আমাদের দেশে কবে নেস্টি বিকিলা হবে
১৯৭৬ সালে সম্ভবত বাংলাদেশ প্রথম অলিম্পিক গেমসে অংশ নেয় আর সেবারই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে মন্ট্রিয়ল থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি নীল রঙ্গের ট্রাউজার ও লাল-সবুজ জামার মতো একটা কিছু পরা আমাদের সে সময়কার দ্রুততম মানব মোশাররফ হোসেন শামীমের বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে প্যারেডে অংশগ্রহণ আমার এখনও মনে আছে। আমি একটা সাদা-কালো টেলিভিশনে এই দৃশ্য দেখেছি। নীল ট্রাউজার আর জামার বর্ণনা পরেরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে পড়েছি মনে হয়।
মোশাররফ হোসেন শামীম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে জন্য তার জন্য আলাদা একটা টান ও গর্ব হয়তো আমার মধ্যে ছিল। সে থেকে ভাবতাম অলিম্পিকে কখন আমরা পদক পাবো। সেবারের অলিম্পিকেই প্রথমবারের মতো পারফেক্ট স্কোর করেন রোমানিয়ার নাদিয়া কোমেনিচি। প্রতিদিন রাতে টেলিভিশনে একঘন্টার হাইলাইট দেখানো হতো। সেটা দেখা ছিল আমার একমাত্র কাজ। সেই থেকে অলিম্পিক নিয়ে আমার এক ধরণের ঘোর লাগা লেগেই আছে।
বিকিলা ও নেস্টি – আমার দুই নায়ক
কবি আইয়ুব সৈয়দ তখন আমাদের বাসায় আমাদের পড়াতেন। তার পরীক্ষার সময় কিছুদিন তার বড় ভাই এখন ডাক্তার (তখন চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়তেন) হানিফ আমাদের দুই ভাইকে পড়িয়েছেন। হানিফ স্যারের হাতে আমাদের দাবা খেলা শেখা এবং অলিম্পিকের খোঁজ নেওয়ার ব্যপ্তি। ততোদিনে আমাদের বাসায় নিয়মিত আনন্দমেলা, কিশোর বাংলা আসতে শুরু করেছে। সেরকম কোন এক সময় জানতে পারি ইথিওপিয়ার লম্বা দৌড়ের নায়ক আবিবি বিকিলা ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে ম্যারাথনে সোনা জিতেছেন, প্রথম কোন কাল-আফ্রিকান হিসেবে। তিনি ম্যারাথন দৌড়েছিলেন খালি পায়ে এবং খালি পায়েই এমিল জ্যাকপটের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েন। আনন্দমেলা থেকে জানতে পারি তিনি শুরুতে দলে ছিলেন না পরে রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে চান্স পান। বিকিলা পরের ১৯৬৪ সালের ম্যারাথনেও গোল্ড পেয়েছেন। এই দৌড়বিদ ইথিওপিয়াকে এস্টাবলিস্ট করে দেন লম্বা দৌড়ের নায়ক হিসেবে।
টিভিতে ১৯৭৬ সালের অলিম্পিক দেখার প্রভাব হয় সুদুর প্রসারী। সম্ভবত এর ১/২ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ ট্রাক এন্ড ফিল্ড প্রতিযোগিতা হয় চট্টগ্রামে। সেই সময় ভক্ত হই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দূরপাল্লার দৌড়বিদ হাবিলদার মোশতাক আহমেদের। সে সময় তিনি পুরুষদের ১৫০০, ৫০০০ ও ১০ হাজার মিটার দৌড়ে সোনার পদক জিততেন। আন্দরকিল্লার বাসা থেকে হেটে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে গিয়ে ঐ ক’দিন এথলেটিক্স দেখতাম। আমার ধারণা ছিল এখানেই হয়তো আমাদের অলিম্পিকের পদক পাবেন যারা তারা আছেন। কিন্তু ৮০ বা ৮৪ তে সেটা আর হলো না।
আশায় বুক বাঁধলাম সিউল, ১৯৮৮ সালে। সেবারই প্রথম জানলাম দক্ষিণ কোরিয়া তাদের শহরের মধ্যে বয়ে চলা নদীকে কেমন করে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। টেলিভিশনে সেই নদীর ছবি দেখতাম আর মনের মধ্যে চাক্তাই খালের জন্য আহাজারি বোধ হতো। সেবারই একটা চমক হয়ে গেলে ১০০ মিটার বাটারফ্লাই সাঁতারে। সুরিনাম নামে একটা অজানা দেশের এন্থনি নেস্টি নামের এক লোক আমেরিকার বুরুন্ডি ফুরুন্ডি নামের স্টারকে হারিয়ে সোনার পদক জিতে গেল। সেই এক অসাধারণ দৃশ্য। অলিম্পিকে সোনা বিজয়ীর দেশের ন্যাশনাল এনথেম বাজানো হয়। আমার মনে আছে রাতের বেলায় টিভিতে (ততোদিনে বুয়েটে পড়তে চলে এসেছি, কাজে রঙ্গিন টেলিভিশনে দেখেছি) নেস্টির পদক নেওয়ার ছবি দেখে ভেবেছি আহা কবে আমাদেরটাও হবে?
নেস্টিকে নিয়ে আমাদের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলো। আমার মনে আছে ইত্তেফাকে এ নিয়ে একটা সম্পাদকীয় লেখা হলো। সেটা পড়ে জানতে পারি সুরিনামে মাত্র একটা সুইমিং পুল আছে! সেখানে দিনের পর দিন নেস্টি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। আমার মনে নেই সেই বছর সুরিনাম টিমে আর কেউ ছিল কিনা কিন্তু নেস্টির নামটা আমার মুখস্ত হয়ে গেল। আমি জেনে গেলাম অধ্যবসায় আর চেষ্টা থাকলে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাওয়া যায়।
ততোদিনে বাংলাদেশ অলিম্পিকে স্বর্নপদক তো দূর একটা কোন পদক পাবে এই আশা ফিকে হয়ে গেছে। কারণ আমি ততোদিনে জেনে গেছি – এই জাতি কোন লংটার্ম প্ল্যান করতে পারে না, একটা কোন কঠিন স্বপ্নের পেছনে দৌড়াতে পারে না। সবই হয় হুজুগে। আমরা ‘আড়ম্বর করি, পালন করি না” … “ভূড়ি পরিমাণ বাক্য রচনা করতে পারি, কিন্তু তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করেত পারি না”।
বিকিলা আর নেস্টি সব সময় আমার অনুপ্রেরণা। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথম বারের মতো পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেই। ফিরে এসে যে প্ল্যান করি তাতে প্রথম সোনার পদক পাওয়ার জন্য টার্গট করি ২০১৭ সাল। আমাদের যে কোন পদকের টার্গেট ছিল ২০১০ সাল। এটি ঠিক করেছিলেন শ্রদ্ধেয় জামিলুর রেজা স্যার। ২০১৩ রেখেছিলাম প্রথম রূপার জন্য। এই দুইটাই এক বছর আগে হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে সামান্যের জন্য আমাদের গণিতের গোল্ড মেডাল হয়নি। হয়েছে ২০১৮ সালে। ছোটবেলায় জেনেছিলাম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সঠিক নিয়মে লেগে থাকলে সাফল্য পাওয়া যায়। সেটাই সত্য হলো। গণিতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এখন আমাদের তিনটি গোল্ড আছে।
গণিতের সাফল্য দেখে আমার আবার সামার অলিম্পিকের স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বছর কয়েক আগে জানতে পারি প্রকৌশল শোয়াইব ভাই-এর নেতৃত্বে রূপচান্দা তেল কোম্পানি বাংলাদেশের আর্চারির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছে। দেশের মধ্য থেকে সঠিকভাবে বাছাই, সেরম কোচের তত্ত্বাবধানে নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং রুটি-রুজির সংগ্রাম থেকে মুক্তি। এসবই দরকার অলিম্পিক পদকের জন্য।
আজ থেকে শুরু হয়েছে টোকিও অলিম্পিক। ইদানীং অলিম্পিকের সঙ্গে মার্কেটিং-এর সম্পর্ক আমাকে হয়তো বেশি টানে।
গত বছর হওয়ার কথা ছিল। করোনার জন্য একবছর পিছিয়ে গেল। বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা অংশ নিচ্ছে আর্চারী, এথলেটিক্স, শ্যুটিং ও সুইমিং-এ। দলের সদস্যরা হলেনে আর্চারীতে রুমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী (আর্চারী ও ৩ ইভেন্ট), মোহাম্মদ জহির রায়হান (৪০০ মিটার দৌড়), আরিফুল ইসলাম ও জুনায়া আহমেদ (পুরুষ ও মহিলাদের ৫০ মিটার সাঁতার) এবং আবদুল্লাহ হেল বাকী (১০০ মিটার এয়ার রাইফেল)। ইতোমধ্যে সানা ও দিয়া মিক্সড ইভেন্টে পরের রাউন্ডে গিয়েছেন।
সকল শুভ কামনা বাংলাদেশের অলিম্পিক প্রতিযোগীদের জন্য।
[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]