দুর্নীতিতে ‘হাতেখড়ি’ হয় কীভাবে
একটি দামী হীরা পাহারা দেওয়ার বন্দোবস্ত কঠিন। কয়েক তরফের পাহারা। তার ওপরে সিসি ক্যামেরা। দরজা দিয়ে ঢোকার উপায় নেই। কিন্তু একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে, ছাদসংলগ্ন। সেটা দিয়েই ‘নায়ক’ একদিন ঠিকই সেখানে ঢুকে পড়লেন। দড়ি দড়া দিয়ে নেমে এসে প্রথমে সিসি ক্যামেরার লেন্স বরাবর ঐ ঘরের একটা ছবি তুললেন পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে। তারপর ক্যামেরার সামনে ছবিটা ঝুলিয়ে দিলেন। তো, নায়ক এরপর নির্বিবাদে নিচে নেমে হীরাখন্ড নিয়ে কেটে পড়লেন আবারও ঘুলগুলি দিয়ে। এদিকে কন্ট্রোল রুমে সিসি ক্যামেরায় যারা নজর রাখে তারা কেউ খেয়াল করেনি যে সিসি ক্যামেরা আসলে একটি ‘ছবি’ দেখাচ্ছে। যখন তারা সেটি বুঝতে পারে ততোক্ষণে নায়ক পগারপাড়। বলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “শালিমার’-এর এই দৃশ্যের কথাই আমার কয়েকদিন ধরে মনে পড়ছে। কারণ এমন কিছু আমরা দেখেছি গত কয়েকমাস ধরে।
করোনার ছোবলে শিক্ষা প্রতিস্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে মার্চ মাস থেকে। সেই সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আমাদের বিভিন্ন মেধাভিত্তিক অলিম্পিয়াডগুলো। পরে সেই অলিম্পিয়াডগুলোর অনেকগুলো হয়েছে অনলাইনে, জুম প্ল্যাটফর্মে। বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারীদের অলিম্পিয়াড চলাকালীন সময়ে কাজ করতে হয়েছে জুমে সংযুক্ত হয়ে। তাদের কর্মকান্ড সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের বাংলাদেশের আসর হয়েছে ঢাকায় ‘প্রথম আলো’র কার্যালয়ে। সেখানেও ক্যামেরা দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত থাকতে হয়েছে রাশিয়ায় আয়োজকদের সঙ্গে। এর আগে দেশে ডাচ বাংলা ব্যাংক – প্রথম আলো গণিত উৎসবের সব পর্ব হয়েছে অনলাইনে।
রোবট অলিম্পিয়াড করার সময় টের পাওয়া গেল একজন অংশগ্রহণকারী তার সকল কর্মকান্ড আগেই ভিডিও করে রেখেছে এবং যখন আমরা যুক্ত হয়েছি তখন ভিডিওটা চালু করে দিয়েছে!!! দীর্ঘক্ষণ পরে আমরা সেটি আবিস্কার করতে পেরেছি। আমি ভাবছি, ঐ শিশুটি কি নিজেই এই কাজটি করছে কারও সহায়তা ছাড়া? গত অক্টোবর মাসে একটি অনলাইন কুইজে হাজির থেকেছি। সেখানেও দেখলাম পাশে থেকে কেউ একজন উত্তর বলে দিয়েছেন।
এরও আগে এবছর যখন ঠিক হলো আমরা অনলাইনে গণিত অলিম্পিয়াড করবো তখন দলে দলে লোক আমাদের বলতে লাগলন – কীভাবে চুরি ঠেকাবেন? বই দেখে করবে তো? গুগল সার্চ দিবে!
এগুলো আমরা জানতাম। আর অনলাইন পরীক্ষা তো আসলে ওপেন বুক পরীক্ষা। এখানে এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। সবার জন্য একই সিস্টেম। প্রশ্নটাই এমন থাকে যেন যারা বই দেখে বা নিজে ইন্টারনেট সার্চ করে উত্তর দিতে চায় তারা সময়ের কাছে হেরে যায়।
কিন্তু পরের ব্লো-টা ছিল মারাত্মক। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করলেন – বাবা-মা কিংবা বড় ভাই-বোন করে দেবে, “অমুকের” বড় ভাইরা করে দিবে তো!
আমরা একটু থমকেছি। আমার মনে পড়ল ইউরোপের একটি দেশে মেট্রোতে ঢোকা বা বের হওয়ার সময় টিকেট চেক করে না। ঐ দেশটা খুবই গরীব কিন্তু একজন লোকও পাওয়া যায় না যে কি না ভাবে, “কাছেই তো যাচ্ছি। টিকেট করার দরকার কী।”
একবার আমাদের এক লোক তাদের এক লোককে জিঙ্গাষা করেছিল – আচ্ছা, এই যে কোনো চেকিং নাই। তাহলে বিনা টিকেটের যাত্রীদের কেমনে ঠেকান আপনারা?
ঐ বিদেশী তখন বলেন, “বিনা টিকেটে কেন ট্রেনে উঠবে? ট্রেনে উঠতে তো টিকেট করতে হয়”।
আমরা একটু ভাবলাম। অনলাইনে পরীক্ষা হলে তো এটা তো বন্ধ করা যাবে না। অনেকই সাহায্য নিয়ে উত্তর দিয়ে দেবে? কী করা যায়? আমরা তাই অন্য রাস্তা ধরলাম। শুধু গণিত নয় সাম্প্রতিককালে যতো অনলাইন কুইজ, অলিম্পিয়াড আমরা করেছি সেখানে আমরা ইচ্ছে করে কিছু প্রবলেম/কুইজ দিয়ে দিয়েছি যা ঐ ক্যাটাগরির একজন শিক্ষার্থী কখনই সমাধান/উত্তর করতে পারবে না। যেমন প্রাথমিক ক্যাটাগরির একটা প্রশ্ন থাকলো দশম শ্রেণি থেকে। জানা কথা এটি কেউ করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ‘বেশ কিছু শিক্ষার্থী’ এই সব প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিয়ে ফেলেছে।
আমাদের নিজেদের জানাশোনা থেকেও আমরা দেখেছি অনেক অভিভাবক সন্তানের হয়ে এরকম প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেন, অঙ্ক করে দেন কিংবা রোবট বানানোর জন্য ‘প্রাইভেট টিউটর’কে নিয়ে আসেন। যেহেতু এগুলো প্রমাণ করার সুনির্দিষ্ট তরিকা নেই, কাজে তারা পুরস্কারও পেয়ে যায়। সন্তানের ‘সাফল্যে’ উদ্ভাসিত বাবা-মা গৌরবের সঙ্গেই সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করেন।
কিন্তু এতে কী লাভ? এই সব হতভাগাদের কী হবে ? কেমন করে তারা জীবন যুদ্ধে আগাবে? যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের জীবনে এই কাজটা করে দিচ্ছেন তারা কী জানেন ঐ সন্তান একদিন তাঁকে অভিশাপ দেবে!
এই দেশটা বড় দুর্ভাগা দেশ। ছোটবেলা থেকে পদে পদে মুখস্ত করিয়ে আমরা যত্রতত্র থুথু ফেলা বন্ধ করতে পারি না, শ্রমের মর্যাদা রচনা লিখি কিন্তু বিশ্বাস করি না আর যখন পড়ি ‘অনেস্টি ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি’ তখন তো জেনেই যাই যে দেয়ার আর আদার পলিসি টু।
[৭ নভেম্বর ২০২০ প্রথম আলোতে প্রকাশিত]