স্টোরি টেলিং – গল্প আমি পাবো কই?
ইউটিউবের কারণে এখন কয়েক মিনিটের বিজ্ঞাপনচিত্র বানানো যায় যা টেলিভিশনে হয়তো ১০-১৫ সেকেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হতো। আবার অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্র্যান্ডের বড় গল্পও বলা যায়। এসবের কারণে ব্র্যান্ড বিল্ডিং ও মার্কেটিং-এ স্টোরিটেলিং-এর গুরুত্ব বাড়ছে। তবে, মনে রাখা দরকার গল্প কিন্তু চিরন্তন মার্কেটিং কৌশল। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ গল্প শুনতে ও বলতে ভালবাসে। ফেসবুকে আমরা এখন অনেককে দেখি যারা খুব সাধারণ গল্পকেও অসাধারণ গল্পে পরিণত করতে পারেন।আবার ব্র্যান্ডগুলোও তাদের গল্প খো্ঁজার ব্যাপারে অনেক সচেতন হয়েছে। ফলে, নতুন নতুন অনেক গল্পও পাওয়া যায়।
স্টোরিটেলিং কী এবং কী নয় সেটা অন্য কোথাও বলবো। এই লেখাতে বরং গ্রেট স্টোরি কই পাওয়া যাবে সেটার খোঁজ নেই।
ব্র্যান্ডের গল্প কোথা থেকে আসে?
সবখান থেকে। যেমন ধরেন প্রতিস্ঠাতার গল্প। সিলিকন ভ্যালির বড় কোম্পানিগুলোর অনেকগুলোর জন্ম গ্যারাজে। সেটা এপল, এইচপির মতো প্রতিস্ঠানের বেলাতে সত্য। আবার জেফ বেজোসের সারাদেশে ঘুরে ঘুরে অ্যামাজন প্রতিস্ঠার গল্পও আছে। আমাদের দেশেও ছোট পরিসর থেকে বড় কর্পোরেট হাউস হওয়ার গল্পও অনেক আছে। আমার নিজের দেখা গল্প হলো চট্টগ্রাম সিগনেট গ্রুপ ও পূর্বকোণের প্রতিস্ঠাতা ইউসুফ চৌধুরীর গল্প। ১৯৩৩ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামের রাউজানে ছিলেন দুই দিন, তরুণ সম্মেলনে প্রধান অতিথি। ইউসুফ দাদা তখন ছাত্র। আরও দুইজনকে নিয়ে তিনি সেখানে চা খাওয়ানোর ফন্দী করেন। তারপর যখন প্রকৃত উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন তখন রাউজানের ফকিরহাটে ছাত্রসখা লাইব্রেরি করেন।তারপর নিউজফ্রন্ট, প্রেস হয়ে পত্রিকা। এটাই একটা গ্রেট স্টোরি।
প্রতিস্ঠাতার পরেই থাকেন কাস্টোমাররা। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রোডাক্ট নিয়ে তাদের এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করেন। এখান থেকে তোমার গল্পটি তুমি খুঁজে নিতে পারো। এধরণের গল্প মানুষকে আকৃষ্ট করে বেশি। সেজন্য মার্কেটাররা এগুলো বেশি খো্ঁজে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘ইনফ্লুয়েন্সার’রা। তাদের গল্পও মানুষ ‘বিশ্বাস’ করে। তবে সাধারণভাবে ভোক্তাদের গল্পে অন্য ভোক্তাদের আকর্ষন দুর্নিবার হয়ে থাকে।
আবার কোন কোন প্রতিস্ঠান বা ব্র্যান্ডের গ্রেট ক’জ থাকে। যেমন বিখ্যাত জুতা কোম্পানি টমস(TOMS)। আমার পাঠকদের বেশিরভাগই টমসের প্রতিস্ঠাতা মাইকোস্স্কির দুই পা’য়ে দুই রকম জুতা পরার গল্পটা জানেন। তাঁর প্রতিস্ঠান প্রতি জোড়া জুতা বিক্রি হলে লাতিন আমেরিকার গরীব শিশুদের এক জোড়া জুতা উপহার দেয়।
গল্প পাওয়া যায় প্রতিস্ঠানগুলো কীভাবে তাঁর কর্মীদের নানা প্রয়োজন পাশে দাড়ায় সেখান থেকেও। অনেক প্রতিস্ঠানই তাঁর কর্মীদের বিপদে-আপদে দুর্দান্তভাবে কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই গল্পও লোকে নেবে। আরও একটা হলো পিছনের দৃশ্য – বিহাইন্ড দ্যা সিন। যেমন একটি সংবাদপত্র কেমন করে প্রকাশিত হয়ে মানুষের বাসায় পৌছে কিংবা একটি বিজ্ঞাপনচিত্র কীভাবে নির্মিত হয় সেটার প্রতিও মানুষের আকর্ষন থাকে।
গ্রাহকের কাছ থেকে গল্প খুঁজে নেওয়ার অনেক বুদ্ধি আছে। আপনার ব্র্যান্ডের ফেসবুক পেজে আপনি গল্প আহবান করতে পারেন। ওখানে একটু কারিশমা করতে পারলে ভাল হয়। যেমন টয়োটা একবার করেছে “অটো-বায়োগ্রাফি(Auto-Biography)”। সে সময় টয়োটার পেজে মাত্র ১৬০,০০০ ফ্যান। তাদের উদ্দেশ্যে টয়োটার আহবান ছিল গাড়ি নিয়ে আপনার গল্প ভিডিও বা লিখে পাঠানোর জন্য। গল্পের একটা থিমও বলে দেওয়া হয়।
ব্যবহারকারীদের গল্প নিয়ে আকর্ষনীয় ‘গল্প’ হলো গুগলের ইয়ার ইন সার্চ। “Year in Search- See what Google Trends reveal about the questions we shared, the people who inspired us, and the moments that captured the world’s attention each year.” গুগলের ব্যবহারকারীদের কাজ হলো সার্চ করা। বছরজুড়ে তাদের সার্চ নিয়ে গুগল প্রতি বছর দুই মিনিটের একটা ভিডিও প্রকাশ করে। স্টোরিটেলিং-এর এরচেয়ে চমকপ্রদ স্টোরি খুবই কম আছে। ২০১৯ সালের গল্পটা শুরু হয়েছে “Throughout history, in times of uncertainty, the world looks for heroes.” আর কিছু লাগে আপনার গল্প শোনার আগ্রহ তৈরি করার জন্য!
এখান থেকে বোঝা যায় সব সময় গল্প আহবান করতে হয় না, সব সময় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় না। চোখকান খোলা রাখলেই ব্রান্ডের গল্প পাওয়া যায়।
গল্প খুব ভালভাবে তৈরি হলেই কেবল সেটা আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় কিংবা সেটা দিয়ে ‘নজর’ কাড়া যায়। গল্পের কাঠামো নিয়ে অনেক থিউরি ইন্টারনেটে খু্ঁজলে পাওয়া যাবে। সনানতনীদের যেমন আছে ফ্রেট্যাগে’র পিরামিড তেমন নতুনরা বিশ্বাশ করে ‘ত্রি এক্টে”। তবে, মোদ্দাকথা হলো গল্পের একটা শুরু থাকবে, একটা ক্রাইসিস হবে এবং সেখান থেকে উত্তরণ হবে। শুরুটা সম্ভব হলে রূপকথার গল্পের শেষের মতো, মানে ভাল আর ভাল। তারপরে ‘ভিলেন”-এর আবির্ভাব। সবশেষে ‘কিছু একটা” দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসা।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, সেই আশির দশকে, এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে একটা বই বের হলো “উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি”। তখন পর্যন্ত সবাই জানতো বাংলা বিষয়ের জন্য স্পেশাল নোটের প্রয়োজন হয় না। কারণ বাংলা বিষয়ে চেষ্টা করলেই অনেক নম্বর তোলা যায় না। কিন্তু এই সহায়ক গ্রন্থটি আসার পর জানা গেল বাংলা গদ্য/পদ্যের উত্তরও এতো চমতকার করে লেখা যায় যে, ৬০-৭০% তো বটে এমনকী ৮০% নম্বরও তোলা যায়। উত্তরে সংশ্লিষ্ট একটা কোটেশন জুড়ে দেওয়া, সোর্স উল্লেখ করে করে ডেটা দেওয়া এসবই আমাদের কাছে নতুন এক দুনিয়া উন্মোচন করে। সে সময় একটা কোটেশন ভাল মতো শিখি, কবি শেলির, “Our sweetest songs are those that tell of saddest thought”। আমাদের বেশিরভাগ গল্পই ট্র্যাজেডি ছিল বলে এই কোটেশনের বাজার ভাল ছিল। এখন কিন্তু আমরা জানি গল্পটা মূখ্য। তবে, আনন্দের, জয়ের গল্পের বাজার বেশি ভাল। যাই হোক, পিরামিড বা তিন-ধাপের গল্পের মধ্যে আপনাকে মোটামুটি সবকিছু কভার করতে হবে – সেটিং, চরিত্র, প্রবলেম বা বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ, এনগেজমেন্ট, লস এবং টার্নিং পয়েন্ট।
ব্র্যান্ডের গল্প বলার জন্য তোমার অবশ্য একটা প্রসেস থাকতে হবে – সম্পাদনা পর্ষদ, আধেয় বাক্স, ডেটাবেস ও বিতরণের চ্যানেল। আমি দেখেছি, আমাদের দেশে, বেশিরভাগ সংস্থা একটা কোন উপলক্ষে গল্পের সন্ধান করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা একটা এজেন্সীর মাধ্যমে। যে সমস্ত প্রতিস্ঠানের এজেন্সীর সঙ্গে বছর জুড়ে চুক্তি থাকে তারা ভাগ্যবান কারণ এজেন্সীর লোকেরা তাদের হয়ে ভাবে। কিন্তু যারা একটি ঘটনার সময় এজেন্সীকে ডেকে আনে তাদের কপালে সবসময় ভাল জিনিষ জুটে না।
এজেন্সীকে গল্প তৈরি করতে না বলে নিজেরাই যদি গল্পটা তাদের দিতে পারেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। এজন্য স্টোরিটেলিং প্রসেস কেবল মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট আবদ্ধ থাকলে মুশ্কিল। গল্প খুঁজতে হবে পুরো অর্গানাইজেশন জুড়ে – সেলস, প্রোডাকশন, ডিজাইন, কাস্টোমার সার্ভিস – সব ডিপার্টমেন্ট। অনেকের হয়তো জাপ্পোসের কাস্টোমার সার্ভিসের একটা গল্পের কথা মনে পড়বে। অনলাইনে জুতা বিক্রির প্রতিস্ঠান জাপ্পোসের (এখন অ্যামাজনের অংশ) একজন কাস্টোমার সার্ভিসের লোক একবার একজন কাস্টোমারের সঙ্গে কয়েকঘন্টা ফোনে কথা বলে তাকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করতে সক্ষম হয়েছে। সেলসের যে লোকটি গ্রামেগঞ্জে তোমার প্রোডাক্ট নিয়ে যাচ্ছে তার কথাও তোমার শুনতে হবে। কারণ কোথায় যে সুন্দর গল্পটি আছে সেটা কে জানে।
ভাল ব্র্যান্ডের হাজার হাজার গল্প এদিক সেদিক আছে। খু্ঁজে নিতে জানতে হবে।
One Reply to “স্টোরি টেলিং – গল্প আমি পাবো কই?”