দশে মিলে করি কাজ!!!
৬৭৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, ৩,৪৬১ ডলারের মাথা পিছু আয়!!!
না, অন্য কোন দেশের নয়। এই ছোট্ট বদ্বীপের। ভাবছেন সকাল সকাল কী খেয়েছি?
না, মাথা আমার ঠিকই আছে। আর হিসাবটাও। সেটাও আমার না। হিসাবটা করেছে এইচএসবিসি ব্যাংক। বলেছে আগামী ৩৬ বছরে আমরা ১৭ ধাপ আগাতে পারবো।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, “Fast growth – >5% average growth to 2050
The fast-growth economies are those that are at a low level of development but which have sufficiently strong underlying fundamentals so that they catch up with more developed economies with similarly strong fundamentals.
We have already discussed China and India, which sit firmly at the top of this group. Elsewhere in Asia, the Philippines, Malaysia, Bangladesh and Vietnam all look very strong.
যাদের আগ্রহ আছে তারা ২০১২ সালের রিপোর্টটা পড়তে পারেন। গত ৪ বছর ধরে আমি এটা ফলো করে দেখছি কথাটা সত্য কী না। এইচএসবিসি যে সব ছোটখাটো হিসাব নিকাশ করেছে সেটার সামান্য এদিক ওদিক হচ্ছে। মূল ব্যাপারটা ঠিকই থাকছে। গত চার বছরেই আমাদের বাজেট দ্বিগুনের বেশি হয়েছে। জিডিপর ব্যাপারটা ওরা যা ভাবছে তার চেয়ে বেশি গতিতে আগাচ্ছে।
আজ (১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬) সকালে রিপোর্টটা আবার পড়েছি কারণ গতকাল প্রথম আলো’তে মিজানুর রহমান খানের একটি নিবন্ধ। জানলাম মার্কিন মন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা দিল্লিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ মারাত্মক নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সত্ত্বেও খাদ্য আমদানিকারী থেকে রপ্তানিকারী হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে। এমডিজির অনেক লক্ষ্য পূরণ করেছে। শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে ব্যাপকভাবে। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি করেছে।’ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি প্রথম ৩০টা দেশের মধ্যে ঢুকে পড়বে।
এইচএসবিসি এই কথাগুলোই বলেছিল। তবে, মিজানুর রহমান খানের লেখায় জিডিপি কিংবা গড়-পড়তা আয় যে সব নয় সেটা নিয়েও বলছেন। মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বালিশের পাশে থাকতো সে বই যাতে লেখা ছিল,
“আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।”
(সোনালি কাবিন, আল-মাহমুদ)
জিডিপি আর জি-৩০ নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারটা আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমি বরং আজকে লিখতে বসেছি অন্য কিছু, অন্য কোন প্রসঙ্গ। অন্য আলাপ।
আমাদের কেউ যখনই কোন কিছু করে তখনই কেউ কেউ ঝাপায় পড়ে – বলে-
আরে এতো আমি অনেকদিন আগেই জানি।
আরে এটাতো ইউটিউবে আছে। ভিডিও দেখে বানাইছে।
ধুর ঐ বেটা কী ফটো তোলে। ফটো তোলে আমার মামা।
পাইথন একটা প্রোগ্রাম হল। সেটা আবার শেখার কী আছে?
মাসুদ রানার মত উপন্যাস আমি বাঁ হাতেই লিখতে পারি।
প্রায়শ আমার এই মজার অভিজ্ঞতাগুলো হয়। ২০১৪ সালে প্রথম আলো’র জন্য প্রতি সপ্তাহে আমাকে একজন বাঙ্গালিকে খুঁজে বের করতে হতো, দেশে বা বিদেশে। এমন কেউ যিনি কোন না কোন কাজের মাধ্যমে আমাদের হিসেবে দেশের সমার্থক হয়ে উঠেছেন, আমরা তাঁকে বলেছি “আমিই বাংলাদেশ”। কেউ হয়তো দেশের ছেলেমেয়েদের স্কলারশীপ দিয়ে, মেন্টরিং করে বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় সহায়তা করছেন, কারো কারো গ্যারাজ হয়ে উঠেছে বহুজাতিক কোম্পানি, কেউ বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ পদে উঠে পড়েছেন, একজন মাত্র শ’পাঁচেক বিজ্ঞানীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য। কিংবা কেউ হয়তো তানজানিয়া থেকে শিখে একটা নতুন পদ্ধতি হাওর এলাকায় চালু করেছেন, কেউ কেউ নতুন করে দেশে সাইকেলকে সামনে এনেছেন। এদের প্রত্যেকের গল্প যখন আমি জানি প্রতিবারই আবিস্কার করি এইচএসবিসি কেন নিজে থেকে আমাদের নিয়ে হিসাব করে, গার্টনারের কেন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হয়, গোল্ডম্যান সাক কেন বলে তোমারা উঠে আসবেই। সে সবের ধারাবাহিকতাই কিন্তু মার্কিন মন্ত্রীর বোধোদয়ের কারণ। কে না জানে তারই পূর্বসূরি এক সময় আমাদের “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলতেন!
আমাদের এই লোকেরা। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা তাদের সেরাটা দেখান এবং নীরবে নিভৃতে একটা আগুন জ্বালান। আমাদের কাজটা হল তাদের আগুনটা যেন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে তার উদ্যোগ নেওয়া, চেষ্টা করে যাওয়া। আর এটাও বলা যে, এই দেশে এখনো প্রতিযোগিতার সময় হয়নি। এখনো আমাদের বেশি দরকার সহযোগিতা। গণিত অলিম্পিয়াড থেকে শুরু করে আমাদের তাবৎ আয়োজনে আমরা বলি “নলেজ ইজ নট পাওয়ার, শেয়ারিং নলেজ ইজ পাওয়ার”। বলি বলেই গণিত ক্যাম্প থেকে ফিরে গিয়ে সবাই নিজের এলাকায় একটা গণিত ক্লাব খোলার চেষ্টা করে। দিপুর মতো প্রকৌশলীরা ছুটির দিনগুলোতে গ্রামের বাড়িতে অঙ্ক করাতে যায়। ইব্রাহিম কিংবা জজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা তাদের ছুটির দিনগুলো উৎসর্গ করে রূপসা নদীর পাড়ে কিংবা বাউনিয়া বাঁধে।
গণিত অলিম্পিয়াডে আমাকে অনেক গল্প বলতে হয়। সেখানে আমি একটা কথা প্রায়শ বলি – ১৬ কোটি আসলে কতো কোটি। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কয়েকটা বড় দেশকে বাদ দিলে বাংলাদেশ গোটা ইউরোপ থেকে বড়। এই কথা বলার উদ্দেশ্য থাকে এটা বলা যে, আমরা নিজেরাই যে কোন প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের বড় বাজার। বোস্টন কনলাস্টিং গ্রুপের একটা রিপোর্টে দেখানো হয়েছে আমাদের মধ্যবিত্ত কতোটা বড় হচ্ছে। এক সময় আমাদের গ্রামে মাত্র কয়েকটা পরিবারে কোরবানি হতো। সব মিলিয়ে হয়তো ১০-১২টা গরু। এখন পরিবার প্রতি ২/৩টা গরু! গ্রামের হিসাব এখন আর কেউ করে না (বাবা করতেন। উনি এখন আর নেই।)
কাজে এই বড় বাজারটা এত বড় যে, এখানে প্রতিযোগিতা না করেও ছোট ছোট সেক্টর ধরে কি অনেক কিছু করা যায়। এই যেমন ধরা যাক প্রযুক্তি পন্য। গত ৫ বছরে আমাদের দেশে হাই-টেক যন্ত্রপাতির চাহিদা বেড়ে আমদানীর ৭-৯% এখন এটিই। আমরা প্রতিমাসে মাত্র ১৮ লক্ষ নতুন মোবাইল ফোন সেট আমদানী করি!
১৮ লক্ষ! পৃথিবীতে বেশ কিছু দেশ আছে যাদের জনসংখ্যা এর থেকেও কম। সামনে এটা আরো বাড়বে।
আমরা কেউ কিন্তু এই ছোট্ট যন্ত্রটি দেশে বানানো বা এসেম্বেল করার কথা সেভাবে ভাবছি না। ওয়ালটন শুরু করেছে। কিন্তু আরও অনেকে করতে পারতো।
শুধু হার্ডওয়্যার নয়। সফটওয়্যারের কথাই ধরা যাক। সেখানেও আমরা হয়ে গেছি অন্যদের বাজার।
আচ্ছা, আমাদের দেশে কি একটাও ভাল একাউন্টিং সফটওয়্যার নাই? আচ্ছা যদি না থাকে তাহলে ২ বছরের একটা স্কিম নিয়ে কি আমরা একটা বানাতে পারি না? সেটা দরকার হলে আতিকই-ই-রাব্বানিই বানাক। তাঁর নেতৃত্বেই হোক। আমরা সবাই মিলে তার পাশে দাড়াই। তাকে এগিয়ে দেই। আমি নিশ্চিত মাত্র একটা ভাল একাউন্টিং সফটওয়্যার ৩ বছর পরে দেশের মাত্র ১০০০ কোটি টাকা দেশে রাখতে পারবে। (অবশ্য আমরা এখনই বলতে পারি স্বদেশি পণ্য কিনে হও ধন্য)।
কিংবা গার্মেন্টসের জন্য একটা ইআরপি। আমরা ৫জনকে এই খাতে বিশেষজ্ঞ বানাই। তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের গল্পগুলো বলি এবং তাদের সফটওয়্যার বিপনন করি।আগামী ৪ বছরে চিন থেকে মাত্র ৫০০০ গার্মেন্টস বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হবে। তাদের সঙ্গে এখনকারগুলো যোগ দিন। বাজারটা কত বড়!
আমরা বিদেশের জন্য সফটওয়্যার বানাতে চাই, বিদেশের জন্য এপ বানাই আর আমার দেশের টাকা নিয়ে যায় বিদেশিরা!
চাকরি করে নেয় বছরে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা আর গোলমেলে প্রোডাক্ট দিয়ে নিয়ে যায় তার ডাবল। অথচ আমাদের সফটওয়্যার কী খারাপ? ব্যাংকের কথাই ভাবুন – দেশের সবচেয়ে বড় দুইটি অনলাইন ব্যাংক কিন্তু চলে আমাদের বানানো সফটওয়্যারে। কিন্তু বাকীগুলোর বেশিরভাগ সফটওয়্যার নিয়ে এসেছে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন বাধ্য করে না ব্যাংকগুলোকে নিজেদের সফটওয়্যার ব্যবহারে? আমাদের আইটি নেতারাও বা কেন বিদেশী সফটওয়্যার বেঁচতে চান?
এতো শুধু আইটির কথা বলছি। সব সেক্টরেই এটা সম্ভব। কেবল প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে সহযোগিতার প্ল্যাটফরমে একত্রিত হতে হবে। পেছন থেকে ল্যাং মারার টেন্ডেন্সিটা কমাতে হবে (বাদ আমরা দিতে পারবো না)।
এখন সেটা হয়তো কয়েকজন মিলে শুরু করে দেওয়া যায়। যেমন চামড়া শিল্পের কয়েকজন মিলে শুরু করেছে, তানিয়াদের হাত ধরে।
আমি দেখেছি আমাদের তরুনদের মধ্যে এই সহযোগিতার ব্যাপারটা একেবারেই প্রোথিত। এরা অন্য সিইওকে নিজের অফিসে বসিয়ে রেখে কাজ শেখায়, প্রতিদ্বন্ধীকে বিপদে টাকা দেয়, শ্রমিক পাঠিয়ে কাজ তুলে দেয়!
কাজে আমরা পারবো না এটা ভাবার কোন কারণ নেই। অনেক জায়গায় নিরবে নিভৃতে শুরুও হয়েছে। আমাদের দরকার সে উদ্যোগগুলোকে সামনে নিয়ে আসা, ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করা। শেষটাও আমরা করতে পারবো।
অনেক বছর আগে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে মুহুরী নদীতে মানুষের বাঁধের একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। মানুষে মানুষে হাত ধরাধরি করে ঘন্টাখানেকের জন্য রুখে দিয়েছিল মুহুরী নদীকে।
কাজেই মানুষই পারে।
“মানুষই আসল তবু”।
আমরাও পারবো।
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।