প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : গণিতের প্রস্তুতি -১
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় ৩০ বছরের। গেল শতকের আশির দশকের শেষ দিকে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (তখন ৩৬০০০+) সমূহে সহায়তা করার জন্য ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। শুরুতে তাদের একটি অদ্ভুত শর্ত ছিল – সরকারি প্রাইমারিতে সকল শিক্ষককে মহিলা হতে হবে। সে সময়ে সরকারের একটি চাকরিতে এরকম একটি শর্ত মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। আলাপ আলোচনা শেষে দাড়ালো – মহিলা কোটা ৬০%, পোষ্য কোটা ২০% এবং অবশিষ্ট পুরুষ। সে সময় দেশে উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের সংখ্যা আহামরি ছিল না। আর যারা ছিল তারাই বা কেন প্রাইমারির শিক্ষক হয়ে গ্রামে থাকবেন? এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রাইমারির অনেক শিক্ষকেরই অনেক বড় ডিগ্রী নেই। তাদের আছে সার্টিফিকেট ইন টিচিং। কাজে এখানেও সেরকম একটা কিছুর আশায় মেয়েদের জন্য যোগ্যতা করা হলো এসএসসি! আর এসব নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিধিমালা-১৯৯১ প্রকাশ হয় ১৯৯১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে।
তারপর শুরু হয় প্রথম নিয়োগ প্রক্রিয়া। সে সময় আমাদের সরকারি স্কুল ছিল – ১ শিক্ষক, ২-শিক্ষক, ৩-শিক্ষক এবং ৩-এর অধিক শিক্ষক বিশিষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় একটি নিয়োগ শাখা খোলা হল এবং ঠিক হলো কোটামেনে নিয়োগের এই কার্যক্রম ম্যানুয়ালি করার চেয়ে কম্পিউটারে করা ঠিক হবে।
কাজে অধিদপ্তর যোগাযোগ করলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। ততোদিনে পাশ করে আমি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টার যোগদান করেছি। এ জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে আমার সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের সম্পর্ক। পরে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকের পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণের কাজ বুয়েটে হয়েছে। এই সময় আমি আমার জীবনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি। দুটোই ছিল বিজনেজ প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারি (BPR)-এর। দুটো’তেই আমরা দারুন ভাবে সফল হয়েছিলাম। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। অন্য কোথাও এই গল্প করা যাবে।
সেই সময়ে ১০+ নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ করে আমি দেখেছি নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যবধান গড়ে দেয় গণিত। কারণ ইংরেজি হরে দরে সবাই সমান। সেই সময় আমরা গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি নাই। কাজে তলিয়ে দেখার অভ্যাস হয়নি। কিন্তু ডেটা দেখতাম। যেহেতু রিটেনের খাতা দেখা হতো বুয়েটে, কাজে প্রায়শ সেখানে বসে থাকতাম। এবং দেখতাম কীভাবে সহজ অঙ্ক সবাই ভুল করে!
সবই ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে সরকারি প্রাথমকি বিদ্যালয়ে গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে গণিত শিক্ষা প্রচলনের পাইলট ও স্কেলআপ প্রজেক্ট করতে গিয়ে আবার প্রাইমারি গণিতে ফিরতে হয়েছে। ২০২০ সালে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির গণিতের ভিডিও ক্লাশও করাতে হয়েছে। এসবের পাশাপাশি নতুন কারিকুলাম প্রণয়ণেও যুক্ত থেকেছি।
সামারী হলো ২০২১ এর শেষের দিকে প্রাইমারি গণিত কার্যক্রমের আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর সকাল রায়, আহমেদ শাহরিয়ার শুভ, শাকুর ও মাহতাব একদিন জানালো প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের যে পরীক্ষা হয় সেখানকার গণিত অংশ নিয়ে তারা কিছু কাজ করতে চায়। কাজে আবার আমার সবকিছু মনে পড়লো।
প্রথমে একটা সিচুয়েশন এনালিসিস দাঁড় করালাম।
১. প্রাথমিক নিয়োগ পরীক্ষায় অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থী আশানুরূপ সাফল্য লাভ করে না কারণ গণিত অংশে ভালো করতে না পারা।
২. গণিতে ভালো করতে না পারার প্রধানতম কারণ হল, চাকরি পরীক্ষায় আসা গণিতের বিষয়গুলোর উপর স্বচ্ছ ধারণা না থাকা এবং পর্যাপ্ত অনুশীলনের অভাব।
৩.যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় গণিতে ভালো করার প্রধান কয়েকটি শর্ত হলো, কনসেপ্ট, এফিসিয়েন্সি ও একুরেসি। পরীক্ষায় যেসব টপিক থেকে প্রশ্ন আসে সেগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না নিয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞানে উত্তর করলে ভুল হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকে।
৪. যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ‘টাইম ম্যানেজম্যান্ট’ ব্যাপারটাও অত্যন্ত জরুরি। শুধু প্রশ্নের উত্তর জানলেই হচ্ছে না, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর করতে হবে। কাজেই, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সর্বাধিক অঙ্কের সঠিক সমাধান করার একটাই উপায় – প্র্যাক্টিস, প্র্যাক্টিস, প্র্যাক্টিস!
৫. জোর দিতে হবে: বিষয়ভিত্তিক স্বচ্ছ ধারণা রাখা, জটিল সমস্যাগুলো আলাদা করতে শেখা ও অনেক বেশি সমস্যা সমাধান করার উপর।
এনালিসিস করার পর আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় গণিতের নিন্মোক্ত বিষয়গুলো কমবেশি থাকে –
পাটিগণিত (৪৫%-৬০%) – ১. বাস্তব সংখ্যা ২. গড় ৩.ঐকিক নিয়ম ৪. লসাগু-গসাগু ৫.ভগ্নাংশ ৬. অনুপাত, ৭. দুরত্ব গতিবেগ ৮. শতকরা ৯. লাভ ক্ষতি ১০ মুনাফা ও ১১প্যাটার্ন ও অনুক্রম।
বীজগণিত (২৫%-৪০%) : ১. মান নির্ণয়, ২ সূচক ৩. উৎপাদক ৪. সেট ও ৫ সহ সমীকরণ ও দ্বিঘাত সমীকরণ।
জ্যামিতি (১৫%-২০%) ১. সাধারণ জ্যামিতি, ২. ত্রিভুজ, ৩. চতুর্ভুজ ৪. বৃত্ত ও বহুভুজ ও ঘন জ্যামিতি।
তারপর আমরা ভাবলাম, চাকরি প্রত্যাশীদের সহায়তা করার কোন বুদ্ধি আছে কিনা। তবে আমাদের ধারণা ছিল –
ক. এই বিষয়গুলো প্রায় সবারই জানা কারণ এগুলো স্কুলে পড়ে এসেছে,
খ. শুধু মনে করিয়ে দিলেই চলবে।
সেই হিসাবে আমরা একটা পাইলট কোর্স ডিজাইন করি। সিম্পল – ৪ দিনে ২ ঘন্টা করে ৮ ঘন্টায় পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির বিষয়গুরো আলাপ করে একটা করে পরীক্ষা নেওয়া এবং কিছু সলভ শীট দেওয়া।
সেই হিসাবে ডিসেম্বরের ২৫-২৮ এই চারদিন আমাদের অনলাইন কোর্সটা হয়। দেখা গেল এটা ৮ ঘন্টার জায়গায় ২০ ঘন্টা নিতে হয়েছে। আমরা টের পেয়েছি “অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চরচর করে’। দেখা গেল, কিছু বিষয় সহজে মনে পড়লেও অনেক কিছুই স্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। একটা ক্লাশে কিছু কথা বললেই সেটা উদ্ধার হচ্ছে না। রিগোরাস কার্যক্রম দরকার।
সেই কোর্সের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি কয়েক পর্বের এই সিরিজটি লিখতে শুরু করলাম নতুন বছরের প্রথম দিনে। উদ্দেশ্য দুইটা –
১. প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার গণিতের প্রস্তুতির ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা, এবং
২. যে কোর্সটা আমরা শুরু করেছি সেটাকে পরিমার্জন করে অধিকতর কার্যকর করা।
দেখা যাক কিছু আগানো যায় কিনা।
One Reply to “প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ : গণিতের প্রস্তুতি -১”