আইনস্টাইন মোটেই ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিলেন না!
ছোটবেলায় যখনই কেও ভাল অংক করে বা বিজ্ঞানে তার প্রতিভা দেখায় তখনই বেশিরভাগ লোক তাকে “ছোট্ট আইনস্টাইন” বলে ডাকে। আর একটু বড়হলে, বিশেষ করে হাই স্কুলে বা কলেজে অনুরুপ ক্ষেত্রে সেটি হয় “তরুন আইনস্টাইন”।কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের বেশিরভাগ বাবা-মা তাদের সন্তানদের আইনস্টাইনবানাতে চান! কেন?
জবাবটা সোজা। জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দুনিয়া (Universe),সময় (Time) . স্থান (Space) সম্পর্কেআমাদের হাজার বছরের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। এই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালীপদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মনে করেন কোন একদিন আসবে যখন সময়ের কিংবা দুনিয়ারসম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেলা যাবে চার পৃষ্ঠায় এবং তার তিন পৃষ্ঠা জুড়ে থাকবে কেবলআইনস্টাইনের নাম!
কাজে সব বাবা-মা রা যদি তাদের সন্তানকে এমন একজন ব্যক্তির মতো বানাতে চান তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আইনস্টাইনের শাদা চুলের যে ছবিটা আমরা দেখি সেখানেতার বুদ্ধিদীপ্ত চোখের উপস্থিতি সহজে টের পাওয়া যায় এবং সেখান থেকে সহজে বিশ্বাসকরা যায় যে, ছোট বয়সে আইনস্টাইন আসলেই “আইনস্টাইন” ছিলেন। মানে ক্লাসের তুখোড় ছেলে, বিজ্ঞান আর গণিতে ফাটাফাটি অবস্থা, ক্লাসে সবার আগে যেকোন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে, স্কুলে না গেলে চিন্তিত স্যাররা তার খোঁজ নে্য়ার জন্য বাড়িতে চলে আসছেন!!!ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তাই ছিল?
গণিতের রাজ্যে একটি গুরুত্ব পূর্ণ সংখ্যা হল পাই(৩.১৪…)। মার্কিন রীতিতে মার্চের ১৪ তারিখকে লিখলে সেটি পাই এর মান প্রকাশ করে বলে ১৪ মার্চকে আমরা এখন পাই দিবস বলি। সেই ১৪ মার্চ, ১৮৭৯ সালে জার্মানির উলম শহরে হারম্যান আর পাউলিনের ঘরে এলবার্টের জন্ম। সে সময় এলবার্টের বাবা হারম্যান একটি চাকরি করতেন কিন্তু অচিরে চাকরি খুয়ে তাদের চলে যেতে হয় মিউনিক শহরে, যেখানে আইনস্টাইনেরএকমাত্র ছোট বোন মারিয়ার জন্ম। মিউনিকেই কেটেছে আমাদের আইনস্টাইনের ছোটবেলা।
জন্মের সময়ই আইনস্টাইন বেশ নাদুস নুদুস। পাউলিন একারণে তাকে নিয়ে একটু সংশয়ে ছিলেন। দেখা গেল আইনস্টাইন কথা বলতে পারে না সহজে। শব্দেরপর শব্দ সাজানোতে তার প্রানান্তকর অবস্থা হয়। এর মূল কারণ ছিল বলার জন্য শব্দ খুব সহজে খুঁজে পেত না এলবার্ট। যদিও সে মোটেই তোতলা ছিল না!
স্কুল শুরু করার আগে, চার বা পাচ বছর বয়সেএলবার্টের বাবা তাকে একটি কম্পাস উপহার দেয়। এটি ছিল আইনস্টাইনের জন্য খুবই কৌতুহলউদ্দীপক ব্যাপার। কারণ, যেখানে, যেভাবে রাখা হোক না কেন, ক্যাম্পাসের কাঁটা সব সময় উত্তর দিকে মুখ করে থাকে!!!
৬ বছর বয়সে মিউনিকে একটি স্কুলে যেতে শুরু করে এলবার্ট এবং তার মার ধারণাকে সত্যিপ্রমাণ করে ক্লাসে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে। একে ঠিক মতো কথা বলতে না পারা আর দ্বিতীয়ত কোন বিষয়েই ঠিকমত তৈরি হতে না পারা দুটোই স্কুলে ট্রেডমার্ক হয়ে যায়।স্কুলের শিক্ষকরা এলবার্টকে মোটেই পছন্দ করতো না। এমনকি কোন কোন স্যার তাকে ক্লাশথেকে বের করে দিত কারণ বলার মত কোন সাফল্য তার ছিল না। আইনস্টাইন খালি ভাবতেন স্কুল না থাকলে কী হয়! ঠিক মত কথা বলতে পারতো না বলে চুপচাপ এলবার্টের স্কুলে কোন বন্ধু ছিল না। বাসায় ফিরে তাসের ঘর সাজানো আর মারিয়ার সঙ্গে খেলে আর গল্প করেআইনস্টাইন বড় হতে থাকে।
৯ বছর বয়সে মূল স্কুলে আসার পরও স্কুলের পড়ালেখায় তার তেমন উন্নতি হয়নি। বরং স্কুলের লেফট-রাইট আর মিলিটারি ট্রেনিং তাকে আরো সন্ত্রস্থ করে তোলে। তবে, এর ফাঁকে তার বিজ্ঞান এবং বিশেষ করে গণিতে আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। এর কারণ ছিল দুইটি।এলবার্টের কাকা দেখা হলেই এলবার্টকে একটি গাণিতিক ধাঁধা জিঙ্গেস করতেন আর তার উত্তর খুঁজতে এলবার্ট যথেষ্ট আনন্দ পেতো। সমাধান ঠিক হলে এলবার্ট পেতো কাকার কাছ থেকে গণিত আর বিজ্ঞানের বই উপহার। আর দ্বিতীয় কারণ হল তাদের পারিবারিক বন্ধু, মেডিকেল কলেজের শিক্ষর্থী ম্যাক্স তামুদ। ম্যাক্স প্রতি বৃহস্পতিবার তাদের সঙ্গে ডিনার করতো। ম্যাক্স এলবার্টের জন্য জনপ্রিয় বিজ্ঞান আর দর্শনের বই নিয়ে আসতো। এগুলো পড়ে ব্যাপক আনন্দ পেতো এলবার্ট। ম্যাক্সই তাকে একটি জ্যামিতির বই দেয় যা এলবার্টকে অনেক কিছু নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। ম্যাক্সের দেওয়া বিজ্ঞানের একটি বইতে একটি এক্সপেরিমেন্ট ছিল এরকম যে লেখক টেলিগ্রাফ তারের ভেতর দিয়ে যে বিদ্যুৎযাচ্ছে সেটার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করছে! ১৪ বছরের আইনস্টাইন ভাবতে শুরু করলো আচ্ছা যদি আলোর রথে চড়ে বেড়ানো যায় তাহলে আলোর রথ টা কি থেমে থাকবে ? না কি চলতে থাকবে?
ম্যাক্সই এলবার্টকে উচ্চতর গণিতের বিভিন্ন বই পত্রপড়তে দেয়। এর মধ্যে ক্যালকুলাসের প্রতি এলবার্টের আকর্ষন তৈরি হয় এবং ১২ বছর বয়সথেকে ক্যালকুলাস শেখার চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য এসবের সঙ্গে স্কুলের পড়ালেখার কোনমিলই ছিল না।
এর মধ্যে কাকা আর বাবা মিলে কোম্পানি লাটে তুলে ১৮৯৪ সালে এলবার্টদের ফ্যামিলি ইতালির মিলানে চলে যায়। পড়ালেখা শেষ করার জন্য এলবার্টকে রেখে যাওয়া হয় মিউনিকে। কিন্তু একে স্কুলের পড়ালেখায় অনীহা তারপর সামরিক কায়দা-কানুন এসবের কারণে এলবার্ট স্কুল ছাড়ার চেষ্টা করতে থাকে এবং ৬ মাসের মাথায় একজন ডাক্তারকে রাজি করিয়ে “অসুস্থতার” সার্টিফিকেট জোগাড় করে। আর তা দিয়ে স্কুলথেকে ছুটি। স্কুলের পড়া শেষ না করেই বাবা-মার কাছে এলবার্টের চলে যাওয়া।
স্কুল ছাটাই হওয়া এলবার্টকে নিয়ে তার বাবা-মার উদ্বিগ্নতা বিশেষ মাত্রা পায় কারণ তখন হাইস্কুল পাস না হলে কোথাও ভর্তি হওয়া যেতনা। পরে তার বাবা-মা খুঁজে বের করেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেই ভর্তি হওয়া যায়। কাজে আইনস্টাইন সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দেয় এবং সাফল্যের সঙ্গে প্রায় সকল বিষয়ে ফেল করে। কিন্তু ম্যাক্সের বিজ্ঞান আর গণিতের বই এবং মেন্টরশীপের কারণে গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে যথেষ্ট ভাল নম্বর পায়। পলিটেকনিকের নিয়ম ভঙ্গ করে কর্তৃপক্ষ তাকে শর্ত সাপেক্ষে সুযোগ দিতে রাজি হয়।শর্ত হলো এলবার্টকে প্রথমে হাই স্কুল শেষ করতে হবে। পাশের আরাউ শহরে জস্টউইনটেলারের বিশেষ স্কুল থেকে আইনস্টাইন ১৭ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েট হয়ে জুরিখ পলিটেকনিকে ফেরৎ আসে।
সেখানকার বন্ধুবান্ধব কিংবা প্রফেসসরদের সঙ্গে এলবার্ট আইনস্টাইনের সখ্যতা, বিরোধের গল্পও বেশ চিত্তাকর্ষক। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।
আপাতত কোন বন্ধুকে ইয়াং আইনস্টাইন ডাকার আগে মনেরেখ – আইনস্টাইন মোটেই ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিলেন না!
[এই লেখাটি ছাপা হয়েছে প্রথম আলো’র কিশোর-এ, কিশোর আলোতে নয়। এর কোন লিংক না পেয়ে লেখাটাই এখানে দিচ্ছি যাতে আমার বন্ধুদের যাদের কিশোর দেখা হয়নি তারাও পড়তে পারে। যদিও পড়ার জন্য তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ নয় এটি]
2 Replies to “আইনস্টাইন মোটেই ক্লাশের ফার্স্ট বয় ছিলেন না!”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
The story of Einstein was exactly unknown to me.Now i know it.