এক লক্ষ নয়, এক টাকা চাই!
কেউ যেন একচেটিয়া বাণিজ্য করতে না পারে, সে জন্য আমেরিকার সরকার ও আদালত মাঝেমধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়। গেল শতকের আশির দশকে তেমন একটি নির্দেশনার ফলে সেই সময়কার কম্পিউটার তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আইবিএমকে তাদের নতুন পারসোনাল কম্পিটউারের জন্য অপারেটিং সিস্টেম বানানোর কাজটা ছেড়ে দিতে হয়। আইবিএম এক লাখ ডলারের বিনিময়ে কাজটা দেয় তিন তরুণের একটি প্রতিষ্ঠানকে। তিন তরুণের দলটি সর্বশেষ যেদিন তাদের অপারেটিং সিস্টেমের নমুনা আইবিএমকে দেখায় সেদিনই আইবিএম তাদের কার্যাদেশ দেবে বলে ঠিক করে। তিন তরুণের মধ্যে সবচেয়ে হালকা-পাতলা গড়নের চশমা পরা তরুণটি জানাল, কন্ট্রাকে তার একটা ছোট পরিবর্তন দরকার। তাদের এক লাখ ডলারের দরকার নেই, প্রতিটি কম্পিউটারে মাত্র এক ডলার দিলেই চলবে!
এক লাখ ডলারের পরিবর্তে মাত্র এক ডলারের দাবিদার এই তরুণটির নাম উইলিয়াম গেটস, বিল গেটস নামেই তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের বিল গেটস কেমন করে জানতেন যে মাত্র এক ডলার পেলেই তিনি বছরে মিলিয়ন ডলার কামাতে পারবেন? গেটস কী ভবিষ্যত্ দেখতে পান?
১৯৭৩ সালে বিল আমেরিকার একটি শহরের লেকসাইড স্কুল থেকে তাঁর হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, তিনি সেই সময়কার স্যাট (স্কলটিক অপটিচিউট টেস্ট) পরীক্ষায় সম্ভাব্য ১৬০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১৫৯০ নম্বর পান! কাজেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানে তাঁর স্কুলের সহপাঠী পল এলেনও তাঁর সঙ্গী হয়। স্কুলে পড়ার সময় থেকে বিলের মূল আগ্রহ ছিল তথাকথিত ‘আউটবই’ পড়া। নানা বিষয়ে পড়ার পাশাপাশি ইলেকট্রনিকসে তাঁদের আগ্রহ থিতু হয় এবং সেটা কম্পিউটারেও গড়ায়। বিলের পড়ার আগ্রহ তাই ইলেকট্রনিকসের সার্কিট হয়ে ঝুঁকে পড়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সোর্স কোডে। পল আর বিল তখন অনেক অনেক ‘প্রোগ্রামিং কোড’ পড়েছেন। এই সময় ১৯৭৫ সালে ইন্টেলের মাইক্রো চিপস ৮০৮০ ভিত্তিক এমআইটিএস আলটেয়ায় ৮৮০০ প্রথম বাজারে আসে। এই খবর বিল ও পলকে আলোড়িত করে।
ব্যাপক পড়াশোনা ও অনুসন্ধিত্সু মন নিয়ে যখন পত্রিকায় প্রচ্ছদে বিল আলটেয়ারের দিকে তাকান, তখন সেখানে তিনি দেখেন সম্ভাবনার স্ফুরণ। বাবা-মাকে পটিয়ে বিল হার্ভার্ডের পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বন্ধু পলকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট। কাজের পাশাপাশি যা কিছু পড়ে ফেলার অভ্যাস, সেটি পত্রিকা, ম্যাগাজিন কিংবা বই যাই হোক না কেন, বিলের সামনে এক নতুন জগত্ উন্মোচিত করে। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হয়ে যায় সুদূরে। আইবিএম অফিসে বসে তাই তিনি পারসোনাল কম্পিউটারের অনন্ত যাত্রার খোঁজ সহজে পেয়ে যান।
বিল এখন মাইক্রোসফটে সে অর্থে বেশি সময় দেন না। এখন তাঁর বেশির ভাগ সময় কাটে বিল মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কাজে, আর নিজের ব্লগে (http://www.thegatesnotes.com/) লিখে। তাঁর ব্লগে গেলেই সবচেয়ে বেশি যা চোখে পড়বে, তা হলো তাঁর পড়ার অভ্যাস। সেখানে বই(Book) নামে একটি আলাদা বিভাগও (http://www.thegatesnotes.com/Books) রয়েছে। শিক্ষা, দারিদ্র্য, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য—তাঁর কাজ আর পড়ার মূল বিষয় হলেও ছোটবেলা থেকে ‘যা কিছু পাওয়া যায়’ সেটি পড়ার অভ্যাস তিনি এখনো ধরে রেখেছেন। কেবল পড়া নয়, পছন্দের বইটি তাঁর পাঠকরাও যেন পড়তে পারেন সে জন্য নিয়মিত তাঁর বই পড়ার অভিজ্ঞতা তিনি শেয়ার করেন।
বই পড়ার অভ্যাস তাই কেবল কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবেরেরও এক নম্বর হবি হচ্ছে বইপড়া। আব্রাহাম লিংকন, ওয়ারেন বাফেট, টমাস আলভা এডিসন কিংবা মহাত্মা গান্ধী—সবারই জেগে থাকা সময়ের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়েছে বই পড়ে। ব্যতিক্রম আমাদের দেশেও নেই!
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কথাই ধরা যাক! আমাদের অভিভাবকসম দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রকৌশলী এবং শিক্ষাবিদ পড়েন আর পড়েন। সেই মধ্য পঞ্চাশে এসএসসি পরীক্ষায় পর প্রতিদিনই তিনি সদ্য চালু হওয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন ঢাবি লাইব্রেরি) সকালে চলে যেতেন, দুপুরে বাসায় খেতে এসে আবার লাইব্রেরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত। ছোটবেলা থেকে যেকোনো বিষয়ের বই পড়তেন, কোনো বাছবিচার ছিল না। সেই সময়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরে ‘আউটবই’ পড়ার ব্যাপারে অনেক পরিবারে আপত্তি থাকলেও স্যারের বাবাও তাঁকে অনেক বই এনে দিতেন। ‘দুনিয়ার আজব কাহিনী’ দিয়ে স্যারের আউটবই পড়া শুরু। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় পরে ফেলেছেন “দস্যু মোহন” সিরিজের একশ বই। বুয়েটে পড়ার সময় প্রতিদিন ক্লাস থেকে চলে যেতেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে, কোনো কোনো দিন ইউএসআইডি লাইব্রেরি। নিউমার্কেটে সন্ধ্যায় গিয়ে নলেজ হোমে পড়ে ফেলতেন কোন না কোন বই!
সব সময় বই পড়ার জগতে থাকার এই অভ্যাস স্যারের এখনো রয়েছে। তবে, সময়ের কারণে প্রায়ই বই জমে যায়। এ মুহূর্তে প্রায় গোটা দশেক বই পড়তে হবে তালিকায় রয়েছে। তরুণদের জন্য স্যারের আপ্তবাক্য—‘পড়ার সময় এখনই। বিষয় নিয়ে ভাবার দরকার নেই। শুধু পড়তে থাকো।’
বর্তমানে মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আতাউল করিম মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় বড় হয়েছেন। স্যারের স্কুলে কোনো বসার বেঞ্চ ছিল না। কিন্তু আতাউল করিমের পড়ার চাপে সে স্কুলে একটি পাঠাগার চালু করতে হয়েছিল। মৌলভীবাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার সময় স্যারের কাপড়-চোপড়ের বাক্সের চেয়ে বইয়ের পেটলাটা অনেক বড় ছিল!
বিজ্ঞানী কিংবা ধনকুবের, প্রোগ্রামার কিংবা প্রকৌশলী, ব্যাংকার কিংবা প্রকৌশলী—পৃথিবীর প্রায় সব সফল মানুষের মধ্যে একটাই সহজ মিল, তাঁরা সবাই বই পড়তেন, পড়ছেন এবং ভবিষ্যতে পড়বেন।
যে অন্তর্দৃষ্টির জন্য বিল গেটস কম্পিউটারের ভবিষ্যত্ দেখতে পান, জামিলুর রেজা চৌধুরী হয়ে ওঠেন অগ্রগণ্য প্রকৌশলী, আতাউল করিম তৈরি করেন ম্যাগলেভ ট্রেন—সে অন্তর্দৃষ্টির পুরোটাই তৈরি হয় বই পড়ার মাধ্যমে। বই পড়া আমাদের যে শক্তি দেয়, সেটি বদলে দিতে পারে এই দুনিয়াকে। এই জন্যই মাও সে তুং বলে গেছেন—পড়, পড় এবং পড়।
[সম্পাদিত অংশ ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ে পাতায়]
11 Replies to “এক লক্ষ নয়, এক টাকা চাই!”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
চমৎকার লিখা স্যার। পড়া ব্যাপারটাযে এতটা আকর্ষণীয় তা মাঝে মাঝে কিছু লিখা পড়লে মনে হয়। আপনাদের লিখা যে বই পড়ার ক্ষেত্রে কতটুকু উৎসাহ যোগায় তা বলে বোঝানো সম্ভব না। 🙂
Thank you sir for the great post. learning so much
মুনির ভাইয়ের এমন লেখাগুলো আমাকে খুব অনূপ্রাণিত করে। সময় করে তাই এমন লেখাগুলো আমি পড়ে ফেলি। আমি বিশ্বাস করি ‘বই পড়া আমাদের যে শক্তি দেয়, সেটি বদলে দিতে পারে এই দুনিয়াকে।’
বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর ফিরিশতা জিবরাঈলের মাধ্যমে রাসুলের (সাঃ) কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ যে বাণীটি প্রেরণ করেছিলেন তা ছিল, ‘ইক্বরা’ অর্থাৎ ‘পড়’।
“পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন
সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।
পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু,
যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন,
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।”
– সূরা ‘আল-আলাক (৯৬)’, আয়াত ১-৫ [http://alquranu.com/96/1]
I have been truly inspired by reading this article. I have almost lost the habit of reading out-book but this writing again remembers me to go through numerous books whatever may be the subject. Thank you Sir.
Marvelous.
Would be nice if it would have an english version. I could share with my team.
this if very motivated story . Thanks again Munir bhai for shearing this article
Oshadharon Munir Bhai. Lekhata khub bhalo laglo. Thanks
স্যার, লেখাটা সত্যি অনেক অনুপ্রেরনা দিলো। একটা মানুষের তার স্বপ্নের প্রতি কতটা বিশ্বাস থাকলে সে হার্ভার্ডের পড়াশোনা ছেড়ে তার স্বপ্নের জন্য পা বাড়ান সেটার একটি বড় দৃষ্টান্ত। একজন মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় কঠাটি অনেকবার প্রমানিত।