুঝতে পারে কেবল পাঠ্যপুস্তকে তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নেই। শুরু হল বিজ্ঞানের বই সংগ্রহ আর পড়া। সেই যে বিজ্ঞানের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ সৃষ্টি হল জাহিদের মনে সেটিই তাঁকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিত্য-নতুন সৃষ্টির অণ্বেষনে। যে রহস্যময় ও অদৃশ্য শক্তি কম্পাসের কাঁটাকে উত্তর-দক্ষিণ করে রাখে সেরকম নানান শক্তিই কিন্তু এই জগতের খেলার নিয়মগুলো মেনে চলছে। সেই শক্তিকে জানার, বোঝার এবং তার নানান বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই জাহিদ হাসানের এখনকার কার্যক্রম।
কয়েক বছর পর আইনজীবী বাবা রহমত আলী এক ঈদে জাহিদ আর তার দুই ভাই-বোনকে ৫০০ টাকা করে দিলেন, নিজেদের ইচ্ছে মত কিছু কেনাকাটা করার জন্য। সময়টা প্রায় ৩০ বছর আগের। কাজে ৫০০ টাকা কিন্তু অনেক টাকা। টাকা নিয়েই জাহিদের ভাই-বোন দৌড়ালো মার্কেটে, কাপড়-চোপড়ের জন্য। কিন্তু জাহিদ অপেক্ষা করলো তার গৃহ-শিক্ষকের জন্য।
সন্ধ্যাবেলা ঢাকার ২৯ সেন্ট্রাল রোডের ঐ বাসাতে হাজির হলেন জাহিদের গৃহ-শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান। জাহিদের জন্য বিজ্ঞানের বই খুঁজে এনে দেওয়া মাহমুদ সাহেবের আর একটা কাজ। জাহিদ বাবার দেওয়া ৫০০ টাকা মাহমুদ সাহেবের হাতে দিয়ে বসে পড়লো বিজ্ঞানের বই-এর তালিকা করতে!!! এই তালিকার অনেকটা জুড়ে ছিল আবদুল্লাহ আল-মুতীর লেখা বিজ্ঞানের নানান বই।
বিজ্ঞানের জগতের আকর্ষনে এক সময় জাহিদের মনে হয় আইনস্টাইন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন সেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে সে। শেষ পর্যন্ত সেখানে পড়তে না পারলেও এখন সেখানেই পড়াচ্ছে জাহিদ হাসান। আইনস্টাইনের মত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমাদের জাহিদ হাসান। মাত্র কদিন আগে তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী খুঁজে পেয়েছে ভাইল ফার্মিয়ন নামের কণা। সেই ১৯২৯ সাল থেকেই যে কণার সন্ধান করে বেড়াচ্ছে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা।
স্টিভেন ভাইনবার্গের সাহচর্য
২৯ সেন্ট্রাল রোড থেকে ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল বেশি দূরের রাস্তা নয়। সেই স্কুলেই জাহিদের পড়াশোনা। স্কুলের বন্ধুদের কাছে জাহিদ তাপস নামেই পরিচিত। আর শিক্ষকরা জানে “এই ছেলেটি এসএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান পাবে।” যে কোন গাণিতিক সমস্যা নানান পদ্ধতিতে করতে পারতো সে। বিজ্ঞানের কঠিন সব বিষয়ও সহজে বোঝার ক্ষমতা ছিল। কাজে ১৯৮৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মাত্র ২ নম্বর কম পেয়ে যখন ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় সে দ্বিতীয় স্থান পেল, তখন তার বন্ধুরা সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারা নেমে আসলো রাস্তায়! তাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশে জাহিদের চেয়ে ভাল কোন শিক্ষার্থী নেই। বন্ধুদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতেই যেন ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কেবল ঢাকা বোর্ড নয়, সব বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে জাহিদ হল প্রথম। এই সময় যে কেবল পড়েছে তাই নয়। জাহিদ নিজেই লিখে ফেলেছে বিজ্ঞানের বই—এসো ধূমকেতুর রাজ্যে।
ততোদিন আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা বেড়েছে অনেকখানি। কিন্তু জায়গা হলো না প্রিন্সটনে। জাহিদ বললো—‘আমি আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না।’ কিন্তু সুযোগ পেল বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিতে জাহিদ ভর্তি হলেন অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্টিভেন ভাইনবার্গের কারণে শুরুর দিকে দুনিয়ার জন্ম-মৃত্যুর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করে জাহিদ। তবে, বিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গ জাহিদকে ব্যবহারিক পদার্থ বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলেন। তাঁর কাছ থেকেই জাহিদ জানতে পারে – তত্ত্বীয় জগতে নতুন কিছুর সন্ধান যেমন আনন্দের, তেমনি বাস্তব জগতে সেই “নতুন”কে খুঁজে পাওয়ার আনন্দও কম নয়। আইনস্টাইনের আলোর তড়িৎ ক্রিয়ায় ব্যবহৃত পদ্ধতি ব্যবহার করে নতুন এক জগতের সন্ধান পান জাহিদ। ভাইনবার্গের সঙ্গে কাজ করে জাহিদ পাড়ি জমায় স্ট্যানফোর্ডে। সেখানেই তার মাস্টার্স আর পিএইচডি। পিএইচডি করার সময় জাহিদ বের করেন কঠিন বস্তুর মধ্যে ইলেক্ট্রনের চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা বের করার একটি কৌশল। আর এভাবে জাহিদ ক্রমাগত দক্ষ হয়ে ওঠেন। এই সময়টাতে, মানে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাহিদ স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার একসিলারেটর সেন্টার (SLAC) তে গবেষণা সহযোগী হিসাবে কাজ করেন। এই সময় ডাক পেতেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কাজ নম্পর্কে বলার।
স্বপ্নের আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ে
‘আমি একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছি প্রিন্সটনে। বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আমার তখন, এমন কী, কোন জীবন বৃত্তান্তও তৈরি ছিল না। পিএইচডিও শেষ হয়নি।’ আরাধ্য স্বপ্ন ধরা দেওয়ার কথা আমাকে বলেছেন এভাবে। না বলার অবস্থা ছিল না। কেবল পিএইচডি শেষ করার বাকী ছিল।
বিজ্ঞানী মহামতি আইনস্টাইন, নীলস বোর, ওপেন হাইমারের স্মৃতিবিজড়িত প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ২০০২ সালে জাহিদ যোগ দেন আর এইচ ডিকে ফেলো হিসাবে। এটি একটি স্বতন্ত্র ফেলোশীপ। পরে সেখানকার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। ২০১১ সালেই জাহিদ বিভাগের পূর্ণাঙ্গ প্রফেসর হয়ে যায়।
ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানই জাহিদের কাজের ক্ষেত্র। এরই মধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছে। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই কোনো না কোনো পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
এরই মধ্যে জাহিদ হয়ে উঠেছন এই জগতের একেবারেই সামনের কাতারের বিজ্ঞানী। তার প্রকাশিত শতাধিক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের দুই তৃতীয়াংশই ছাপা হয়েছে ‘নেচার’, ‘ফিজিক্স টুডে’, ‘সায়েন্স’, ফিজিক্যাল রিভিউর মতো বনেদি, অভিজাত ও বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকীতে।
টপোলজিক্যাল ভ্যালি
কম্পিউটার, স্মার্টফোনসহ সকল ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর প্রাণভোমরা ছয় দশক আগে উদ্ভাবিত ট্রানজিস্টর। কিন্তু এরই মধ্যে ট্রানজিস্টর তার কর্মদক্ষতার প্রায় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীরা খুঁজছেন নতুন কোনো বস্তু কিংবা বস্তুর নতুন কোনো অবস্থা যা দ্রুতগতির কম্পিউটিং-এর সহায়ক হবে এবং পাশাপাশি তাতে শক্তির ক্ষয়ও হবে কম।
ঠিক এমনই ‘একটা কিছু’ খুঁজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি ও সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের অধ্যাপক জাহিদ হাসান। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত নতুন এই বস্তু-দশার (state of the matter) নাম দেওয়া হয়েছে ‘টপলোজিক্যাল ইনসুলেটর’ বা ‘স্থানিক অন্তরক’। বস্তুর ভিতরে ঋনাত্বক বিদ্যুৎবাহী ইলেকট্রন কনার চলাচলের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা বস্তুকে কয়েকভাগে ভাগ করেন। যার মধ্যে ইলেকট্রন সহজে চলাচল করতে পারে (পরিবাহী, যেমন তামা), যার মধ্যে পারে না (অন্তরক, যেমন কাঠ) এবং এই দুইয়ের মাঝামাঝি (অর্ধ-পরিবাহী, যেমন সিলিকন)। অর্ধপরিবাহীর ভিতরে ঋণাত্মক ইলেকট্রনের পাশাপাশি ধনাত্মক চার্জেরও ছোটাছুটি থাকায় এটি হয়ে ওঠেছে ইলেকট্রনিক্সের মূল উপকরণ। অর্ধপরিবাহী সিলিকনের কারণে আমেরিকার ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের এলাকাটি সিলিকন উপত্যকা নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে অতিপরিবাহী বা সুপার কন্ডাক্টর। অতিপরিবাহীয় ভেতর দিয়ে ইলেক্ট্রন কোন শক্তি খরচ ছাড়াই চলাচল করতে পারে কিন্তু বাস্তব তাপমাত্রায় এখনো কোন অতিপরিবাহী পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে জাহিদ হাসান বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ তথা বিসমাথ, থ্যালিয়াম, সালফার ও সেলেনিয়ামের সংমিশ্রনে যে যৌগ তৈরি করেছেন সেটি এমনিতে অন্তরক। কিন্তু এটির উপরিতলে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র কণার জগতে ইলেকট্রন খুবই কম বাঁধার মধ্যে ছুটাছুটি করতে পারে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে অতি-পরিবাহী। ‘এটি একটি বড় বিষয়।’ বলেন জাহিদ হাসান। ‘কারণ দেখা যাচ্ছে আগের বিসমাথ-নির্ভর বস্তুর তুলনায় নতুন এই বস্তুতে ইলেক্ট্রন প্রায় ১০ হাজার গুণ বেশি গতিতে চলাচল করতে পারছে।’
১৯৯৭ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফিলিপ এন্ডারসনের মতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। কেবল তত্ত্বের কারণে নয় বরং এর কারিগরি দিকটিও তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে অনেকদিন ধরে তত্ত্বীয় পর্যায়ে থাকা কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা যাবে।
জাহিদ হাসান আরো বলেন, ‘কেবল কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের নতুন জোয়ার নয় এর ফলে বস্তু জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে যেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে সেটির অধ্যায়নও আলাদা গতি পাবে।’ যেহেতু কার্যকর তাপমাত্রায় এটি বানানো যাবে। শুরু হবে এক নতুন ইলেকট্রনিক্সের যুগের। যার কেন্দ্রে থাকবে এই স্থানিক অন্তরক। হয়তো তখন সিলিকন ভ্যালির নাম পাল্টে হবে টপোলজিক্যাল ভ্যালি।
৮৫ বছর পর অধরা কণার খোঁজ
দুনিয়ার সকল বস্তুকণাকে বিজ্ঞানীরা দুই দলে ভাগ করেন। একদলের নাম বসু কণা বা বোসন। আলোর কণা ফোটন এই দলের অন্তর্ভুক্ত। এই কণাগুলো বাঙ্গালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসু ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সমকীরণ বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। সেই তত্ত্বানুযায়ী, ২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা এই দলের অন্যতম সদস্য “হিগস বোসন” যা ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত, তা খুঁজে পান।
অপর দলটিকে বলা হয় ফার্মিয়ন বা ফার্মি কণা। পরমাণুর গঠন-কণা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন হলো ফার্মিকণা। এগুলো বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাকের ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে। ইলেকট্রন, প্রোটনসহ জানা প্রায় সব ফার্মিয়নের নিজস্ব ভর আছে এবং এগুলো বৈদ্যুতিক চার্জও বহন করতে পারে বা চার্চ নিরেপক্ষও হতে পারে। কিন্তু ১৯২৯ সালে গণিতবিদ ও পদার্থবিদ হারম্যান ভাইল ভরশূণ্য কিন্তু বৈদ্যুতিক চার্জ বহনকারী ফার্মিকণার ভবিষ্যৎবাণী করেন এবং দাবী করেন এমন কণা বাস্তুবে রয়েছে। পরে বিজ্ঞানীরা তাঁর নামেই এর নামকরণ করেন ভাইল ফার্মিয়ন। জাহিদ হাসান জানালেন – “মোট তিন ধরণের ফার্মিয়নের মধ্যে ডিরাক ও মাজোরনা নামের বাকী দুইটি ফার্মিয়ন বেশ আগেই আবিস্কার হয়েছে। দীর্ধদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন মৌল কণা নিউট্রিনোই সম্ভবত ভাইল ফার্মিয়ন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে আবিস্কৃত হয় নিউট্রিণোরও ভর আছে। তখন থেকে আবার ভাইল ফার্মিয়নের খোঁজ শুরু হয়।” অবশেষে জাহিদের নেতৃত্বে প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা সেই ভাইল ফার্মিয়নের খোঁজ পান।
ভরশূণ্য হওয়ার কারণে ধারণা করা যায় যে, ভাইল ফার্মিয়ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে বর্তমান অর্ধ-পরিবাহী ইলেকট্রনিক সামগ্রীর তুলনায় কমপক্ষে এক হাজার (১০০০) গুন বেশি গতিতে চলাচল করতে পারবে। ভাইল ফার্মিয়নের আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটি একই সঙ্গে চৌম্বকের একক-মেরু (মনোপোল) এবং বিপরীত একক-মেরুর (এন্টি মনোপোল) বৈশিষ্ট্য বহন করে। ”অর্থাৎ”, ব্যাখ্যা করলেন জাহিদ, “এর ফলে পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেগুলো ইলেকট্রনের মত ছড়িয়ে পড়ে না, বরং সামনের দিকে তাদের গতি বজায় রাখে। ইলেকট্রনিক্সের ভেতরে ইরেকট্রনের যে ট্র্যাফিক জ্যাম হয় এখানে সেটা হবে না।” জাহিদের আশাবাদ এর মধ্যমে সূচিত হবে নতুন ধরণের ইলেকট্রনিক্স যাকে “আমরা বলছি ভাইলোট্রনিক্স’।
দীর্ধদিন ধরে ফার্মিয়ন নিয়ে কাজ করছেন কানাডার ওয়াটার্লু বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন ভার্খব। একটি আন্তর্জাতিক জার্নালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উচ্ছসিত ভার্খব বলেন – তত্ত্বীয় জগতের জিনিষপত্র বাস্তব জগতে খুঁজে পাওয়ার মত আনন্দের বিষয় আর কিছু নাই।
জাহিদ হাসানের গবেষক দল এই কণাটিকে খুঁজে পেয়েছেন একটি যৌগিক কেলাসের মধ্যে এবং কেলাসেই কেবল এটিকে পাওয়া যায়। তবে, হিগস বোসনের সঙ্গে ভাইলের পার্থক্য হচ্ছে হিগস বোসনের অস্তিত্ব কেবল কণা ত্বরকেই পাওয়া যায়। কিন্তু ভাইল ফার্মিয়ন দিয়ে বানানো যাবে নতুন ও কার্যকর কম্পিউটিং ডিভাইস। তবে, জাহিদ হাসানের ধারণা নিত্য ব্যবহারের ভাইলোট্রনিক্সের জন্য আমাদের আরো ১০ থেকে ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
নতুনদের জন্য
মাইক্রোসফট কর্পোরেশনে কর্মরত স্ত্রী প্রকৌশলী সারাহ আহমেদ, পুত্র আরিক ইব্রাহিম ও কন্যা সারিনা মরিয়মকে নিয়ে জাহিদের সংসার। শেকড়ের টানে যুক্ত আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডে । সুযোগ পেলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে জাহিদের। তবে, সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলার কাজ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-ঘুরে জাহিদ হাসানের এই প্রত্যয় হয়েছে যে আমাদের শিশু-কিশোরদের মেধা বিশ্বমানের। কাজে তাদের সাফল্যের ব্যাপারে সে খুবই আশাবাদী।
কম্পাসের কথা এখনো ভুলেনি সে। ভাবে ছোট্ট কম্পাস যেভাবে তাঁকে আগ্রহী করে তুলেছে বিজ্ঞানে, তেমনি নতুনদেরকে বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলার জন্য কাজ করে যাবে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরে কণা বিজ্ঞানে যুক্ত হয়ে যাওয়া বাংলার বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান।
কিশোর আলোর পড়ুয়াদের জন্য জাহিদের পরামর্শ – ‘তুমি পারবে’ নিজের ওপর এই বিশ্বাসটা স্থাপন করো। কিসে তুমি আনন্দ পাও, ককোনটা তোমার ভাল লাগে সেটা খুঁজে বের করো। নিজের একটা লক্ষ্য ঠিক করে সেটার জন্য এগিয়ে যাও। পদে পদে বাঁধা আসবে কিন্তু তোমার আশেপাশের লোকের জ্ঞান-অভিজ্ঞতাকে কাজি লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। তোমার মত যাদের লক্ষ্য তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করো। কঠিন পরিশ্রম করো তবে সে সঙ্গে ভারসাম্যটাও ঠিক রেকো যাতে তোমার জীবন অর্থপূর্ণ হয়। তাহলেই একদিন তুমি তোমার অভীষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
(কিশোর আলো পত্রিকার আগস্ট ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)
2 Replies to “জাহিদ হাসান : অধরা কণার বিজ্ঞানী”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
ধন্যবাদ স্যার, আমরাও এগিয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ্…
তৌহিদ
নতুন ভলান্টিয়ার
বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি
Very nice write up. Know basic thing abt fundamental particle.How we can reach to him !