ডলস হাউস এবার ঢাকার প্রদর্শনীতে
১৯৯১ সালের মার্চ মাস। অবশেষে বুয়েটে পড়ার দিন শেষ হতে যাচ্ছে। মনে আনন্দ। আবার একটু মনও খারাপ। কারণ চট্টগ্রামে ভাই-এর বিয়েতে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। শেষদিন পরীক্ষা শেষে দলবেঁধে খেতে যাওয়া কাটাবনের চাইনিজে। সেখান থেকে বনানী আর্মি কোয়ার্টারে বোনের বাসায় ফোন। (তখন মোবাইল নাই!!!) দুলাভাই বললেন- ফোন করাতে ভাল হল। এক্ষুনি বাসায় চলে আয়। হাসান ভাই ভাবীকে নিয়ে ঢাকায় আসছে। প্লেন মাত্র ঘন্টা দুয়েক লেট আছে। তুমিও এয়ারপোর্ট যেতে পারবা।
খেয়ে দেয়ে দৌড়ালাম। মামুন একটা বড় ফুলের তোড়াও যোগাড় করেছে। সেই প্রথম আমরা (মানে যারা বিয়েতে যেতে পারিনি) আইভি ভাবীকে দেখলাম। হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় – অসম্ভব রূপবতী কইন্যা। আমরা তার সব দেবর একসঙ্গে তার প্রেমে পড়ে গেলাম!
কিছুদিনের মধ্যে টের পাওয়া গেল কইন্যা কেবল রুপবতী নন, গুনবতীও। শ্বশুর-শাশুড়ী থেকে শুরু করে পুরো শ্বশুড় গোষ্ঠীর মন জয় করে ফেলেছে, রান্নার চমৎকার হাত, ছবি আঁকে, কবিতা লেখে (কবিতার বইও বের হয়েছে) এবং আরো কত কী। ছুটিতে বাড়িতে গেলে দেখতাম অন্য রকম জামা কাপড়, শাড়ি পড়েন। কী বিষয়? না, ভাবীর নিজের ডিজাইন।
আমরা, দেবর-ননদরা একটা কাজ পেয়ে গেলাম। ভাবী তোমার ডিজাইনে আমাকে একটা পানজাবী বানাই দাও, আমার জন্য একটা কুর্তা!!!
সঙ্গে আমার ঘ্যানঘ্যানানি – তোমার তো সময় আছে। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ো না।
তো, শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন ১৯৯৫ সালে, ভাবী তার ডিজাইনের পোষাকে প্রদর্শনী করবেন তবে শর্ত হল যে আমাদেরও এর সঙ্গে থাকতে হবে। ঠিক হল আমি আর ভাবী হবো বিনিয়োগকারী আর বাকীরা কামলা!!! আর ভাবী ঠিক করলেন তিনি কাজ করবেন গ্রামীণ চেক নিয়ে।
ইবনে বতুতা বাংলার যে সকল বিষয়ের কথা বলেছেন তার মধ্যে বঙ্গ দেশীয় কাপড় বা বাঙ্গলা রুজিমার কথা আছে। মসলিনেরর কথা তো জানি। কিন্তু, টেক্সটাইলগুলোর কল্যানে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগে তখন আবার চেক কাপড়ের ঐতিহ্য ফেরানোর লড়াই শুরু হয়েছে। সে সময় বিশ্বজুড়ে মাদ্রাজী চেকের প্রবল প্রতাপ।
তো, ভাবীর দেওয়া ইনস্ট্রাকশন নিয়ে মিরপুর গ্রামীণের কেন্দ্র থেকে আমি কাপড় কিনে চট্টগ্রাম পাঠাই। সেখানে তৈরি হয় কুর্তা, জামা, পানজাবি এবং শাড়ি। মোটামুটি পরিমাণ হওয়ার পর ঠিক হল আমরা প্রদর্শণী করবো অঁলিয়স ফ্রসেসে। রমজান মাসে তিনদিনের জন্য সেটি নেওয়া হল। গ্রামীণ ব্যাংকের ডিএমডি খালেদ শামস রাজি হলেন উদ্বোধন করতে।
আগের রাতে সব পোষাকে ট্যাগ লাগানো, ইস্ত্রি করা থেকে শুরু করে পুরো প্রদর্শণীস্থল সাজানোর কজটা করা হল। কর্মীদের কেও মেজর, কেও ব্যাংকার, কেও স্কুল শিক্ষক, কেও মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আর সাজানোর নেতৃত্ব দিচ্ছে বড়ভাই খালিদ আহসান।
ট্যাগ লাগানোর সময় কিন্তু সকলে ঠিক করে ফেলেছে প্রদর্শণী শেষে কে কোনটা নেবে (কিছুই তো আর বেঁচা হবে না!)।
যাহোক, ডিজাইনার আইভী হাসানের প্রথম প্রদর্শনী। এবং আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে প্রথম দিনেই সকল জামাকাপড় বিক্রি হয়ে গেল। সাজানো কাপড়গুলোতে “SOLD” লিখে আমরা পরের দুইদিন কাটালাম। (এটি আমার নিজের প্রথম ব্যবসা। লাভের অংকটা লিখলাম না কারণ প্রদর্শণীর ব্রসিউর থেকে সাজানো-টাজানোর ব্যাপারগুলো খালিদ আহসানের ফার্ম থেকে হয়েছে। সেই বিল আমরা দেই নাইক্কা)।
সেই থেকে আইভী হাসান প্রতিবছর একটি করে প্রদর্শণী করেন। (বিনিয়োগ পার্টনারের আর দরকার হয়নি)। যখন হয়, তখন তার দেবর-ননদেরা হাজির হয়। একবার ঢাকাতেও হল। ড. ইউনুস আসলেন সেটি উদ্বোধন করতে। এর মধ্যে বুলগেরিয়ার রানীর জন্য ছবি দেখে পোষাক তৈরি করে ফেলেছে আইভী হাসান। রানী অবাক কারণ ছবি দেখে বানানো জামা ঠিক তার মাপ-মত হয়েছে!
প্রথমে বছরে একটা করে, তারপর দুটো করতে করতে একসময় শো-রুম এবং অন্যান্য জায়গায় দেওয়া। এখন চট্টগ্রামে চাঁনগাতে নিজের বাড়ির নিজতলায় তাঁর শো রুম আর কারখানা। কারখানার কর্মীরা ছাড়াও বাইরের কর্মীও আছে। আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়াতে পোষাক যাচ্ছে নিয়মিত। তবে, ঐ যে দেশী কাপড় দিয়ে শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে আর সরেননি। দেশী ম্যাটেরিয়ালেই থাকলেন। করছেন থিম ভিত্তিক প্রদর্শণী। সেই অনেক বছর আগে ঢাকায় একটা শো করেছিলেন। তারপর আর আসেননি।
অনেক বছর পর আবার একটি মেলাতে স্টল নিয়েছেন। মেলাটি হচ্ছে সিক্স সিজন হোটেলে।
ডলস হাউসের অনেক অনেক প্রোডাক্ট ওখানে থাকবে। চট্টগ্রামের ডিজাইনার বলে তাতে একটা ভিন্ন আমেজও আছে।
সময় পেলে বাড়ি ১৯, সড়ক ৯৬ গুলশান-২ এর সিক্স সিজন হোটেল থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
চলবে ৯ ও ১০ জুন। সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
(পুলিশের বাঁধার কারনে প্রদর্শণীটি বাতিল হয়ে গেছে। জানা যায়, আয়োজক কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো অনুমতি না নেওয়ায় এটি বাতিল করা হয়েছে)