প্রাথমিক গণিত -১ : গরুর হাটে গুনাগুনি
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ -এটি একটি অংক বিষয়ক পোস্ট। প্রথমিক গণিত নিয়ে শিক্ষক ডট কমের জন্য একটা কোর্স ডিজাইনের কাজ শেষ করেছি। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যে এটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং আগামী সপ্তাহ থেকে কোর্সটি চালু করতে পারবো। কোর্সটি আসলে কেমন হবে সেটা এখনো আমি ঠিক করতে পারি নাই, মানে কীভাবে পড়াবো সেটা। তবে কী পড়াবো তার একটা লিস্ট করেছি। সেটা ধরে আগাবো। কোর্সটা ক্লাস ফাইভের বাচ্চাদের জন্য। বড়দের জন্য নয়। তবে, আরো ছোটরাও এটা করতে পারবে। প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ক্লাস নেওয়ার ইচ্ছা। আর কয়েকটা ক্লাস পরে একটা হ্যাংআউট। কোর্স ডিজাইনের ফাঁকে মনে হল একটা লেখা শেয়ার করা যায়। তাই এই পোস্ট ]
কোরবানির ঈদ এলেই রুবাইয়ের একটি বিশেষ প্রতীক্ষা শুরু হয়—কোরবানির পশুর হাটে যাওয়া! ওর কাছ থেকে শুনে শুনে বিদুষীরও হাটে যাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে; যদিও সে জানে, পশুর হাটে মেয়েদের যাওয়ার তেমন রেওয়াজ নেই। ফলে প্রতিবারই ভাইয়ের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে আর টেলিভিশনে ছবি দেখে তাকে খুশি থাকতে হয়। সেবার হাটে যাওয়ার আগের দিন আমি শুনি তাদের ভাইবোনের কথোপকথন।
বিদুষী বলল, ‘আচ্ছা ভাইয়া, হাটে মোট কতটি গরু উঠেছে, তা গোনার সবচেয়ে সহজ উপায় কী?’
বোনের প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে রুবাই বলল, ‘আরে, এটা তো খুবই সহজ। হাটে গিয়ে প্রথমে একজন সব কটি গরুর পা গুনে ফেলবে। তারপর সেটাকে ৪ দিয়ে ভাগ করলেই মোট গরুর সংখ্যা পাওয়া যাবে!’
আমি যে তাদের কাছাকাছি উপস্থিত হয়েছি, সেটা রুবাই খেয়াল করেনি। আমার অট্টহাসি শুনে ছোট্ট বিদুষী বুঝে ফেলেছে, তার ভাই তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! সে ঠোঁট উল্টে ‘তোমাকে জিজ্ঞেস করাই আমার ভুল হয়েছে’ বলে আমার দিকে প্রশ্নবোধক মুখে তাকাল।
‘গতবার আমরা যে হাটে গিয়েছি, সেখানে গরুগুলো সুশৃঙ্খলভাবে বাঁধা ছিল না। তাই হিসাব করাটা মুশকিল। তবে যদি কোথাও গরুগুলো সারিবদ্ধভাবে থাকে, তা হলে সারির সংখ্যাকে প্রতি সারিতে গরুর সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে মোট গরুর সংখ্যা পাওয়া যাবে, যদি প্রতি সারিতে গরুর সংখ্যা সমান হয়।’ আমি ভাইবোনকে বলার চেষ্টা করলাম।
‘সেটা মোটেই হয় না, বাবা,’ রুবাই বলল। ‘প্রতি সারিতে সমানসংখ্যক গরু থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই একটি সারির গরুর সংখ্যা গুনলে কোনো লাভ নেই।’
হুঁ। এটা একটা সমস্যা বটে। আমি জানালাম, এসব ক্ষেত্রে গণিতবিদেরা পরিসংখ্যানের নিয়ম প্রয়োগ করে একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করেন। এ জন্য তাঁরা প্রথমে প্রতি সারিতে কয়টা গরু, তার একটা হিসাব করেন। এটা করার জন্য প্রথমে কয়েকটা সারির গরুর সংখ্যা বের করে তার গড় বের করা হয়। ধরা যাক, ৫ অথবা ৭টি সারিতে গরুর সংখ্যা গুনে সেটিকে প্রযোজ্য ৫ বা ৭ দিয়ে ভাগ করে প্রতিটি সারিতে গরুর একটা গড় সংখ্যা পাওয়া যায়। তারপর সেই গড় সংখ্যা ব্যবহার করে মোট গরুর সংখ্যা বের করা যায়।
ওদের বোঝানোর জন্য আমি প্রথম আলোর কোনো একটি খবরে মোট কতটি শব্দ আছে, সেটা বের করতে বললাম। টেবিল থেকে পত্রিকা নিয়ে বিদুষী কী সব হিসাব করে জানাল, ওই নিবন্ধে শব্দসংখ্যা ৮০০-এর মতো। কারণ, ওর গোনা ৯ লাইনে শব্দসংখ্যা ৩৬। তার মানে প্রতি লাইনে গড় শব্দ ৪টি। তা হলে ২০১ লাইনের নিবন্ধে শব্দ হবে কম-বেশি ৮০০। আমাকে এ কথা বলে তারপর সে পুরোটা গুনতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণ পরে আমাকে জানাল, ওই নিবন্ধে ৭৯৩টি শব্দ আছে! আমাদের বাবা-মেয়ের এই গোনাগুনির মধ্যে আমি খেয়াল করলাম, রুবাই তার ল্যাপটপ অন করেছে। আমাদের গুনতি শেষে দেখলাম, ও মিটিমিটি হাসে। জানাল, ইন্টারনেট সংস্করণ থেকে নিবন্ধটি কপি করে কম্পিউটারে দেখেছে। ওখানে শব্দ রয়েছে ৭৯২টি!
‘কিন্তু আমার তো গুণ করতে বেশি ভালো লাগে না, বাবা।’ বিদুষী বলল, ‘আমাকে নামতা জানতে হয়।’
আমি জানালাম, কিছু কিছু বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক বড় গুণ সহজে করা যায়। যেমন, কোনো সংখ্যাকে ৯৯ দিয়ে গুণ করার সহজ বুদ্ধি হলো, ওই সংখ্যার শেষে দুটো শূন্য যোগ করে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায়, তা থেকে ওই সংখ্যাকে একবার বিয়োগ করা। যেমন ৭৯৩-কে ৯৯ দিয়ে গুণ করলে গুণফল হবে = (৭৯৩০০-৭৯৩) = ৭৮৫০৭! এই পদ্ধতিকে বলা হয় চলিত নিয়মে গুণ করা! বিদুষীকে দেখলাম কয়েকটা গুণ করতে।
২৫ দিয়ে গুণ করার একটি সহজ পদ্ধতি আমি জানি। জানাল রুবাই। এটি হলো ভাগ করা পদ্ধতি। আমাদের উৎসুক দৃষ্টি দেখে রুবাই ব্যাখ্যা করল।
যে সংখ্যাকে ২৫ দিয়ে গুণ করতে হবে, সেটিকে ৪ দিয়ে ভাগ করতে হবে। তা শেষে যদি ১ অবশিষ্ট থাকে, তা হলে ভাগফলের শেষে ২৫, ২ অবশিষ্ট থাকলে ৫০ এবং ৩ অবশিষ্ট থাকলে ৭৫ লিখতে হবে। আর অবশিষ্ট না থাকলে ০০ বসালেই উত্তর পাওয়া যাবে।
বিদুষী চট করে কয়েকটা গুণ করে ফেলল। দেখলো সেটা ঠিকই আছে।
বিদুষী বলল, ‘আচ্ছা, এই ৯৯ আর ২৫-এর গুণফলটা ঠিক হচ্ছে কেন? এটা কী একটু ব্যাখ্যা করবে?’
আমি বললাম, ‘সেটা তোমরা দুই ভাইবোন একটু মাথা খাটালেই বের করতে পারবে। আমি খালি বলে রাখি, এই দুটি গুণের পদ্ধতির মধ্যে একটি চমৎকার মিল আছে। দুটোই চলিত নিয়মেই হয়েছে!’
রুবাই ও বিদুষীর সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়ারাও এই গুণ কেন সঠিক, তা বের করতে থাকুক। আমি বরং এই বেলা গরুর হাটে যাই!
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
পাদটীকা: গরুর হাটে ঢোকার মুখে রুবাই আমাকে বলল, পুরো হাটে কোনো সারির ব্যাপার দেখা যাচ্ছে না। যেনতেনভাবে বেচাকেনা হচ্ছে। হাসতে হাসতে ও বলল—
গরুর হাটে গরুর সংখ্যা গুনতে আমায় কহ যে
গরুর হাটে কত্ত গরু যায় না গোনা সহজে!
2 Replies to “প্রাথমিক গণিত -১ : গরুর হাটে গুনাগুনি”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
স্যার, আমি ১৬০ কে ১৫ দ্বারা ভাগ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি| প্রথমে ১৬ এর মধ্যে ১৫ এক বার যায়| বিয়োগ করার পর নিচে ১ থাকে এবং ০ নামানোর পর ১০ হয়, যা ১৫ এর চেয়ে ছোট| তাই আরেকটা ০ নিলে ভাগফলের জায়গায় দশমিক দিতে হবে না? কিন্তু ভাগফল সঠিক নির্ণয় করতে পারছিনা| স্যার একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
Thank you sir…