উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০১৭ পেলেন যারা-১ : মনজুরুল হক, বারকোড রেস্তোরা গ্রুপ
চাকরি খুঁজব না,চাকরি দেব গ্রুপ থেকে আমরা প্রতিবছর সম্মাননা দেই। তাদেরকেই দেই, যারা আগের বছরে যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। এদের একদলকে দেই আমরা নবীন উদ্যোক্তা স্বারক এবং একদলকে দেই উদ্যোক্তা সম্মাননা। এছাড়া দুটো বিশেষ সম্মাননা দেই- একটি সৃজনশীল এবং দেশে সস্পূর্ণ নতুন ধারার উদ্যোগ এনেছেন। নুরুল কাদেরের নামে সম্মাননা। আর একজনকে দেই প্রচলিত ব্যবসা যার হাতের ছোঁয়ায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। ইউসুফ চৌৈধুরী সম্মাননা পান তিনি। এবারের ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা পেয়েছেন – চট্টগ্রামের রেস্তোরা ব্যবসাকে উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়ায় মনজুরুল হক। গত ৫ মে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ মিলনায়তেন এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা ২০১৭ – মনজুরুল হক
মনজুরুল হক – চট্টগ্রামের সবার প্রিয়মুখ। চট্টগ্রামের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এবং রেস্টুরেন্ট কালচারকে যিনি নিজের সৃজনশীল উদ্যোক্তা সত্ত্বার ছোঁয়ায় পালটে দিয়েছেন গত পাঁচ বছরে।
তাঁর প্রয়াত পিতা এন মোহাম্মদ গ্রুপের সফল উদ্যোক্তা জনাব নুরুল হকের ব্যবসাস্থল দুবাইতে মনজুরুল হকে জন্ম। পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। পড়াশুনা করেছেন প্রথমে চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে। এইচএসসি পাস করেছেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। অতঃপর উচ্চশিক্ষা- সিঙ্গাপুরে। সেখানকার থেমস বিজনেস স্কুল থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক শেষ করেন।দেশে ফিরে পিতার ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এন. মোহাম্মদ গ্রুপের পরিচালকের দায়িত্ব পালন।
সিঙ্ঞাপুরে অবস্থানকালে পার্ট-টাইম চাকুরি করেছেন বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে – সেখানকার রেস্টুরেন্ট কালচার আর ব্যবসার খুঁটিনাটি কাছ থেকেই দেখেছেন। চট্টগ্রামে ফিরে পারিবারিক ব্যবসায়ে সফল হলেও তিনি খেয়াল করলেন এখানকার রেস্টুরেন্ট কালচার সেই আদিম যুগেই রয়ে গেছে। তাঁর ভেতরের উদ্যোক্তা সত্ত্বার তাড়নায় তিনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উদ্যোগী হন। সুদুরপ্রসারী ও সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা দ্বারা তিনি ২০১২ সাল থেকে একে একে প্রতিষ্ঠা করেছেন বারকোড ক্যাফে, বারগুইচ টাউন ক্যাফে, মেজ্জান হাইলে আইয়্যুন, বীর চট্টলা, বারকোড জিইসি, বারকোড মেরিনা ক্যাপেল্লা, দোসা লাভার্স। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের গন্ডি পেরিয়ে বারকোডের দুইটি শাখা সফলভাবে চালু হয়েছে ঢাকার বনানী এবং গুলশানে। এর বাইরেও এন. মোহাম্মদ গ্রুপের অধীনে তিনি সফল্ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন সিক্স ইভেন্টস, এক্সক্লুসিভ ফার্নিশিং এন্ড ডেকোর, এন. মোহাম্মদ কনভেনশন সেন্টার, এন. মোহাম্মদ পাওয়ার টেক ইত্যাদি।
বারকোড ক্যাফে চালু করার পেছনে তাঁর আগ্রহের মূলে ছিল চট্টগ্রামের তরুন প্রজন্মের জন্য এমন একটা আড্ডার জায়গা করে দেওয়ার যেটা হবে বাসার মতই – যেখানে এসে তারা কফির কাপে ঝড় তুলতে পারবে। চাইলে পাবে কম দামে স্বাস্থ্যকর আর সুস্বাদু খাবার। খুব ছোট্ট পরিসরে এক বন্ধুর কাছ থেকে যায়গা ভাড়া করে ২০১২ সালে শুরু করেন বারকোড ক্যাফে। সেই বন্ধুও সন্দিহান ছিলেন চট্টগ্রামের বাদশাহ মিঞা পেট্রল পাম্পের পাশে একটা রেস্টুরেন্ট চলা নিয়ে। তাই শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন রেস্টুরেন্ট না চললেও যেন তাঁর ভাড়া তিনি ঠিকঠাকমত পান। কিন্তু পরিচ্ছন্ন আঙ্গিক, সৃজনশীল ব্যবস্থাপনা আর নতুন ধারণার কারনে খুব অল্পদিনের মধ্যেই তরুণ প্রজন্মের এক নম্বর পছন্দের যায়গা হয়ে ওঠে বারকোড ক্যাফে। এরপর সেটির পরিসর বড় হয় আরো। আর বারকোডের সফলতাকে পুঁজি করে আজ এই এলাকা এবং চট্টগ্রামের আরো কিছু এলাকা হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট পাড়া। বলা যায় তিনি তরুন প্রজন্মের একটি অংশকে আগ্রহী করে তুলেছেন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ে যার চিহ্ন আজ চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে।
শুধু বারকোড ক্যাফে নিয়ে মনজুরুল হকের মন ভারছিল না। চট্টগ্রমের স্ট্রিট ফুড কালচার আগে থেকেই সমৃদ্ধ কিন্তু সেটি ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল খাবারের পড়তি মানের কারনে। স্ট্রিট ফুড নিয়ে কাজ করার চিন্তা থেকেই তিনি ২০১৫ সালে শুরু করেন বারগুইচ ফিউশন ক্যাফে। চটপটি, ফুচকা সহ নানান স্বাস্থ্যকর এবং সাশ্রয়ী নানান ধরনের স্ট্রিট ফুডের সমাহার ঘটান খোলামেলা পরিবেশের ক্যাফেটিতে। খুব দ্রুতই ছুটির দিনগুলোতে চট্টগ্রামের অনেকেরই সান্ধ্যকালিন গন্তব্য হয়ে ওঠে ক্যাফেটি। চট্টগ্রামের তরুন প্রজন্মের প্রিয় আড্ডাস্থলও হয়ে ওঠে এই ফিউশান ক্যাফে।
ইতিমধ্যে তাঁর মাথায় খেলে যায় আরো দুইটি অভিনব আইডিয়া। প্রথমটি হ’ল চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবানিকে ব্র্যান্ডিং করে শুধু মেজবানি কেন্দ্রিক একটা রেস্টুরেন্ট করার। কারণ চট্টগ্রামের বাইরে থেকে বেড়াতে আসা অনেকেই মেজবানি খেতে চান কিন্তু মেজবানি সবসময় পাওয়া যায় না আর পাওয়া গেলেও রবাহুত কাউকে নিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই বিব্রতকর। এই আইডিয়া থেকে তিনি ২০১৬ সালে শুরু করেন ‘মেজ্জান হাইলে আইয়্যুন’ – যার দুইটি শাখা এখন চালু। দুপুরে-রাতে যে কোন সময় চাইলেই এখন মেজবান খাওয়া যায়। বাইরের অতিথিকে মেজবান খাওয়াতে চাইলে এখন আর দাওয়াত পাবার আশায় বসে থাকতে হয় না। দ্বিতীয় আইডিয়াটি ছিল চট্টগ্রামের বিখ্যাত বিয়েবাড়ির খাবারকে ব্র্যান্ডিং করা। অনেকেরই মাঝেমাঝে বিয়েবাড়ির মজার খাবার খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু বিয়ের কোন দাওয়াত থাকে না আর চট্টগ্রামে কোন মেহমান আসলে তাঁকে বিয়েবাড়ির খানা দিয়ে আপ্যায়নের ইচ্ছে থাকলেও সবসময় তা সম্ভব হয় না। মনজুরুল হক মনে করলেন একটা রেস্টুরেন্ট করা যায় যেখানে প্রতিবেলাতেই বিয়েবাড়ির খাবার যে কেউ খেতে পারবেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের গতানুগতিক ধাঁছের গ্রামের বাড়ির আদলে তিনি বিয়েবাড়ির খাবার মেন্যু নিয়ে ২০১৭ সালে চালু করলেন ‘বীর চট্টলা’ রেস্টুরেন্ট।
বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপে কাজ করার জন্য মনজুরুল হক সবসময়ই অনভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেন যারা তাঁর রেস্টুরেন্টে প্রশিক্ষণ পেয়ে কাজ শেখে। তাঁর বারকোড রেস্টুরেন্ট গ্রুপে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩০০ জনের অধিক কর্মীর। কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-আঞ্চলিকতা এসবের বাইরে থাকার নীতিতে বিশ্বাসি। বারকোডে কাজ শেখা অনেকেই এখন দেশ-বিদেশের ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। এর বাইরে তিনি খাবারের গুণগত মান ঠিক রাখার ক্ষেত্রে কোন আপোষ করেন না – কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রুপের ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা চালু করেছেন যার কারনে মেয়াদ উত্তীর্ণ বা গুণগতভাবে খারাপ কিছু গ্রাহকের প্লেটে না যায়।
সম্প্রতি তিনি আরেকটি জনসেবাধর্মী উদ্যোগ নিয়েছেন চট্টগ্রামকে ব্র্যান্ডিং করার জন্য – ‘আমরা চট্টগ্রাম’ নামে। তিনি চট্টগ্রামকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করতে চান “The city of hospitality’ ব্র্যান্ডিং এ। তাঁর পরিকল্পনা হচ্ছে নিজের বিনিয়োগে এই উদ্যোগ তিনি পরিচালনা করবেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনায় থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের পার্ট-টাইম কর্মী হিসেবে নিয়োগ করে যেন তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসায় পরিচালনার বাস্তব প্রশিক্ষণ হয়ে যায় একটি মহৎ কাজের সাথে জড়িত থেকে।
চট্টগ্রামের এই মহতী ও উদ্যমী উদ্যোক্তাকে আমরা এবার সম্মানিত করেছি চট্টগ্রামেরই প্রাত:স্মরণীয় উদ্যোক্তা ইউসুফ চৌধুরীর নামে ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা ২০১৭-এ।
মনজুরুল হক এবং তাঁর সকল উদ্যমী কর্মকাণ্ডের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
[চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেন এই লেখাটি লিখেছেন। ছবি – L’fotto]