খাবি লামে – জীবন সহজ , কঠিন বা জটিল নয়
এই ঈদে যারা খালি ঢাকাতে পার্কে-মাঠে-ময়দানে-ঝিলে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন। সেটি শুধু ঢাকা বা বড় শহরে নয়। জেলা-উপজেলা ও গ্রামেও এখন এমন দৃশ্য হর হামেশা দেখা যায়। এটির দুইটা ভার্সনই দেখা যায়। একটা ভার্সনে মাথার চুল লাল-নীল-সবুজ করা এক কিশোর-তরুনকে হাতে সেলফি স্টিক সহ সদাব্যস্ত ভঙ্গিতে ভিডিও রেকর্ড করতে দেখা যায়। শুধু চুল নয় তার বেশভূশার মধ্যেও রঙের ব্যপক আধিক্য দেখা যায়। এর একটি দলীয় ভার্সনও আছে। এতে দেখা যায় একজন স্মার্টফোনে ভিডিও করছে, একজন ডিরেকশন দিচ্ছে আর রঙ-চঙ্গা লোকেরা ফোন-ক্যামেরার সামনে নানা কিছু করে বেড়াচ্ছে।
ঈদ বেড়ানিদের একজন আমাকে বলেছেন – টিকটকারদের অত্যাচারে কোথাও শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না!!!
এই ঈদে না হলেও এর আগে এই ভিডিও বানাতে গিয়ে মারাও গেছে কয়েকজন। গ্রেপ্তারতো হরহামেশায় হচ্ছে। নিচের ছবির দুজনই টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে মারা গেছেন।
টিকটকার। হ্যা। এদের এই নাম। কিশোর-তরুনদেরই আধিক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিতান্ত অল্প সময়ের ভিডিওতে গানা-বাজনা-নাচানাচি করে তারা এই মাধ্যমটিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এই মার্চে টিকটক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তাদের মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১.২ বিলিয়ন বা মাত্র ১২০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এই সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। জন মানুষের ভ্রু-ক্রুটি উপেক্ষা করে প্রতিদিনই কেই না কেউ এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হচ্ছে। টিকটকের এলগোরিদম অন্যদের চেয়ে আলাদা।
ব্যবহারকারীদের একদল শুধু ফান করার জন্যই যুক্ত হয়, কেউ কেউ নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। আর একদল আছে যাদের ধারণা টিকটক থেকে তারা ভাল আয় করতে পারবেন। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এখন নানাভাবে আয় করা যায়। প্ল্যাটফর্ম যে বিজ্ঞাপন দেখায় তার একটা হিস্যা পাওয়া যায়, ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে উঠে নিজেরাও আয় করতে পারে।
অনেকের ধারণা রঙ্গ চঙ্, নাচানাচি করলেই মনে হয় বেশি ফলোয়ার পাওয়া যায় আবার আয়ও বেশি হয়। বিশেষ করে ড্যান্সার চার্লি ডি’এমেলিওর ফলোয়ার যখন মাত্র ১৪ কোটি!!!
কিন্তু কোন রঙ না মেখে, কাউকে ব্যঙ্গ না করে শুধু “জীবন সহজ, এটি জটিল নয়” এই মটো নিয়েও টিকটকে বিপুল জনপ্রিয় হওয়া যায়। আর এর প্রমাণ হলো টিকটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় পুরুষ খাবি লামে। লামে একজন সেনেগালীয়। থাকে ইতালীর তুরিন শহরে। ২২ বছর মাত্র বয়স। টিকটকে তার ফ্যান-ফলোয়ারের সংখ্যা ১৩ কোটি ৭০ লক্ষের বেশি!!!
আর মজার বিষয় হলো তার ভিডিওগুলোতে সে কোন কথা বলে না। এ যেন ‘বোবার শত্রু নেই, আছে কেবল বন্ধু (পড়ুন ফ্যান)’।
তো, তার টিকটক ভিডিওতে কী থাকে? সহজ।
আমার ছেলের সঙ্গে তার বোনের একটা কথপোকথনের কথা বলি। কোনো এক কোরবানের আগে তাদের ভাই বোনের কথোপকথন –
বোন – ভাইয়া, গরুর হাটে কতো গরু এটা জানার সহজ উপায় কী?
ভাই – সহজ। প্রথমে হাটের গরুগুলোর পায়ের সংখ্যা গুণতে হবে। তারপর সেটিকে ৪ দিয়ে ভাগ করলেই গরুর সংখ্যা পাওয়া যাবে!
(গরুর হাটে গোনাগুনি, যে অঙ্কে কুপোকাৎ আইনস্টাইন)
টিকটক ও ইউটিউবে এরকম অনেক ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে একটি সহজ কাজকে কতো জটিল ভাবে করা যায় সেটা দেখানো হয়। যেমন কলা বা শশার খোসা ছাড়ানো। টিকটকে ব্যাপক ভিউ পাওয়া একটা ভিডিওতে দেখা যায় একজন ছুরি ব্যবহার করে কলার খোসা ছাড়াচ্ছেন। লামে দেখালেন আপনি হাতেই এই খোসা ছাড়াতে পারেন। আর একটা ভিডিওতে দেখা যায় এক মেয়ে দাঁত দিয়ে শশার খোসা ছাড়াচ্ছে। লামে দেখিয়ে দিল সেটা একটা সাবজি-ছিলক বা ভেজিটেবল-পিলার দিয়ে সহজে কষ্ট না করেই করা যায়। এরকম ম্যালা আছে। কিছু উদাহরণ তার প্রোফাইলে দেখা যাবে।
@khaby.lame Your dentist is waiting you 🤣 🥒 Il tuo dentista ti sta aspettando 🤣🥒#learnfromkhaby #LearnWithTikTok #ImparaConTikTok
লামে নিজের একটা বৈশিষ্ঠ্য গড়ে তুলেছেন। প্রথমত ভিডিওতে সে কোন কথাই বলে না। এছাড়া শেষে তার ফেসিয়াল ও হাতের এক্সপ্রেশন থেকে বোঝা যায় ব্যাপারটা কতো সহজ। তার কারণে ইন্টারনটে এসএমএইচ (SMH Shaking My Head) এর ব্যাপারটা একটা বড় সংস্কৃতি হিসেবে এখন গড়ে উঠছে। সিএনএনকে দেওয়া গত বছরের এক সাক্ষাৎকারে লামে বলেছে – মাথা ঝাঁকানোর ব্যাপারটা তার করতে করতে হলেও বোবা থাকাটা তার ইচ্ছাকৃত। তার ধারণা (এখন সঠিক প্রমাণিত) যে বিশ্বের বেশি মানুষের কাছে পৌছানোর একমাত্র উপায় হলো কোন ভাষা ব্যবহার না করা!
২০২০ সালে করোনা মহামারির ছোবলে এই ইতালী প্রবাসী সেনেগালীয় কারখানা শ্রমিকের চাকরি চলে যায়। বাবা-মার সঙ্গে তিন ছোট ভাই-বোনকে সহায়তা করার পাশাপাশি নতুন চাকরির চেষ্টা করতে থাকে। এর মধ্যে একদিন বেডরুমে টিকটক ডাউনলোড ও নিজের একাউন্ট তৈরি করে। তারপর আবিস্কার করে একদল টিকটকার সহজ অনেক কাজকে কঠিন করে ফেলার ব্রত নিয়ে নেমেছে। তখন তার মনে হয় জীবনতো এতো কঠিন নয়। সহজই। কাজে সে তার সিম্পল মিশন নিয়ে নেমে পড়ে।
এখন তো তার আর কিছু্ই করা লাগছে না। ফোর্বসের হিসেবে সে এখন একজন মিলিওনিয়ার। আর সে জায়গা করে নিয়েছে ফোর্রবসের থার্টি আন্ডার থার্টির ২০২২ এর ইউরোপের আর্ট-কালচার-এন্টারটেইনমেন্টের তালিকায়।
লামে প্রমাণ করেছে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সিম্পলের মধ্যেও গর্জিয়াস হওয়া যায়।
লামে’র জন্য ভালবাসা।