পিএসসি পরীক্ষা বন্ধ করুন
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নামে এক অদ্ভুত প্রহসন হয় এদেশে। ২০০৯ সালে দুই মাথামোটা লোকের কম্বিনেশনে এটা চালু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে নাই তো কী হয়েছে, আমলারা চাইলেই তো করতে পারেন। ২০১০ সাল থেকে এই পরীক্ষা যে, আমাদের কোমলমতি পোলাপানকে নস্ট করছে তা নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছি। শুরু করেছিলাম পিএসসি পাশে কী ডক্টরেট হওয়া যায় দিয়ে। পরে আরো লিখেছি যেগুলো একত্রে এখানে পাওয়া যাবে।
মাঝখানে দীর্ধদিন এই নিয়ে লিখি নাই। অনেকটা হতাশ হয়ে যে, লিখে লাভ কী? চিল্লাই-এ বা কী হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার কাজতো আমাকে করতেই হবে। দরকার হলে গরার আওয়াজ আরো বাড়াতে হবে। জ্যোতি দাদার সঙ্গে আজকে আলাপ করবো যে একটা রিট আবেদন করা যায় কী না তা নিয়ে।
আজকের লেখাটার একটা কপি এখানে সংরক্ষণের জন্য রেখে দিচ্ছি।
=== পরীক্ষার্থীদের দয়া করে আবার শিক্ষার্থী করুন===
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।’
রাজা শুধাইলেন, ‘ও কি আর লাফায়।’
ভাগিনা বলিল, ‘আরে রাম!’
‘আর কি ওড়ে।’
‘না।’
‘আর কি গান গায়।’
‘না।’
‘দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।’
‘না।’
রাজা বলিলেন, ‘একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।’
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।
[ তোতা কাহিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।]
২০০৯ সালে কোনো রকম গবেষণা, সম্ভাব্যতা এবং ফলাফলের তোয়াক্কা না করে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, এর ফলে শিক্ষার শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল যখন ছাপা হয়, তখনই আমরা জানতে পারি আমাদের প্রায় সব শিক্ষার্থীর মেধা আর মননের প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। প্রতিবছরই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে বৈকি।
তবে শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দেশ্য তো কেবল জিপিএ-৫ পাওয়া নয়। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ভিত্তি মজবুত হচ্ছে তো? বিশ্বগ্রামের নাগরিক হিসেবে তারা তাদের বৈশ্বিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবে তো? নাকি তারা কেবলই পরীক্ষার্থী হিসেবে নিজেদের ভাবছে, শিক্ষার্থী হওয়ার চেষ্টা করছে না?
সম্প্রতি সংস্কৃতিমন্ত্রী আমাদের পরীক্ষা আর সনদপ্রবণতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘দেশে কোনো শিক্ষার্থী নেই, আছে কেবল পরীক্ষার্থী?’ কেবল পরীক্ষা দিয়ে যেকোনোভাবেই একজন সংস্কৃতিমান কিংবা নিদেনপক্ষে একজন জ্ঞানকর্মীকে গড়ে তোলা যায় না, সেটা তাঁর মতো একজন সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব ভালোই জানেন। জানেন বলেই হয়তো তিনি তাঁর হতাশার কথা বলেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের স্মরণে চট্টগ্রামে কিশোর বিজ্ঞান সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এই পরীক্ষার আরও ভয়াবহ দিকটি আর একবার টের পেয়ে এসেছি। আগে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নানান বিষয়ে নানানভাবে সময় কাটানোর সুযোগ ছিল। কারণ, কোনো তথাকথিত সার্টিফিকেট পরীক্ষা তাদের ছিল না। শিক্ষার্থীদের প্রথম পরীক্ষাটা ছিল মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা।
এখন এটা শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণিতে। এবং দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাত্র চার চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়, যা আমার জানা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবল বাংলাদেশেই আছে। এই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বা পিটিই-এর জন্য শিক্ষার্থীদের জানুয়ারি মাস থেকেই তোড়জোড় শুরু করতে হয়। কোচিং সেন্টারে যাওয়া, বাসায় গৃহশিক্ষকের আমদানি এবং এখন গোঁদের ওপর বিষফোড়া হয়েছে ‘মডেল টেস্ট’। এই মডেল টেস্টের অত্যাচার এমনকি সব দৈনিক পত্রিকার শিক্ষা পাতাতেও থাকে। কাজেই, যে কেউ যদি একজন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সারা বছরের কর্মকাণ্ড দেখেন তাহলে তিনি দেখবেন ওই শিক্ষার্থীর কাজ হলো নিজেকে পিটিই পরীক্ষার জন্য তৈরি করা এবং পরীক্ষার হলে গিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর উগরে দিয়ে আসা।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা কিন্তু আমাদের শিক্ষানীতিতে ছিল না। ২০০৯ সালে সম্ভবত মন্ত্রী-আমলাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এটির উদয় হয়েছে। কোনো এক সভায় একজন শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছিলেন, আগের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মাত্র ২০% ছেলেমেয়ে অংশ নিত। এ কারণে অনেক বিদ্যালয়ে কেবল ওই ২০ শতাংশকেই দেখভাল করা হতো এবং প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতে স্কুলগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হতো না। স্কুল মূল্যায়ন ও তদারক করার জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলতে হবে—এ ধারণা পৃথিবীতে ইউনিক এবং এর উদ্যোক্তাকে ডারউইন পুরস্কার দেওয়া যায়!
শুরু হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন এটি আখেরে ভালো হবে। আসলে কিন্তু হয়নি। হওয়ার কোনো কারণও নেই। ১০-১১ বছরের একজন শিক্ষার্থীকে নানান বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হয়, তাকে লিখন-পঠন-গণনায় হাতেখড়ি নিতে হয়, সমস্যা সমাধানের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে হয়, যাতে পরের ধাপে সে আরও এগিয়ে যেতে পারে। কেবল কেয়কটি প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করেই এই শিখন-ফল অর্জন করা যায় না। আর স্কুলগুলোকে যখন কেবল জিপিএ–৫ দিয়ে মাপা হয়, তখন সেখানে আর কিছুই থাকে না। থাকে কেবল তোতা কাহিনীর শুকনো পাতার খসখস গজগজ।
চট্টগ্রামের ওই কিশোর সমাবেশে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানিয়েছেন, তাঁর ভাই অধ্যাপক হুপমায়ূন আহমেদ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোটেই পড়াশোনা করতেন না। নানান কিছু করে বেড়াতেন। অষ্টম শ্রেণির পর থেকে তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে রসায়নে পিএইচডি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন। কিন্তু তাঁর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাঠে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো আর যা খুশি তা করার স্বাধীনতা আমাদের একজন অসাধারণ কথাশিল্পী দিয়েছে। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য কেউ তাঁকে বকা দেয়নি, কেউ তাঁকে স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে পাঠায়নি, কেউ মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর কপালে জিপিএ–৫–এর ছাপ এঁকে দেয়নি। চট্টগ্রামের ওই সমাবেশে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তারা সাঁতার কাটতে জানে কি না। মাত্র দু-তিনজন হাত তুলেছিল!
আমার মেয়েকে মাঝেমধ্যে স্কুলে আনা-নেওয়ার কারণে আমি বেশ কিছু অভিভাবককে দেখি, যঁারা সন্তানের জন্য দুপুরের খাবার হাতে নিয়ে স্কুলের সামনে বসে থাকেন। স্কুল ছুটির পর সন্তানকে কোচিং সেন্টারে নিয়ে যান এবং বেচারার দুপুরের খাবার খেতে হয় গাড়িতে! সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাকে অন্তত কয়েক জায়গায় পড়তে যেতে হয়!
যে যা-ই বলুক, যে উদ্দেশ্যের কথাই বলুক না কেন, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আমাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানানো ছাড়া আর কোনো ‘সুফল’ বয়ে আনতে পারেনি। এই উৎপাত থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের অতি দ্রুত মুক্তি দেওয়া দরকার। সরকার বাহাদুর ইচ্ছে করলে এই বছরেই এই উৎপাত থেকে শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের মুক্তি দিতে পারে।
যত তাড়াতাড়ি আমাদের পরীক্ষার্থীদের আমরা আবার শিক্ষার্থী বানাতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
===( প্রথম আলোতে ২৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত)===