ময়াল-১০
১০.
চোখ খুলেই জাহিরা বুজতে পারলো ঠিক সময়েই ঘুমটা ভেঙ্গেছে। পাসের সিটে ফুফু ঘুমাচ্ছে। বাইরে একটু একটু আলো ফুটে উঠেছে। এ জায়গাটা জাহিরা ভালই চেনে। বাঁকটা ঘুরলেই সমুদ্র দেখা যাবে। ভোরের আলো ফোটার সময় কলাতলীর এখানটাতে এক আশ্চর্য অনুভূতি হয় জাহিরার। কেবল কি ওর একার হয়?
বছরের এই সময়টাতে কক্সবাজারে খুব বেশি পর্যটকের আশা নাই। সোহাগ পরিবহনের এই গাড়িতেও কয়েকটা আসন খালি। আগের সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে যখন কক্সবাজার আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই মনে হয়েছে ভাল সিট পাওয়া যাবে। ওর পছন্দের সামনের সিট দুটোই পেয়েছে ফুপু-ভাইঝি।
বাঁকটা ঘুরতে ঘুরতে আড় চোখে দেখলো চোখ খুলেছে ফুফু। “কিরে এসে গেছি?”
“হু”। দৃষ্টির সীমানায় সমুদ্র এসে গেছে জাহিরার। কথা বলার মুড নেই। এই জায়গাটা এখনই অতিক্রম করে যাবে বাস। দূর থেকে বর্যার সমুদ্র দেখার আনন্দই আলাদা। তবে একটু পরেই চোখের আড়াল হয়ে গেল সমুদ্র। রাস্তা আর সমুদ্রের মাঝখানে অনেক হোটেল উঠে পড়েছে। সোহানার কাছে আজকাল কক্সবাজারকে ঘিঞ্জি মন হয়। তবে, জাহিরা বললেই এসে পড়ে। কক্সবাজারে সোহানার অনেক স্মৃতি।
ফুফু-বোনঝি নেমে একটা ইজি বাইক নিয়ে কল্লোলে এসে পড়লো। রিসেপশনে নাম আর পতি্রকার নাম বলতেই ৬০৮ নম্বর রুমের চাবি পাওয়া গেল। সঙ্গে একটা নোট।
“জাহিরা আপা, আপনারা রেস্ট নেন। ব্রেকফাস্ট করে নিয়েন। আমি ১০টার সময় আসবো। – কুদ্দুস”
কুদ্দুস জাহিরাদের পত্রিকার কক্সবাজার প্রতিনিধি। হোটেলের এরেঞ্জমেন্টা তারই করা। সব সময় সেই করে।
ব্যাগ কাধে নিয়ে রুমে ঢুকেই বিছানায় ঝাপিয়ে পড়লো জাহিরা, জামা জুতা না খুলেই।
“আরে করিস কি। জুতাটা অনন্ত খোল”।
ফুফুর কথা কে শোনে। “আমাকে ৯টার আগে ডাকবা না”।
পাগল মেয়ে। সোহানা ভাবে। বড় ভাই-এর এই মেয়েটার মধ্যে ভাবীর ছবি দেখে সোহানা। ওদের বাড়িতে যখন আসে তখন জাহিরার মতোই কি বয়স ছিল? বিছানায় বসে জাহিরার পা থেকে জুতা জোড়া খুলে দিল। তারপর চাদরটা টেনে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল সোহানা।
কল্লোলের এই রুমটার সঙ্গে একটা বারান্দা আছে যেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এখন আর ঘুম আসবে না। তার চেয়ে বরং স্নিগ্ধ হাওয়ায় মন ভাসানো যাক।
৪ ঘন্টা পরের কথা। নতুন সূর্যের কক্সবাজার অফিসে কুদ্দুস ভাই-এর রুমে বসে আছে সোহানা আর জাহিরা। জাহিরার নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রানার অবস্থা কাহিল।
“যে নতুন দ্বীপটার কথা জেলেরা বলে সেখানে কী আছে?”
“এটাই তো আশ্চর্য। ওখানে এখনো কেউ যেতে পারছে বলে মনে হয় না। বেশিরভাগ জেলের বক্তব্য হলো ট্রলার নিয়ে ঐ দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই সমুদ্রে ঢেউ বেড়ে যায়। মনে হয় যেন কেউ তাদের তাড়িয়ে দিতে চায়”।
মানে কী? ফুফু-ভাইঝির প্রশ্ন।
যা জানা গেল তাতে প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া গেল না। কিছুদিন ধরে কয়েকজন জেলে লক্ষ করেছে ছেড়াদ্বীপের পরেও আর একটা ছোট মতো দ্বীপ আছে। তবে, দ্বীপটা যে আছেই এমন কথা অবশ্য সবাই হলফ করে বলতে পারে না। এমনকী জেলেদের কাছ থেকে শোনার পর দুইদিন রানাও ছেড়াদ্বীপ পার হয়ে গেছে তবে তার চোখে কোন দ্বীপ চোখে পড়ে নি। কিন্তু যে জেলেরা দ্বীপটা দেখেছে তারা সবাই হলফ করে বলেছে যে দ্বীপটা আছে। তবে, সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে গতকাল এক জেলের কথা। সে দাবী করেছে সে ভোর বেলা দ্বীপটা দেখেছে এবং তার চোখের সামনেই সেটা আস্তে আস্তে পানিতে তলিয়ে গেছে যে খবর রানা জাহিরাকে দিয়েছে।
“ধুর। একটা আস্ত দ্বীপ কীভাবে তলিয়ে যাবে। আপনি বলার পর আমি আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কাল কোন অস্বাভাবিক জোয়ার ছিল না”। জানালো জাহিরা।
কী জানি। আমিও এখানে কথা বলেছি। তবে, আমার মনে হয় আপনি নিজে ঐ জেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
“আমি আর যাবো না, তোরা যা। আমি বরং পাশের মার্কেটে যাই”।
“হুম। তাহলে তো আমি রানা ভাই-এর পছেন বসে চলে যেতে পারবো”। বলে ঝটপট হাতের ক্যামেরাটা নিয়ে বের হয়ে গেল জাহিরা। তার পিছু পিছু রানা।
অফিসটা দোতলায়। নিচে নেমে মোটর বাইকে রানার পেছনে উঠতে যাবে এমন সময় কানে এলো নিজের নাম।
“জাহিরা। আপনি এখানে?”
ইনস্পেক্টর তারিক। এ ব্যাটার সঙ্গে প্রায়শ দেখা হয়ে যাচ্ছে।
একটু স্মিত হেসে জাহিরা জানতে চাইলো, “ ও আপনি। কবে আসছেন? ছুটি কাটাতে?”
“আর আমাদের ছুটি। সেই সাপের কেস নিয়েই আছি। আজ সকালেই এসেছি। আপনি কখন এসেছেন?”
“আমিও সকালে। তবে, বেড়াতে। এখন যাচ্ছি শুটকি পাড়ায়। আমরা উঠেছি কল্লোলে। দেখা হবে”
এটুকু বলে রওনা দিয়ে দিল জাহিরা ও রানা।
ওদের অপসৃয়মান বাইকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তারিকের মনে হলো – কাজটা কী ঠিক হলো।
গত কিছুদিন ধরে জাহিরা পেছনে একটা চর লাগিয়ে রেখেছে তারিক। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভিক্ষুক খুনের একটা কিনারা জাহিরা করতে পারবে। কাজে ওর সঙ্গে লেগে থাকলে ও একটা ক্লু পেতে পারে। কাল রাতে চরের কাছ থেকে খবর পেয়ে তাই শেষ বাসে ও চলে এসেছে কক্সবাজারে।
কিন্তু এখানেই বা কিসের খবর পাওয়া যাবে?