ডিভিডি ভাড়া থেকে ২২০ বিলিয়ন ডলার

Spread the love

১৯৯০ এর দশকে আমি বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারে (এখন যেটি আইআইসিটি) প্রোগ্রামারের চাকরি করতাম। সেখানে আমাদের একটা কাজ ছিল বিটিসিএলের টেলেক্স বিল প্রসেস করা। কয়েকটা ম্যাগনেটিক টেপ আসতো। সেগুলো আমরা প্রসেস করতাম। এরকম একটা টেপে ৭০ মেগাবাইট ডেটা থাকতো। সে সময় আমাদের মধ্যে একটা চালু জোক ছিল – ৭০ এমবি বুয়েট থেকে গুলিস্তানে টেলেক্স এক্সচেঞ্জ কীভাবে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি পাঠানো যায়?
উত্তর হল – টেপটা হাতে নিয়ে একটা রিক্সা দিয়ে গুলিস্তান চলে যাওয়া!!!
ইন্টারনেটের স্পীড এমনই ছিল!

এই কথা মনে পড়লো আজ নেটফ্লিক্স নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে। নেটফ্লিক্সের দুই সহ-প্রতিস্ঠাতা তাদের প্রতিস্ঠান শুরুর নানা গল্প বলে যান। এর মধ্যে রীড হাস্টলিং বার্সেলোনায় ওয়ার্ল্ড মোবাইল কংগ্রেসে বলেন তিনি একটি স্টেশন ওয়াগন গাড়ি যা কিনা ম্যাগনেটিক টেপ বহন করে সেটির ব্যাডউয়িডথ ক্যাপাসিটি সম্পর্কে জানতে পারেন। একজন গণিতবিদ নাকি এই অঙ্ক করে দেখান। এই ঘটনা থেকে রীড নাকি চিন্তা করেন একটি ডিভিডি কতো ডেটা ধারণ করতে পারে এবং একটা ডিভিডি পাঠাতে পারলেই কতো ডেটা পাঠিয়ে দেওয়া যায়। পরে তিনি ভেবেছেন ইন্টারনেট নিশ্চয়ই আরো দ্রুত পাঠাতে পারবেন।

তবে রীডের এই গল্পের চেয়ে এপোলো-১৩ গল্প বেশি আলোচনা পেয়েছে। এটা হলো তখনকার দিনে লোকে সিনেমার ডিভিডি ভাড়া করতো ব্লকব্লাস্টার নামে একটি ভিডিওর দোকান থেকে। আমাদের দেশে যেমনটা ছিল সেরকম। তবে, ব্লকব্লাস্টার অনেক বড় ব্যাপার ছিল সেই সময়ে। বিশ্বজুড়ে তাদের ডিভিডির দোকান ছিল। সেখানে নির্ধারিত সময়ে ডিভিডি ফেরৎ না দিলে জরিমানা হতো। রীডের কথিত গল্প হলো এপোলো-১৩ সিনেমার ডিভিডি ফেরৎ দিতে দেরি হওয়ায় তার ৪০ ডলার ফাইন হয়। তখন রেগেমেগে তিনি নেটফ্লিক্সের জন্ম দেন।

তবে, তার এই দুই গল্পই নাকচ করে দিয়েছেন নেটফ্লিক্সের আর একজন সহ-প্রতিস্ঠাতা মার্ক রেন্ডলফ। মার্ক নেটফ্লিক্সের জন্ম ও বিকাশ নিয়ে “That will never work” নামে একটা বই লিখেছেন ২০১৯ সালে। সেখানে তিনি বলেছেন – গল্প হিসাবে দুটোই রোমান্টিক তবে সত্য নয়। বরং তিনি তার বই শুরু করেছেন দুই সহ-প্রতিস্ঠাতার অফিসে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে। নেটফ্লিক্সের জন্মের ১৫ মাস আগে থেকে তিনি তার বই-এর গল্প শুরু করেছেন।

মূল গল্পে যাওয়ার আগে  আমরা বরং এই দুই প্রতিস্ঠাতাকে একটু চিনে নেই। রীড হাস্টলিং ১৯৮৩ সালে বিএ এবং ১৯৮৮ সালে এমএসসি পাশ করেন। স্ট্যানফোর্ডে তার এমএসসির বিষয় বস্তু ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (৩২ বছর আগে কিন্তু)। বোঝা যাচ্ছে উনি লাগাতার পড়েননি। বিএ পাশ করে তিনি শান্তি মিশনে চলে যান সোয়াজিল্যান্ডে। সেখানে তিনি একটা হাই স্কুলে অঙ্ক করাতেন। ১৯৯১ সালে তিনি পিওর সফটওয়্যার নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করেন। ১৯৯৫ সালে কোম্পানিটি শেয়ার বাজারে যায় এবং ১৯৯৭ সালে রেশন্যাল সফটওয়্যার সেটিকে কিনে নেয়।

অন্যদিকে মার্ক রেন্ডলফ পড়েছেন ভূতত্ত্বে। তারপর তিনি বেশ কিছু প্রতিস্ঠান তৈরি করেছেন যার সঙ্গে ডাকযোগে মালামাল বিক্রি করার সম্পর্ক ছিল। নেটফ্লিক্সের আগে মার্কের ৬টা স্টার্টআপের অভিজ্ঞতা আছে।

তারপর তাদের পরিচয় হয়। কীভাবে?

রীড মার্কের কোম্পানি কিনে নেয় এবং কেনার পরে মার্ককে কোম্পানির মার্কেটিং-এর ভিপি হিসেবে রেখে দেয়। এরপর একদিন সাড়ে পাঁচ ঘন্টার একটা বিমান সফর তারা একসঙ্গে করে। তখনই মার্ক খেয়াল করে রীডের ব্যবসা বোঝা এবং ব্যবসা এনালিসিস করার ক্ষমতা অসাধারণ। এর কিছুদিন পরই যথারীতি মার্কের মনে হয় নতুন একটা কোম্পানি করা দরকার। সেটা ১৯৯৭ সাল।

তো, এই সময় তারা দুইজন যেহেতু একই অফিসে যেতেন কাজে তারা গাড়ি শেয়ার করতেন। একদিন রীডের টয়োটা এভালন গাড়িতে আর একদিন মার্কের ভলভো গাড়িতে। মার্ক জানিয়েছেন প্রতিদিনের এই সফরে তিনি একটি নতুন আইডিয়া বলতেন আর রীড সেটি নাকচ করতেন এই বলে, দ্যাট উইল নেভার ওয়ার্ক। তবে, আলোচনাটা এখানেই শেষ হতো না। কারণ মার্ক যথেষ্ট পড়াশোনা করেই একটি প্ল্যান বলতেন। কিন্তু রীডের থট প্রসেস ছিল যথেষ্ঠ ফার্স্ট। ফলে তিনি নানা প্রশ্ন করতেন। এবং নাকচ করতেন।
মার্ক চাইতেন রীড তার সঙ্গে নতুন প্রজেক্টে বিনিয়োগকারী বা পার্টনার হিসাবে থাকুক। কাজে তাকে কনভিন্স করা দরকার। দুজনের মধ্যে একটাই মিল ছিল সেটি হচ্ছে যাই করা হোক না কেন সেটা অবশ্যই ইন্টারনেট ভিত্তিক হতে হবে।

এরকম অনেক ভাবনাচিন্তার ময়না তদন্তের পর তারা ঠিক করলেন তারা ইন্টারনেটে ডিভিডি ভাড়া দেবেন। কারণ হলো লোকে সিনেমা দেখে। যদিও সব জায়গাতেই ব্লকব্লাস্টারের দোকান রয়েছে। এগুলো ডাকযোগে পাঠানো যায় কারণ ভাঙ্গবে না। তারপরও তারা দুজনের বাসার ঠিকানায় দুটি সিডি মেইল করে দেখলেন সেগুলো ঠিক থাকে কিনা। তারপরই তারা কোম্পানি খুলতে স্থির করলেন।

নাম দেওয়ার সময় তাদের চিন্তা ছিল সহজ। যেহেতু ইন্টানরনেট কাজে ‘নেট’ আর সিনেমা বা ফ্লিম থেকে ফ্লিক্স! নেটফ্লিক্স। সিম্পল। ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে আত্মপ্রকাশ করলো নুতন একটা কোম্পানি।

এমন কোম্পানি যেখান থেকে আপনি ডিভিডি ভাড়া করতে পারবেন। ওদের ওয়েবসাইটে গিয়ে লোকে অর্ডার দিবেন, ওরা একটা খামে করে আপনাকে ডিভিডি পাঠায় দেবে। খামের মধ্যে নেটফ্লিক্সের ঠিকানা সম্বলিত একটা খামও থাকে। তারমানে হলো আপনার দেখা হয়ে গেলে আপনি আবার ফেরৎ পোস্ট করে দেবেন ডিভিডিটা। ভাড়া কমবেশি ৪ ডলার আর পোস্টাল চার্জ ২ ডলার। সুবিধা হচ্ছে, আপনি যতদিন খুশি বাসায় এটা রেখে যতোবার খুশি দেখতে পারবেন। এটা একটি বড় সুবিধা কারণ ব্লকব্লাস্টার বা সেরকম দোকান থেকে ভাড়া করলে একটা নির্দির্স্ট সময় পর্যন্ত দেখতে পারতেন। কিন্তু তারচেয়ে বেশি হলে লেইট ফী বা জরিমানা দেওয়া লাগতো। এখানে শুধু একটাই নিয়ম। আগেরটা ফেরৎ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন একটা নিতে পারবেন না।  এই সময় কয়েকজন কর্মী ও ১০০০ টাইটেল তাদের ছিল। আর শুরু করার জন্য ২.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেন রীড। দুজনেরই মাথার মধ্যে কিন্তু অ্যামাজনের চিন্তা ছিল। তারা দুজনেই অ্যামাজনের বই-এর মতো মতো একটি নিশ খুঁজে নিতে চেয়েছেন।

আগস্টে কোম্পানি চালু করার পরের বছর ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে নেটফ্লিক্সের ডিভিডি পাঠানো শুরু হয়। দিন যেতে থাকে, তাদের ব্যবসাও বাড়তে থাকে। এই সময়ে তারা ভাবেন ব্যবসার মডেল পরিবর্তন করবেন। তারা প্রতি ডিভিডি ভাড়ার পরিবর্তে গ্রাহক পদ্ধতি প্রচলন করলেন। মানে হলো আপনি এবার মাসে একটা ফী দিয়ে সারা মাসে যতো খুশি সিনেমা দেখতে পারবেন। এ হচ্ছে পেটচুক্তি খাওয়ার মতো মাসচুক্তি সিনেমা দেখা। রীড আর মার্ক দুজনেই এই নতুন ব্যবসা মডেলে খুশি হলেন। তারপর থেকে তাদের গ্রাহক সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এই সময তারা জেফ বেজোসের সঙ্গে দেখা করে নেটফ্লিক্স কিনে নিতে তাকে অনুরোধ করেন। জেফ “১৪-১৬ মিলিয়ন ডলার” দিতে রাজি হলেন। মার্কের কাছে এটা যথেষ্ট মনে হলেও রীড কিন্তু রাজি হলেন না। ফিরে এসে তারা তাদের ব্যবসা বাড়াতে মনোযোগ দিলেন।
এই সময় তাদের মনে হলো ব্লকব্লাস্টারের সঙ্গে ঝগড়া করে কী লাভ। বরং তাদের সঙ্গে পার্টনারশীপ করা যাক। ২০০০ সালে রীড প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। নেটফ্লিক্সের জন্য তিনি চাইলেন ৫০ মিলিয়ন ডলার। বিনিময়ে ব্লকব্লাস্টারের অনলাইন হওয়ার কাজটা নেটফ্লিক্স টিম করে দিবে। প্রস্তাব শুনে তির্যক হাসি দিলেন ব্লকব্লাস্টারের সিইও। মিলন হলো না। ২০০২ সালে ছয় লক্ষ গ্রাহক নিয়ে শেয়ার বাজারে চলে আসে নেটফ্লিক্স। ১৫ ডলারে ৫৫ লক্ষ শেয়ার ছাড়ে তারা। বছর শেষে তাদের গ্রাহক হয় সাগে আটলাখ। তারপর থেকে তাদের গ্রাহক একটা গতিতে বাড়তেই থাকে। পরের বছর ১০ লক্ষ, ২০০৫ সালে ৫০ লক্ষ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে তারা স্ট্রিমিয় সার্ভিস চালু করে “ওয়াচ নাউ” নামে।

এখন ইন্টারনেট ব্যান্ডউয়িডথের ১৫% নেটফ্লিক্স খায়। ১৯০টি দেশের ১৫ কোটির বেশি গ্রাহক রয়েছে তাদের। এই লেখা লেখার সময় তাদের মার্কেটি ক্যাপিটাল হলো মাত্র ২২০ বিলিয়ন ডলার।

(নেটফ্লিক্স নিয়ে আমি একটা ডিটেইল কেস স্টাডি লিখছি যেখানে ক্লকব্লাস্টারের সঙ্গে নেটফ্লিক্সের বিরোধ ও জয়, স্ট্রিমিং সার্ভিসে আসা এবং সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবসায় উদ্ভাবনী অংশ চালু রাখাকে আমার মতো করে দেখবো। আল্লাহ ভরসা।)

One Reply to “ডিভিডি ভাড়া থেকে ২২০ বিলিয়ন ডলার”

Leave a Reply