স্টোরি টেলিং – কেমনে বলিব বলো?

Spread the love

স্টোরি টেলিং – ভাল গল্প কাকে বলি-১

আমরা তো এখন জানি যে, স্টোরিটেলিং হচ্ছে একটা আর্ট। তার মানে এর কোন সহজ বা কঠিন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। অন্য সব আর্টের মতো গল্প বলার জন্য সৃজনশীলতা, রূপকল্প এবং দক্ষতা – এই গুলো লাগবেই। খোঁজখবর নিলে দেখবেন অনেক প্লট ভাল গল্প কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘ক্লিক’ করে না। আবার খুবই শাদামাটা, পুরাতন গল্পও মাঝে মধ্যে নতুন উপস্থাপনার গুণে মারমার কাটকাট হয়ে উঠতে পারে।

আপনাকে ভাল কথক হয়ে উঠতে হলে প্রচুর পড়তে হবে এবং প্রত্যেকটা গল্প পড়ার সময় আগে বলা নিয়মকানুনগুলো মিলিয়ে নিতে হবে। দেখবেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের সঙ্গে হেমিংওয়ের গল্পের কাহিনীর মিল থাকলেও বলার ভঙ্গির কোন মিল নাই।
“কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না।” এটি রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের শুরু। “It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of light, it was the season of darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair.”” আর এটা হলো চার্লস ডিকেন্সের টেল অব টু সিটি’জের শুরু। দুটোর শুরু আবার পড়েন। কোন মিল পান?

প্রত্যেক কবি, লেখক, শিল্পী, পটুয়া সবারই একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। আপনাকে আপনার স্টাইল খু্ঁজে পেতে হবে। শুরু করা, গল্প বিকশিত করা এবং শেষ করা – এই প্রসেসটাই আপনি মানবেন। নিজের মতো করে। বিশেষ করে আপনি যখন ব্যবসার গল্প বলতে চান।

তবে, ব্যবসার গল্পের সঙ্গে কিন্তু সাধারণ গল্প-কবিতার একটা পার্থক্য আছে। গল্পকার-কবিদের কিন্তু কোন প্রোডাক্ট বা ব্র্যান্ডকে প্রকাশ করতে হয় না। কিন্তু আপনাকে এটা মাথায় রাখতে হবে,  দিনশেষে যেন কাজটা হয়। এই জন্য এই কাজটা একটু কঠিন। কারণ – ব্র্যান্ড হিসেবে আপনার কাছে হাজার হাজার ডেটা, ফ্যাক্টস, ফিগার থাকে। এগুলো থেকে বেঁছে নেওয়াটা কঠিন। অন্তত সহজ নয়। আবার একটা কনসিসটেন্ট মেসেজও দিতে হয়। এ সংক্রান্ত বই পত্রে আপনি অনেক প্রসেস পাবেন। তার একটা আমরা দেখতে পারি –

১. কার জন্য গল্প

এটা অবশ্য সব মার্কেটারের প্রথম ধাপ। আপনার গল্প কে শুনবে, কে দেখবে, কে পড়বে? অনেক সময় মার্কেটিং-এ কিন্তু সরাসরি গ্রাহককে টার্গেট করা হয় না। অন্যকেও টার্গেট করা যায়। কাজে শুরুতে এটা ফলসালা করেন। কার জন্য গল্প বলবেন। তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? কিংবা কী প্রতিক্রিয়া আপনি দেখতে চান।

কাগজ কলম নিয়ে শুরু করার আগে তাই কিছু রিসার্চ করে নিতে হবে। টার্গেট মার্কেট আর বায়ার’স পারসোনা মাথায় না থাকলে কিন্তু পস্তাতে হবে অনেক। এই দুইটি প্রসেস সম্পন্ন করে তারপর আগানো ভাল। কারণ এখান থেকে আপনি আপনার গল্পের একেবারে মূল জায়গাটা দেখতে পারবেন। পরের ধাপে যাওয়ার আগে বাটার জুতার এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা আবার একটু ঝালিয়ে নিন।

২. কী বলতে চান

আপনার মেসেজটা কী? গল্প শেষে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে দিয়ে কী করাতে চান? কিনবে? কেনার খো্ঁজ করবে? আপনার ব্র্যান্ডের নাম মনে রাখবে? এই ব্যাপারটা ফয়সালা করেন। তবে যাই করেন, আপনার গল্প এক লাইনের বা একশ পাতার বা তিন ঘন্টার – যাই হোক না কেন সেটাতে একটা কোর মেসেজ কিন্তু থাকতে হবে।

প্রথম আলোর এই সাত মিনিটের ভিডিওটা দেখেন। এই গল্প কিন্তু আপনাকে পত্রিকা কিনতে সরাসরি বলছে না। তাহলে কেন টাকা খরচ করে এটা বানানো হল?

আপনার গল্প কী করতে চায়? প্রোডাক্ট বেঁচবে না কি ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াবে নাকি ক্রাউডফান্ডিং করবে? কোন সার্ভিসকে প্রমোট করবে? যদি আপনি এটা ঠিক করতে পারেন তাহলে ১০-১২ শব্দের মধ্যে কোর মেসেজটা লিখে ফেলেন। আপনি যদি ওপরের কথাগুলো মেনে নেন তাহলে আপনার এটা পারার কথা। দরকার হলে প্রথমে কয়েক বাক্যে লিখুন। সেটির দিয়ে চেয়ে থাকুন। দেখবেন একসময় কয়েক শব্দের একটি বাক্যে আপনার কোর মেসেজ চলে এসেছে।

৩ কোন গল্প বলবেন

সব গল্প এক নয়। আপনার অডিয়েন্স যদি আপনার কাছে পরিস্কার হয় তাহলে আপনি এ প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারবেন তাড়াতাড়ি। মনে রাখবেন আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে অডিয়েন্সকে দিয়ে একটা কিছু করা বা তার মনে একটা আসন নেওয়া। আমি কয়েকটা পয়েন্ট আলোচনা করছি যা থেকে হয়তোবা একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে

  • আমারও ছিল মনে, কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে

এটা জুতা আবিস্কার কবিতার বিখ্যাত লাইন। যখন একটা প্রবলেম সলভ হয়ে যায়, তখন সবারই মনে হয় আরে এটা তো আমিও পারতাম। কাজে আপনার গল্পও এমন হতে পারে। কোন একটা সমস্যার সমাধান কেউ একজন অতীতে করেছে (না হলে আপনি কেমনে দেখাবেন) । এটা যখন এখন কেউ জানবে তখন একই কাজ করতে সে উদ্ধুদ্ধ হবে। এটি মার্কেটিং-এর একটা পুরানো কৌশল কিন্তু কাজ করে।

  • সাহসিকতার নাম নাইমার গল্প

প্রথম আলো তার এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছে। একটু আগেই সেটার লিংক দিয়েছি। এই গল্পটা সহজ এবং সত্যিকারের গল্প। ডাক্তার নাইমা টেকনাফের একজন সরকারি চিকিতসক। তার জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনাই এখানে উপজীব্য। আপনি এরকম গল্পই বলতে পারেন। জেনুইন গল্প। বানানো নয়। এটি করতে হলে আপনাকে এই গল্পগুলো খুঁজতে হবে। এই গল্পগুলোর একটি সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা আছে। মানুষ এমন মানবিক গল্প পছন্দ করে। এবং যে ব্র্যান্ড মানবিক গল্প করে তাকে মানবিক ব্র্যান্ড মনে করে।

  • ঈশপের গল্প

ছোটবেলাতে আমরা ঈশপের গল্প পড়েছি। এই গল্পগুলোর শেষে একটা নীতিবাক্য থাকতো যা খুব সহজে বোঝানো যেতো। আপনি সেরকম গল্প বলতে পারেন যার সঙ্গে কোন নীতির প্রশ্ন জুড়ে দিতে পারেন। একটা উদাহরণ হতে পারে যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলা। আপনার গল্পের ছোট্ট শিশুটি এই কারণে হয়তো কাপড় ময়লা করে ফেলে, পকেটে ময়লা রাখতে গিয়ে। সেটাই আপনার গল্পের উপজীব্য হতে পারে।

  • কমিউনিটি বানান

এটির সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হলো ‘মি, টু (Me too)’ আন্দোলন। দেখুন এটি শুরু হওয়ার পর যারা একই ধরণের ঘটনার ভিতর দিয়ে গিয়েছে তাদের অনেকেই একাত্ম হয়ে তাদের ঘটনাও শেয়ার করেছে। আপনার উদ্দেশ্য থাকবে এমন যে যারা দেখবে-পড়বে তারা নিজেরাই নিজেদের জীবনে এই গল্পটা খু্ঁজে পাবে। এই জন্য গল্পের চরিত্র ও আবহ যতোটা সম্ভব সাধারণ আটপৌরে রাখবেন।

  • জ্ঞানের বড়াই করো না

সব মানুষ কিন্তু শিখতে চায় না। হুমায়ূন আহমেদের এলেবেলেতে হাসির নাটক সম্পর্কে একটি প্যারা আছে। বলেছেন টিভিতে হাসির নাটক দেখার সময় সকলে আতশ কাঁচ নিয়ে বসে এবং বলে “ধুর এটা কোন হাসির ঘটনা হলো”। কাজে জ্ঞানের কথা বলতে হলে সাবধানে বলবেন। সম্ভব হলে যাদের কাছে আমরা জ্ঞানের কথা শুনি আপনার গল্পের চরিত্রও যেন সেরকম হয়।

৪. আঁই কিইত্তাম

গল্পের শেষে আপনি পাঠক-দর্শককে দিয়ে কী করাবেন সেটি ভুলে যাবেন না। যদি কমিউনিটি গড়তে চান তাহলে শেয়ার করতে বলেন। যদি কেনাতে চান তাহলে পেজে বা ওয়েবসাইটে ক্লিক করান। শুরুতেই এই কাজটা কিন্তু মাথায় থাকতে হবে। সাধারণভাবে লোকে গল্প শুনে বাহবা দিয়ে কেটে পরে। তার আগেই কিন্তু তাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে হবে। তবে, কোনভাবেই কিন্তু ‘গল্পের শেষটুক জানতে আমাদের পেজে আসুন’ মার্কা কিছু করতে যাবেন না।

 

ব্যাস হয়ে গেল আপনার গল্পের গাঁথুনি। এর পরের ধাপে জানতে হবে কোন মাধ্যমে গল্পটা প্রকাশ করা ঠিক হবে।

Leave a Reply