বনের মোষ তাড়ানোর পৃষ্ঠপোষকতা-১
অনেকেই আমাদের নানান কাজ, মানে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে যুক্ত হতে চান। এদের মধ্যে যারা অংশ নিতে চায়, তারা তা জেনে যায়। যেমন গণিতের খবর প্রথম আলোতে ছাপা হয়, বিজ্ঞান কংগ্রসের খবরও পত্রিকায় ছাপা হয়। এগুলোর ওয়েবসাইটও আছে। ফেসবুকতো আছেই।
ভলান্টিয়ারও কোন না কোনভাবে যুক্ত হতে পারে। তবে, এই লেখাটি তাদের জন্য যারা সময় দিতে পারবেন না কিন্তু অন্যভাবে যুক্ত থাকতে চান। গত ক’দিনে আমি এরকম অনেক রিকোয়েস্ট পেয়েছি, আগেও পেতাম।
আমাদের বেশিরভাগ (আ)কাজের মোটামুটি এক ধরণের স্পন্সর আছে। ওনারা খরচাপাতিগুলো দিয়ে দেন। ফলে কাজগুলো হয়। আর আমরা বা ভলান্টিয়াররা কেও কোন টাকা নেইনা ফলে সেই খাতে খরচ নেই।
এখন গত ক’দিন ধরে আমি ভাবলাম এই সকল কার্যক্রমের মধ্যে কোনগুলোর সঙ্গে ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানিক স্পন্সর যুক্ত হতে পারে। আমি একটা প্রাথমিক তালিকা দিচ্ছি। ভাবলে আরো বুদ্ধি বের করা যাবে হয়তো, যদি দরকার হয়।
১. চিলড্রেন সায়েন্স ওয়ার্ল্ড – এটি হলো একটি স্কুলে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতার মতো ব্যাপার। এর আগে যে গুলো হয়েছে তার বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল – অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, ন্যানোর দুনিয়া, বিজ্ঞানের মজা মজার বিজ্ঞান, কতো রবি জ্বলেরে ইত্যাদি। ৩০-৪০ মিনিটের একটা প্রেজেন্টেশন/বক্তৃতা। এরপর পঁশ্ন-উত্তর। সচরাচর ক্লাস ধরে হয় যেমন ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেণীর জন্য। প্রেজেন্টেশনটা একটু ভিন্ন রকম, ভিডিও-টিডিও দিয়ে করা হয়। উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা। ২০১৩-২০১৪ সালে আমরা ছয়টি পাইলট করেছি জাপানের সায়েন্স ফোরাম ২১ এর সঙ্গে। ঢাকায় প্রতি অনুষ্ঠানে খরচ হয় ১০-১২ হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে করলে এর সঙ্গে হয়তো বক্তা-টিমের যাতায়াতটা যুক্ত হবে। এর সঙ্গে দুইভাবে যুক্ত হওয়া যাবে – এক হল মূল রিসোর্স পার্সন হওয়া। আমরা বলি কমপক্ষে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কোথাও কাজ করেন এমন কেও। মানে মিনিমাম গ্র্যাজুয়েট। বিষয় হতে পারে যেকোন কিছু, বিজ্ঞানের। শেষের দিকে একটা কুইজ করে কিছু বই পুরস্কার দেওয়া হয়।
আবার ইচ্ছে করলে কয়েকটি প্রোগ্রাম স্পন্সর করা যাবে ফাউন্ডেশন বা প্রতিষ্ঠানের নামে। এটি স্ন্সর তাঁর নিজের গ্রামে বা মহল্লার স্কুলে করতে পারবেন।
২. উপজেলা/জেলাওয়ারি বিজ্ঞান মেলা – এটি একটু বড়-সড় আয়োজন। মোটামুটি একদিনের একটা আয়োজনে লাখ দুই টাকা লেগে যায়। যেখানে এলাকার স্কুল/কলেজ/বিজ্ঞান ক্লাবের সদস্যরা এসে প্রজেক্ট দেখাবে এবং বেলা শেষে পুরস্কার পাবে।
৩. উপজেলার বিজ্ঞান শিক্ষকদের জন্য আধাবেলার কর্মশালা – এটি মূলত বিজ্ঞানের পঠন-পাঠন-মোটিভেশনাল। এর মধ্যে গত দুই বছরে আমরা ৬টি পাইলট করেছি। এলাকার ১০-১২টা স্কুলে ২০-২৫ জন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং তাদের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনাটা করেন একজন রিসোর্স পার্সন। একটা ফরম্যাল পেপার/প্রেজেন্টেশন তিনি করেন যার মূল বিষয় থাকে বিজ্ঞান শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য থাকে হাতে কলমে বিজ্ঞানের নানান কিছু করে দেখার সুযোগ। গড়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ একটি অনুষ্ঠানে।
৪. বিজ্ঞানের বাক্স – এটি একটি গণ-গবেষণা প্রকল্প। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দুইটা বাক্স বানানো যার খরচ পড়বে ৫০০ টাকা এবং ২০০০ টাকার মতো। উদ্দেশ্য হবে ঐ বাক্সে এমন সব কিছু দিয়ে দেওয়া যা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ক্লাসের বই-এ যে সব এক্সপেরিমেন্টের কথা লেখা আছে সেগুলো হাতে-কলমে করতে পারবে। এরকম দুইটা বাক্স কিন্তু আছে। একটি গাইবান্ধার আজাদের বানানো আর একটা আমাদের ইব্রাহিম স্যারের। আমাদের কাজ হবে এই দুইটাকে আরো এগিয়ে নেওয়া প্লাস সেটিকে ছড়িয়ে দেওয়া। এটি একটি লম্বা সমযের কাজ এবং দুইজন গবেষকের ভাল সময় লাগবে পরীক্ষা পাইলটিং করে সেটার ম্যানুয়াল বানাতে। তবে, নভেম্বর মাসে শুরু করতে পারলে হয়তো আগামী এপ্রিলের দিকে ডেলিভারি হতে পারে। মানে ৬ -৮ মাস। খরচাপাতি কয়েক লক্ষ টাকা।
৫. একটা মোবাইল ল্যাবরেটরি– বিজ্ঞান ক্যাম্পে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে পারি। কিন্তু সঙ্গে যদি একটা ছোট (পোর্টেবল) ল্যাবরেটরি থাকে তাহলে ক্যাম্পিংটা অন্য মাত্রায় যেতে পারে। এই ল্যাবের মূল উদ্দেশ্য হবে মাপামাপির ব্যাপারটা শেখানো। কাজে মাপামাপির ব্যাপারটাতেই যত জোর দিতে হবে। বিদেশে অনেক ধরণের এক্সপেরিমেন্টাল কিট পাওয়া যায়। সেগুলো যোগাড় করত হবে। জাফর স্যারের একটা গাড়ি ছিল। সেই এক্সপেরিমেন্টগুলোও করা যায়। তবে, যত পারা যায় ভিডিও এক্সপেরিমেন্ট বাদ দিতে হবে। মানে মাপো, ভাঙ্গো এবং গড়ো – এই হবে মটো। বাজেট – জানি না।
৬. আঞ্চলিক বিজ্ঞান ও গণিত ক্যাম্প (অনাবাসিক)– এগুলো আয়োজন করা সহজ। প্রথমত দরকার স্থানীয় আয়োজক যারা শিক্ষার্থীদের এবং লজিস্টিকটা দেখবে। করতে হবে এমন কোন স্কুলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে আশেপাশের শিক্ষার্থীরা আসতে পারে। এটি হতে পারে দুই/তিনদিনের এবং পার্টিকুলার ক্যাটাগরির জন্য। স্পন্সরকে বহন করতে হবে সবার খাওয়াদাওয়া, ঢাকা বা আশেপাশের জায়গা থেকে রিসোর্স পার্সনদের যাতায়াত, খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থার জন্য খরচ। এরকম একটি গণিত ক্যাম্প কিছুদিন আগে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জে হয়েছে। রিসোর্স পারসনরা বেশিরভাগই বুয়েট বা ঢাবির শিক্ষার্থী। খরচ – এলাকা ভেদে ভিন্ন হবে।
৭. আবাসিক গণিত বা বিজ্ঞান ক্যাম্প – এটি একটু বড়সর আয়োজন। সবার থাকা খাওয়া এবং যাতায়াতের একটা ধকল থাকে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওযা যায়।কুদরাত-ই-খুদা সামার ক্যাম্পগুলো ছিল তিন দিনের, গড়ে অংশগ্রহণকারী ছিল ৫০ জন। খরচ ৩০-৫০ হাজার টাকা। ইচ্ছে করলে খরচ কমানোও যায়। মানে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের টিফিন নিয়ে আসবে। কোন খাওয়া দাওয়া দেওয়া হবে না। তাহলে খরচ কমে যাবে। এইগুলো ইচ্ছে করলে একদম প্রত্যন্ত গ্রামে করা যায়।
৮. সংখ্যা ভ্রমণ – এটি গণিতের একাডেমিক টিমের একটি ট্যুর প্রোগ্রাম। ওরা এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে যায় এবং সেখানে গিয়ে একটা ক্লাস নেয় ২/৩ ঘন্টার। গনিতের মজার বিষয়গুলোই সেখানে প্রাধান্য পায়। যাতায়াত, থাওয়া-দাওয়াই মূল চ্যালেঞ্জ যদিও ইদানিং দেখা যাচ্ছে পোছে যাওয়ার পর অনেক দাওযাত পাওয়া যায়! আর একটা চ্যালেঞ্জ হল স্কুলগুলোকে রাজী করানো।
৯. শিক্ষকদের জন্য ক্যাম্প – এটি সবচেযে স্পর্শকাতর অনুষ্ঠান। শিক্ষকদের কোথাও না কোথাও ডেকে আনতে হয়।যতজনকে ডাকা হয় শেষ পর্যন্ত ততজন আসেন না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও সিনিয়র বিজ্ঞানী/শিক্ষকদের সেখানে নিতে হয়। সেজন্য প্রায় প্রতিদিনই একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে রাখতে হয়।আবার শিক্ষকদের যাতায়াত খরচটাও দিয়ে দিতে হয়। কাজে খরচাটা একটু বেশি। কদিন আগে ক্রিস এনার্জি এরকম একটা ক্যাম্পের আয়োজন করে যেখানে কুমিল্লার দুইটি উপজেলার ৬০ জন বিজ্ঞান শিক্ষক এসেছিলেন। খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। ওনারা ছিলেন ঢাকার পদক্ষেপের ডরমিটরিতে।
১০. স্বেচ্ছাসেবকদের ক্যাম্প – দেশের নানান স্থানে এখন অনেকেই এই রকম কাজের উদ্যোগ নেয় কিংবা আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের জন্য কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। সেটি আবাসিকভাবে করতে পারলে খুব ভাল হয়। মোটিভেশনের পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বাড়ানোরও একটা চেষ্টা থাকে।
আপাতত এই কয়টাই মাথায় আসছে। সবগুলোকে আরো ডিটেইল করার চেষ্টা করবো আগামীতে। বাকী আল্লাহ ভরসা!
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দরো হোক।