ও আমার দেশের মাটি
আজ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সংবাদ সম্মেলন ছিল। উদ্দেশ্য থাইল্যান্ডের চিয়াংমাইতে অনুষ্ঠেয় ৫৬ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশে দলের শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়। প্রতিবছর এই সময়টাতে আমরা এই কাজটা করি। এখন এটা রেওয়াজ।
প্রথমবার ২০০৫ সারে আমরা শুরু করেছিলাম। সেই সময় আমরা গণিত অলিম্পিয়াডে নানানকিছু করার চেষ্টা করতাম। কী করলে খবরটা সবার কাছে পৌছাবে সেটা ভাবতাম। তাছাড়া একটা দু:খও ছিল। প্রথম আলো আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের স্পন্সর বলে অন্য কোন পত্রিকা এই খবর ছাপে না। কিন্তু আমি নিশ্চিত এটা হকি বা ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হলে নিউজ ঠিকই ছাপা হতো। আমরা এখনো খেলাধুলা ছাড়া অন্য কোথাও গোষ্ঠী স্বার্তের উর্ধে যাইনি। সে যাকগে, উদ্দেশ্য থাকে জামিরুর রেজা স্যার সবার সঙ্গে আমাদের খুদে গণিতবিদদের পরিচয় করিয়ে দেবেন।
এই নিয়ে ১১ বার হল। দলে কোন মেয়ে নাই এই নিয়ে সামান্য দু:খ ছাড়া বাকী সবই আনন্দের। এবারের দলে আছে – সিলেটের আসিফ, ময়মনসিংহের আদিব ও সানজীদ, সিরাজগঞ্জের তুর্য, ঢাকার সাব্বির এবং বরিশালের নেয়ামুল। বরিশালের নেয়ামুলের যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দেশের সব বিভাগ থেকে বাংলাদেশ দলে গণিতবিদের জায়গা হল। বলা যায়, আমরা একটি নতুন মাইলফলকও ছুঁয়েছি।
গণিত অলিম্পিয়াডের কারণে আমাদের একটা বিষয় এখন আর আলাদা করে বলতে হয় না। আমাদের ট্যালেন্টদের সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কথা এবং তারা তাই আছে। কিন্তু প্রচলিত মুখস্তবিদ্যা এবং “অধিক চেষ্টার ফল” যে সিস্টেমে সেখানে ঢাকার ছেলেমেয়েরাই ভাল করে। কারণ তারা চর্চ্চার সুযোগ পাচ্ছে বেশি।
২০০৫ সালে আমাদের ৬ জন মিলে ৩ নম্বর পেয়েছিল। ভাগ্যিস তখন ফেসবুক ছিল না আজকের মত। থাকলে বাংলাদেশ গণিতদল আর কখনো আইএমওতে যেতে পারতো কী না সন্দেহ আছে। সে সময় অনেকগুলো নিউজ-ডিসকাশন লিস্ট ছিল। বেশিরবাগ গুলোতেই আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করা হয়েছিল। এরকম কিছু ই-মেইল ডিসকাশন আমি দভর্ঘদিন রেখে দিয়েছিলাম। কারণ সেগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতো। সে সময় বেশিরভাগ কাজ আমাকে একাই করতে হত। এরকম সুসংবদ্ধ টিম ছিল না। খাতা দেখার সমন্বয় থেকে মঞ্ঞির অনুষ্ঠান সবই করা লাগতো। জাফর স্যার, কায়কোবাদ স্যার, গৌরাঙ্গ স্যারও সবকিছু সামাল দিতেন। প্রতিবছর মাইক্রোবাসে এক শহর তেকে অন্য শহরে যাবার পথে হতো আমাদের যত পরিকল্পনা।
আজ অনুষ্ঠানের আগে জামিল স্যার আলাপ করছিলেন গ্রীসের কথা। বলছিলেন গ্রীসের সঙ্গে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের একটা সম্পর্ক আছে। ২০০৪ সালে গ্রিস হয়েছিল ৪৫তম আইএমও। আমি গিয়েছিলাম সেখানে অবজার্ভার হিসাবে। যাতে পরের বছর আমরাটিম পাঠাতে পারি।
অজারভার হিসাবে আমার কাজ ছিল- পদ্ধতি জানা, অন্য দেশগুলো কেমন করে প্রিপারেশন নেয় সেটা সম্পর্কে জানা এবং আমাদের আগ্রহের কথা আইএমওকে জানানো। আমি অনেক কিছু গুছিযে নিয়ে গিয়েছিলাম। একটা ফর্মাল আবেদন, একটা প্রেজেন্টেশন এবং প্রথম আলোর একটা বিশেষ সংখ্যা। বাংলা পত্রিকাটিকে আমি ডেলফির কনফারেন্স সেন্টারের দেওয়ালে লাগিয়ে দেই। সব দেশের লিডাররা আমার কাছে জানতে চাইতো এটা কি। আমি বলতাম মাত্র ৪৪ ডিগ্রী তাপমাত্রায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বাংলাদেশে গণিত উৎসবে যোগ দেয়। ওরা গণিতের আনন্দের সন্ধান করে।
জামিল স্যার রেগুলার ফোন করতেন। যদি দেখা যায় আমাদের ফুল মেম্বারশীপ হচ্ছে না তাহলে স্যারও রওনা দেবেন। যেদিন জনের সঙ্গে আমার ফাইনাল কথা হল সেদিন বুজলাম স্যারের না গেলেও হবে। ডেলফি হচ্ছে গ্রীস সভ্যতার সবচেয়ে বেশি স্মৃতি যেখানে আছে সেই শহর। আমার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল। (সে অন্য গল্প)। গ্রিস থেকে আমমি কয়েকটা বিষয় শিখে এসেছিলাম যার একটা হল হাততালি আর একটা হল এই কথাটা – প্রতিযোগিতায় কেও হারে কেও যেতে কিন্তু উৎসবে বিজীয় হয় সবাই। প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিকের বিজয়ীদের পাতার মুকুট পড়িয়ে দেওয়া হতো। ২০০৪ সালের গণিত অলিম্পিয়াডে সব গণিতবিদকে সেরকম পাতার মুকুট পড়িয়ে দেওয়া হবে।
পরের বছর আমরা টিম নিয়ে গেলাম মেক্সিকো এবং তারপর থেকে এখনও যাচ্ছি। তখন আমার চুল কালো ছিল এখন বেশিরভাগ শাদা। আমি নিজেই জানি আমি বুড়িয়ে গেছি। তবে, আল্লাহর কাছে হাজার শোকর যে, আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে গেছে। আমরা না থাকলেও সেটি এখন নিজে নিজে চলতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ।
আজ মুনিবুর রহমান স্যার মেক্সিকোর কথাও মনে করিয়ে দিলেন। আমরা পড়েছিলাম হারিকেন এমিলির পাল্লায়। পরে সেটি অবশ্য আর হারিকেন থাকেনি কুপীতে পরিণত হয়েছিল! সেখানকার হারিকেনের সময় প্রস্তুতি দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম। এমন হারিকেন আমাদের এখানে পান্তাভাতের মত!
গণিত অলিম্পয়াডকে আমরা প্রতিযোগিতার বৃত্ত থেকে বের করে উৎসবে পরিণত করেছি। এটি পৃথিবীর কোথাও হয়নি। অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিবছর ৫ লক্ষ ছেলে-মেয়ে তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম পর্বের লড়াই-এ যোগ দেয়। এটি একটা স্কুলের পরীক্ষার মতই। এর পরের পর্বৗ গুলো্এ তাই। পরে ওরা ন্যাশনাল একজায়গায় পরীক্ষা দেয়।
আমাদের তো মাত্র ১১ তম আর শুরু ২০০৩ থেকে। অন্যদিকে এমন দেশ আছে যেখানে গণিত অলিম্পিয়াড হচ্ছে ১২০ বছর ধরে!!! ভাবা যায়? গণিতের ব্যাপারটি সেসব দেশে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হযেছে। পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই ছেরে-মেয়েরা হয় গণিত করে নাহয় দাবা খেলে কিংবা প্রোগ্রামিং করে। এগুলো তাদের সংস্কৃতির অংশ। আমরা এখনো গণিতকেই পুরোপুরি সন্নিবেশ করতে পারি নি।
তবে, সত্য হলো, আমাদের স্বীকৃতি অনেক। বাংলাদেশ সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১ -এ বলা হযেছে গণিত অলিম্পিয়াডের মত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। আমি নিজে অশোকা ফেলো হয়েছি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক বিশ্বব্যাপী সামাজিক উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটা বই লিখেছেন, পাঠ্য পুস্তক। সেখানে আমার কেস স্টাডি ছাপা হয়েছে, আমার দুইটা ছবিও ছাপা হয়েছে!!! যদিও কাজটা আমি একা করিনি। আমি এমন একদল লোকের ছায়া পেয়েছি যারা আমাকে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। যে কারণে আমিও কাজ ছেড়ে দিতে পছন্দ করি। স্যারদের কাছ থেকেই শেখা।
গণিত দলের জন্য আমার নিজের পরবর্তী লক্ষ্যের বছর ২০১৮। সেটা এর আগেও হতে পারে। ততদিন পর্যন্তই আমার বাঁচার শখ আছে। কারণটা ছোট। গণিত অলিম্পিয়াডকে ঘিরে আমাদের বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা, ঘটনা আমরা সবার সঙ্গে শেয়ার করি। কিন্তু প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের, যেটি সিলেটেও হয়েছিল সেটির একটি ঘটনা আমরা কাউকে বলি না। সেই ঘটনাটা আমরা (আমি আর ইয়াসমীন ম্যাডাম) ঘটা করে প্রকাশ করবো আমাদের পরবর্তী মাইলস্টোন পূরণ হওয়ার পর।
ততদিন পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজতে রাখুন।