শুভ জন্মদিন জাফর ইকবাল স্যার
আজ থেকে প্রায় ৩৫-৩৬ বছর আগে, আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন গ্রোগ্রাসে বই পড়তাম। আমাদের বাসার সবটা জুড়ে থাকতো বই। আমার দাদা শিক্ষক, আমার মাও। আবার বাবা শিক্ষকতা করতেন, পরে ব্যাংকার হয়েছিলেন। কাজে গল্পের বই পড়ার জন্য আমাদের বাসায় কেও কোনদিন বকা দিত না। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দমেলা আমরা কয়েক সংখ্যা পর পর বাঁধাই করে রাখতাম। আর যেখানে যত বই পাওয়া যেত সবই পড়তাম।
সেরকম কোন এক বছরে নীল রঙ্গের কভারের একটা বই আমি হাতে পাই। বইয়ের প্রচ্ছদে কয়েকটি ছেলেমেয়ের ছবি। তবে, তাদের মধ্যে একজনের শার্টের হাতাটা ঝোলানো। ঝামেলাটা বোঝা যায়। এর আগেই আমার হাকলবেরি ফিন আর টম সয়্যারকে চেনা হয়ে গেছে। কুয়াশা আর মাসুদ রানাও নিত্য সঙ্গী। ব্যোমকেশ আর কিরিটি রায় থেকে শুরু করে শঙ্কু আর গোগল পাশে থাকে। তবে, অপারেশন কাঁকনপুর আর চিতা রহস্যের পর বাংলাদেশের কোন লেখকের কোন লেখা পড়ে তেমন আমোদিত হইনি। উত্তেজিতও না।
নীল মলাটের বইটা পড়তে বসে কেমন যেন মোহের মধ্যে পড়ে গেলাম। মনে আছে সেদিন আর স্কুলের পড়া নিয়ে বসা হয়নি। এবং এর পরের কয়েকদিনও না। কারণ প্রায় প্রতিদিনই বইটি উল্টেপাল্টে দেখতাম। আর ভাবতাম আহা আমরাও যদি এমন একটা দল বানাতে পারতাম। নিজেদের আঙুল ফুড়ে রক্ত বের করে শপথ নিতাম!
পরের বছরগুলোতে আন্দরকিল্লার রাজাপুকুর লেনের যে অংশটায় আমরা থাকতাম সেখানে ডাব-নারিকেল কিংবা কলা বাগানের কলা চুরি করাতে ঐ বইটা যে প্রবল উৎসাহ যোগাতো সেটা না হয় নাই বলি।
যারা বোঝে তারা বুঝেছে আমি কোন বই-এর কথা বলছি। “হাতকাটা রবিন”। রবিনকে বনধুরা বলতো “হাকারবিন”।
বাংলাদেশের কিশোর এডভেঞ্চারের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন একজন নতুন লেখক। লেখকের নাম আমি আগে আর শুনি নাই। তবে, হাকারবিনের পর যখন বন্ধুদের কাছে লেখকের আর কোন বই-এর খবর কেও জানে কিনা জানতে গেলাম – তখন জানলাম ঐ লেখক আসলে কল্পবিজ্ঞানের লেখক। খুঁজে পেতে যোগার করলাম – কপোট্রনিক সুখ দু:খ।
সেই ছোটবেলা থেকেই মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার অন্যতম প্রিয় লেখক। তখন কি কখনো ভেবেছি একদিন এই প্রিয় লেখকের খুব কাছে আসতো পারবো?
২.
২০০০ সালের কোন এক শুক্রবার সকাল। আমি তখন ২৭৫ এলিফেন্ট রোডে থাকি। সকালবেলাতে হাজির হয়েছেন কায়কোবাদ স্যার। আমরা জানি কোথায় যাবো। তো, গাড়ি নিয়ে বের হব। স্যার বললেন – বনানী ডিওএইচএস আমি চিনি কিনা।
চিনবো না, আবার। এলিফেন্ট রোডের আগে তো আমি ওখানেই থাকতাম। কিন্তু ওখানে কেন যাবো?
স্যার বললেন- আগে চলেন।
আমি আর কায়কোবাদ স্যার একটা চার/পাঁচতলা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম। গাড়ি পার্ক করে আমি আর স্যার সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। বেল বাজানোর পর দরজা খুলে কে যেন বললো – ও, আপনি! ভেতরে আসেন।
কায়কোবাদ স্যার বললেন– আমার সঙ্গে মুনির হাসান আছে।
এটা বলতে বলতে আমি ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়ালাম। এবং তারপর আমি জমে গেলাম! মনে হয় কয়েক শতাব্দী আমার পা জোড়া মেঝের সঙ্গে লেপ্টে থাকলো। কারণ ততক্ষণে আমি বাড়ির লোকটিকে দেখে ফেলেছি। এই কয় বছর তাঁর এত ছবি দেখেছি যে আমার চেনাতে কোন ভুল হয়নি।
আমি আমার প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সামনে দাড়িয়ে আছি!!!
৩.
কায়কোবাদ স্যারের সঙ্গে সেদিন জাফর স্যারের বাসাতে গিয়েছিলাম আমরা গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে আলাপ করতে। কায়কোবাদ স্যার কেন আমাকে যাবার আগ পর্যন্ত তাঁর গন্তব্য বলেন নাই সেটা আমি ঠিক জানি না। তবে, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের যে কয়টা দিন তার একটি ঔ শুক্রবার। আমাদের তিন ‘ম’-এর একত্র হওয়ার পরের ঘটনাটা এখন সবাই জানে। এর একটি ফসল হল বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড।
২০০০ সাল থেকে জাফর স্যারের সঙ্গে আমার একটা অত্যন্ত আপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমি স্যারকে পেয়েছি একাধারে শিক্ষক এবং গাইড হিসাবে। কেবল গণিত অলিম্পিয়াড নয়, আমার যত ধরণের উদ্ভট আইডিয়া মাথায় আসে তার সবই প্রথম স্যারকে শুনতে হয়। স্যার কখনো থামিয়ে দেন না। শুনে তারপর বলেন।
স্যারের কাছ থেকে আমার সবচেয়ে বেশি শেখা হচ্ছে – প্ল্যান এ, বি, সি। বেশিরভাগ সময়ই কেমনে কেমনে জানি আমাদের প্ল্যান সি কার্যকর করার প্রয়োজন হয় না। আর সারাক্ষণ হাসি ধরে রাখা।
স্যার মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন কেমন সেটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাংলাদেশে আমি। আমার মত একজন অলস লোককে গণিত অলিম্পিয়াডে নামিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব যে তিনজন মানুষের তাদের একজন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার।
গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিকে স্যার সব আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে যেতেন। কায়কোবাদ স্যারও। কখনো মাইক্রোবাসে, কখনো ট্রেনে করে সারাদেশ চষে বেড়ানোর সময় আমরা স্যারের আশ্চর্য সাহচর্য পেয়েছি। তাঁর গল্প শুনেছি, স্বপ্নের কথাগুলো জেনেছি। সেগুলোর কিছু কিছু লিখলেও তা হবে এক মহাকাব্য। হয়তো কোন একদিন লিখবো।
আজ ২৩ ডিসেম্বর স্যারের জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন স্যার।
আরো অনেকদিন আমাদের মাথার ছায়া হয়ে থাকুন।
8 Replies to “শুভ জন্মদিন জাফর ইকবাল স্যার”