ময়াল…

Spread the love

পরদিন। সকাল ১০টা। জাহিরাকে দেখা গেল সাইকেল চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে। দোয়েল চত্ত্বরের পাশে মোকাররম ভবনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট। সেখানেই বিভাগীয় প্রধানের রুমের সামনে হাটাহাটি করছে সে। এপয়ন্টমেন্ট করেই এসেছে। তবে, একটু আগে এসে পড়াতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অপেক্ষমান কক্ষে অনেক ছবি ঝুলানো। বেশিরভাগই ছেলেদের ছবি। তবে, একটি ছবি একটু ব্যতিক্রম। ছবিটার সামনে গিয়ে দাড়ালো জাহিরা। যমজ নাকি! দুইটি মেয়ের গাউন পরা ছবি, দুজনের গলায় মেডেল ঝোলানো। হাসি হাসি মুখ।

“আফা, আপনি যান। স্যার ফ্রি হইছে?”

রেজাউল হক আখন্দের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে কেন এসেছে সেটি জানালো সে। বললো একটা ফিচার করছে পত্রিকায়। বিষয়বস্তু জিন গবেষণায় বাংলাদেশের মেয়েরা। বিভাগের মেয়েদের সাফল্য নিয়ে কথা বলতে চায়। রেজাউল হক অনেক বিষয় বললেন। ইন্টারনেটের একটা লিংক দেখালেন যেখানে বাংলাদেশের বায়োটেকনোলজিস্টদের তালিকা পাওয়া যায়। সেখানে অনেক বিজ্ঞানীর নাম রয়েছে। ড. আখন্দ জাহিরাকে সেই লিংকটা লিখে দিলেন।

“আচ্ছা। আপনাদের এখানে কী কখনো দুইজন মেয়ে ছিল যাদের নাম এন দিয়ে শুরু?” প্রশ্ন করতে করতে জাহিরা তার ব্যাকপ্যাক থেকে একটা ফাইল বের করলো। শুরুতেই সুপ্রভার দেওয়া তিনটে পেপারের প্রথমটা।

জাহিরার হাত থেকে ফাইলটা নিতে নিতে ড. আখন্দ বললেন, “নাঈমা আর নায়লার কথা বলছেন?”

“মানে, আমি শুধু আদ্যাক্ষর জানি। দুজনই কি এন চৌধুরী লিখতেন?” জাহিরা জানালো।

“লিখতেন বললেন কেন?” ড. আখন্দ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ‘নাঈমা আর নায়লা মারা গেছে নাকি?”

“না, না। আসলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। এই পেপারটা তো অনেক দিনের পুরানো তাই।” জাহিরা আমতা আমতা করলো।

“ও, আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম্। বলে কী?” তারপর টেবিলে রাখা বেলটা টিপলেন। পিওনটা ঢুকতেই ড. মালিহাকে ডেকে আনতে বললেন ড. আখন্দ।

তারপর জাহিরার দিকে তাকিয়ে বললেন,”ওরা দুই বোন আমাদের ডিপার্টমেন্টের এযাবৎ কালের সেরা ছাত্রী। দুই বোন ভর্তি পরীক্ষায় যুগ্মভাবে ফার্স্ট হয়ে এখানে পড়তে আসে। এবং কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা দুজনের মেধা আর দক্ষতা দেখে অবাক হয়ে যাই। এ যে মালিহা এসে পড়েছে।”

শাড়ীর ওপর একটা শাল জড়ানো এক ভদ্রমহিলা ঢুকলেন রুমে। “বসো এখানে”।

জাহিরার কোনাকুনি চেয়ারে বসলেন ভদ্রমহিলা, মালিহা যার নাম। ড. আখন্দ জাহিরার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জাহিরাই জানালো দেশের মেয়ে বায়োটেকনোলজিস্টদের নিয়ে একটা ফিচার করার ইচ্ছে তার। সেজন্য খোঁজ নিচ্ছে। আর দুজন বিজ্ঞানী যাদের দুজনের নামই এন চৌধুরী, তাদের সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মালিহা ড আখন্দের দিকে তাকালেন। ড. আখন্দ জাহিরাকে বললেন, “নাইমা আর নায়লার ক্লাসমেট মালিহা। সুফিয়া কামাল হলে পাশাপাশি রুমে থাকতা তোমরা তাই না?” শেষ প্রশ্নটা অবশ্য মালিহার উদ্দেশ্যে।
“জি, স্যার। চারবছরই ওরা আমার পাশের রুমে ছিল।” বললো মালিহা। “কিন্তু ওদের কথা কোথা থেকে আসলো। ১০ বছর ধরে ওদের খবরতো কেউ জানে না।”

“১০ বছর ধরে? ওরাও কি হারিয়ে গেছে নাকি?” জাহিরা খুবই অবাক হয়ে গেল।

“না, তা না। ১০ বছর আগে ওরা দুজনই নিউইয়র্কে কোল্ড স্প্রিং হার্বার ল্যাবরেটিরির রিসার্চার পদ থেকে পদত্যাগ করে। তারপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। আপনি কি ওদের কোন খবর পেয়েছেন?” ড. মালিহার ঔৎসুক্য দৃষ্টি জাহিরার দিকে।

জাহিরা জানালো এরকম কিছু সে জানে না। চট্টগ্রামে আবদেল মান্নানের বাসা থেকে সে তিনটি পেপার কপি করে এনেছে। যার একটি পেপার এই দুইজনের লেখা।

“কোন পেপারটা। দেখি তো?”
“ওই সেই গাছের চলাফেরার কারবার। এই পেপারটা আসলে কোন জার্নাল ছাপেনি। সম্ভবত এটি সাতক্ষিরা জার্নালে ছাপা হয়েছে।” জাহিরার ফাইলটা মালিহার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন ড. আখন্দ। কাগজ হাতে নিতে নিতে মালিহা বললেন, “এটা ছোটটার চিন্তা। পড়ার সময় থেকে সে এই চিন্তাটা করতো। তার বক্তব্য ছিল কোন গাছের জিনে যদি কোন প্রাণীর জিন ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে গাছটি চলতে পারবে। উদ্ভট চিন্তা। অনার্সে এই নিয়ে থিসিস করতে চেয়েছিল। আপনারা কেউ রাজী হোননি, স্যার।”

“হ্যা। মনে পড়ছে। পরে ওরা দুইবোন থিসিস করলো ঐ জিন ট্রান্সফার নিয়েই। আর মাস্টার্সর সময়  তো ওদের দুজনকে শামসুল আলম স্যারের আন্ডারে থিসিস করতে পাঠিয়ে দেই আমরা।”

শামসুল আলম স্যার কি এখনো ডিপার্টমেন্টে আছেন?” জানতে চাইলো জাহিরা।

“না, না। স্যার তো অনেক আগেই রিটায়ার করেছেন। এখন ৯০ এরবেশি বয়স। উনি বোটানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ছিলেন। প্ল্যান্ট জেনেটিক্স নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। শুনেছি শুলশানে ছেলের বাসায় থাকেন।” ড. আখন্দ বললেন।

“ওদের রিসার্চের কথা জানতে চাইলে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমার কাছে ওনার নম্বরটা আছে।” বললো মালিহা।
“আচ্ছা। আমি স্যারের কাছে যাবো। কিন্তু রিসার্চ ছাড়াও অন্যান্য বিষয়গুলো, মানে ওরা কেমন ছিল, ফ্যামিলি কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যাবে?” জাহিরার জিঙ্গাস্য।

পরের এক ঘন্টায় নায়লা আর নায়মা সম্পর্কে অনেক তথ্যই পেল জাহিরা। তবে, যে তথ্যটি জাহিদা একদম আশা করেনি তা হলো তাদের সামাজিক অবস্থান। সবাই জানতো ওরা এতিম। সলিমুল্লাহ এতিমখানা থেকেই ওরা এসএসসি পাস করে এবং পরে এক ভদ্রলোক তাদের ঢাকার একটি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়্। “সবার জন্য শিক্ষা” নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি পেয়ে ওরা পড়ালেখা করে বদরুননেসা কলেজে। তারপর ভর্তি পরীক্ষাতে প্রথম হয়। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দুজনই টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালাতো।

“ওদের যাবার কোন জায়গা ছিল না।” মালিহা বললেন, “প্রথম প্রথম ওরা ছুটিতে হলেই থাকতো। পরে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ছুটিতে বিভিন্ন জনের বাড়িতে গিয়েও থেকেছে। নায়লা একবার ছুটিতে কয়েকদিন আমাদের বাসাতেও ছিল।”

ওরা যখন ক্যাম্পাসে পড়তে আসে তখন সবাই দুই বোনকে দেখে চমকে যায়। গড়পড়তা বাঙ্গালি মেয়েদের চেয়ে কমপক্ষে ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম স্বাস্থ্য। সুন্দরী। দেখে মনে হতো না ওরা একটা এতিমখানায় বড় হয়েছে। দুইবোন সেবার মেডিকেল,বুয়েট আর ঢাকা ভার্সিটি – এই তিনটা ভর্তি পরীক্ষাতেই প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছে। মানে এক বোন প্রথম হলে আর এক বোন দ্বিতীয়! “বুয়েট, মেডিকেল বাদ দিয়ে কেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসলো তা নিয়ে শুরুতে আমরাও একটু চিন্তিত ছিলাম।” যোগ দিলেন ড. আখন্দ।

তবে কয়েকদিনের মধ্যে ওদের বাকী গুণগুলোও সবার জনা হয়ে যায়। প্রথম ঝড়টা গেল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির এক বড় মাস্তানের ওপর দিয়ে। ঠিক কী হয়েছে জানা যায়নি কিন্তু একদিন দুপুরে বোনদের একজন মফিজকে মেরে মোটামুটি কার্জন হলের মাঠঠাকে রক্তাক্ত করে দেয়। দোর্দন্ডপ্রতাপ মফিজের সেদিনের মার খাওয়া দেখেছে প্রায় সবাই।পুরো মাঠে তাড়িয়ে বেড়িয়ে মফিজকে মেরেছে নায়লা। পরদিন থেকে মফিজকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ও আর কোনদিন ক্যাম্পাসে আসেও নি!

জাহিরার খুব হাসি পেল। যাক, তখনো তাহলে তারমতো মারকুটে মেয়েরা ছিল!!! “ক্যাম্পাসে কী ওরা খুবই আতংক ছড়াতো”?

“তা না। ওরা এমনিতে খুবই ভদ্র ছিল। কিন্তু আমরা অচিরেই জেনে যাই ওরা দুই বোনই জুডোতে ব্ল্যাকবেল্ট সমতূল্য। যদিও কখনো তাদেরকে আমরা বেল্ট পড়তে দেখি নাই। ভার্সিটির ব্ল্যাক বেল্ট প্রশিক্ষক তাদেরকে ব্ল্যাকবেল্টই বলতো”। বললেন , ড. আখন্দ।

“খেলাধুলাও করতো” যোগ করলো ড. মালিহা। “দুই বোনই ভার্সিটির মেয়েদের হ্যান্ডবল আর ভলিবল দলের মেম্বার ছিল। নায়মা একবার ইউনিভা্সিটির দ্রুততম মানবী হয়েছিল”।

“তোমরা গল্প করো।” – জাহিরা আর মালিহাকে রেখে বের হয়ে গেলেন ড. আখন্দ।

কিছুদিনের মধ্যে ওদের নাম হয়ে যায় এন স্কোয়ার। যমজ বলে ওদের চেহারা এবং গড়ন একেবারেই এক রকম ছিল। পার্থক্য বোঝানোর জন্য নায়লা সবসময় নীল জামাকাপড় পড়তো। নায়মা অবশ্য এরকম কিছু করতো বলে মালিহার মনে পড়ে না।

আরও ঘন্টাখানেক গল্প করার পর ডিপার্টমেন্টের হেডের রুম থেকে বের হরো জাহিরা আর মালিহা। মালিহা জাহিরা এনে দাড় করালো একটি ছবির সামনে। এই ছবিটা আগেই দেখেছে জাহিরা। মেডেল গলায় দুই বোন। এখন ওদের নাম জানে – নায়লা-নায়মা।
“ওদের দুবোনের নম্বরের রেকর্ড এখনো কেই ভাঙ্গতে পারে নি ডিপার্টমেন্টে” – বিদায় জানানোর সময় এ কথাটা বলতে ভুললেন না মালিহা।

৮.

নায়লা-নায়মার সঙ্গে আবদেল মান্নান আর জসির আহমেদের হারিয়ে যাওয়ার কোন সম্পর্ক আছে কী না সেটার কোন কূল কিনারা করা জাহিরার পক্ষে সম্ভব নয়। ছিল সাপের বিষ। তারপর যোগ হলো নিখোঁজ। এখন তার সঙএগ দুই দুইটি যমজ মেয়ের কারবার। সুন্দরী। ব্ল্যাকবেল্ট। কিন্তু ১০ বছর ধরে পাত্তা নাই।
ধুর। তারচেয়ে বরং ফিচার করাই ভাল।

সেদিন রাতের বেলায় সবকিছু সোহানাকে খুলে বলল জাহিরা।

“তো, তুমি যাও না কেন এতিমখানায়। ওদের কোন ঠিকানা আছে কী না, বাবা-মা’র নাম কি এসব জেনে আসো।” পরামর্শ দিল ফুফু।

“তা যাওয়া যায়। কিন্তু তোমার কি মনে হচ্ছে ওদের সঙ্গে আমার কেসের কোন সম্পর্ক আছে”?

“তা বলতে পারবো না। কিন্তু তোর ময়াল সাপের বিষের ব্যাপাটা যদি সত্যি হয তাহলে এন স্কোয়ারের ব্যাপারে তোর খোঁজ নেওয়া উচিৎ। এরকম কোন কিছু থেকে অনেক সময় ভাল ক্লু পাওয়া যায়।

তাই সই। চায় চুমুক দিতে দিতে বললো জাহিরা।

পরের দুইদিন দুইবেলা আজিমপুরের এতিম খানায় গিয়ে জাহিরার খুব বেশি কোন লাভ হলো না। জাহিরাদের পত্রিকাটি যথিষ্ট প্রভাববিস্তার করে। এতিম খানার তত্ত্বাবধায়ক ফাইলপত্র ঘেটে বেশি কিছু জানাতে পারলো না। ভর্তির সময় ওদের নাম ছিল।  নায়মা আর নায়লা। আর ভর্তির ফরমে বাবার নাম ছিল কে. চৌধুরী। পরে ওনারা এসএসসি পরিক্ষার সময় দুজনের নামের শেষ চৌধুরী যুক্ত করে দেয়।

এতিমখানার কর্মচারীরা সবাই ওদের চেনে কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, পড়ার পর আমেরিকায় যাওয়ার আগে দুই বোনই নিয়মিত এতিমখানায় আসতো। গল্প করতো। বাবা-মা সম্পর্কে প্রশ্ন করতো।
সেখানেই জানা গেল, পাশের মাঠে ছেলেদের জুডো প্রশিক্ষণের এক ক্লাব ছিল। সেখানেই দুই বোন জুডো শিখেছে। ওরা ভাল করতো দেখে সুপার বাঁধা দেননি।

৯.

বছরের এই সময়টাতে কক্সবাজারে অনেক লোক থাকে। তবে, আগস্ট মাসকে কখনো পর্যটনের মাস বলা যায় না। যখন তখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে, মাঝে মধ্যে সমৃদ্র উতলা হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও গেল কয়েক বছর ধরে আগস্টে এখানে লোকের সংখ্যা বাড়ছে।

দুপুর ১১টা। আকাশ একটু মেঘলা। কাল থেকে ভ্যাপসা গরমটাও নেই। অনেককে দেখা যাচ্ছে লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জোয়ারের সময় তাই সালামও একটু ঢিল দিয়েছে। ইয়াসির গার্ড হিসাবে সালামের এটি দ্বিতীয় বছর। অনেক ঘটনা এর মধ্যে দেখে ফেলেছে। সেবার একজন…

এ্যা……………

চিৎকার কানে যেতেই সচকিত সালাম। দ্রুত উচু টুল থেকে নেমে পড়েই শব্দের উৎসের থেকে দৌড়। একটি মেয়ে। হাত পা ছুড়ছে আর চিৎকার করছে। আশেপাশ থেকে আরও কয়েকজন তার দিকে সাতার কেটে আগাতে গেল।

সালামের অভিজ্ঞহাত ততক্ষণে ভয়ার্ত মেয়েটার কাছে পৌছে গেছে। একহাত দিয়ে মেয়েটাকে লাইভবেল্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দ্রুত তীরের দিকে রওনা দিল সালাম।

আর ঠিক তখনই ত্বিতীয় চিৎকারটা শুনতে পেল সালাম। এবার কলাতলীর দিক থেকে মনে হল। মেয়েটিকে তীরে নামিয়ে দিয়ে কিছু জিঙ্গাষা করার আগেই আবার দৌড় দিল সালাম। সেজন্য দেখতে পেল না মেয়েটা তার পায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কারণ ওর পায়ের গোাড়ালির কাছের বেশ খানিকটা মাংস নেই এবং সেখান তেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

দ্বিতীয় লোকটির কাছে সালাম পৌছাানোর আগেই অন্য একজন সেখানে পৌছে গেল। আর ঠিক সে সময়ে পুরো সমুদ্রতটে যেন বোমা ফাটলো। গগনবিদারী চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের মধ্যে সব লোক হঠাৎ করে পাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করলো।

ওরে বাবারে বলে দুইজন পাশদিয়ে ছিটকে বের হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে পানি হয়ে গেল ফাঁকা।

লোকেদের দৃষ্টি অনুসরণ করে সালামের চোখে পড়লো একটা রূপালি রেখা। সালামের অভিজ্ঞ চোখ একঝাক মাছকে দেখতে পেল তীরের দিকে এগিয়ে আসতে। এমন দৃশ্য কখনো দেখেনি সে।

মাছের ঝাক তার কাছে এসে পৌঁছানোর একটু আগেই সালামের মন বললো – দৌড়াও।

পরিমরি করে পানি থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দৌড় দিল সে।

 

১ ঘন্টা পর। জেলা প্রশাসনের লোকজন এসেছে। যেখানে সালাম শেষবার দাড়িয়ে ছিল সেখানে অনেক রূপচান্দা মাছ পড়ে আছে। রূপচান্দাই তবে সাধারণ রূপচান্দা থেকে একটু বড়। মুখটা একটু কেমন। কক্সবাজার কলেজের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক তোফাজ্জল সাহেব মাথা নেড়ে এএসপি সাহবেকে বলছেন – না, না, এটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রূপচান্পা। এরকম রূপচান্দা আমি দেখি নাই। এ যে দেখেন মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। দাত দেখে মনে হচ্ছে দাতাল কোন মাছ!

এএসপি মোকাম্মেল হকও দাত দেখছেন। যে কয়জনের সঙ্গে কথা হয়েছে সবাই বলেছে মাছ তাদের আক্রমন করেছে।

সালামের উদ্ধার করা মেয়েটিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটি বলেছে পানিতে থাকতে থাকতে সে হঠাৎ করে খেযাল করে কে যেন তার পায়ে কামড় দিচ্ছে। পানির মধ্যে চোখ দিয়ে সে দেখেছে দুইটা মাছ তার পা কামড়ে ধরেছে!!!

মেয়েটির কথা সত্য বলে মেনে নিচ্ছেন মোকাম্মেল হক। কারণ একই কথা বলেছে অন্তত ১০ জন। সবার বক্তব্য এই মাছের ঝাকটি তাদের কামড়াতে এসেছে। হাঙ্গর মাছ ছাড়া আর কোন মাছ মানুষকে কামড়াতে পারে এটাই তো জানে না মোকাম্মেল।

আপাতত সমুদ্রে কেও যেন নামতে না পারে তার নির্দেশ দিয়ে কয়েকটা মাছ ঢাকায় পাঠানোর কথা বলে নিজের গাড়ির দিকে আগালেন।

“এটা কি হলো মোকাম্মেল ভাই?”

তাকিয়ে দেখলেন কুদ্দুস রানা। কক্সবাজারে সাংবাদিক। নিশ্চয়ই সমুদ্র তটে মাছের আক্রমনের খবর বিম্ববাসী পেয়ে গেছে।

“বুজতে পারছি না। এরকম কোন ব্যাপার আমি কোনদিন শুনি নাই। দেখিও নাই। আপনি তো এখানকারই লোক। দেখেছেন কখনো?”

কুদ্দুস রানা মাথা নাড়লেন। এমন আজব ঘটনা সে দেখে নাই। কতক্ষণ আগে অনলাইনে সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে বলা হয়েছে ঐ সময় কেও মোবাইলে ভিডিও করছিল কি না সেটার খোঁজ নিতে। এএসপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই এটা বুজে রানা এগিয়ে গেলেন একটা জটলার দিকে।

অনেক সময় রানার মাথা একটু আউলা হয়ে যায়। না হলে রানা মনে করে পারতো গতসপ্তাহের জেলে পাড়ার একজনের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। যে খবর সে জাহিরাকে ফোনে বলেছে কিন্তু নিউজ করে নাই। বয়স হচ্ছে মনে হয়!!!

১০.

গুলশানের বাড়িটা লেকের পাড়ে। প্রফেসর শামসুল ইসলামের বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন একটা সমস্যা হলো না জাহিরার। আগের থেকে ঠিক করা ছিল তাই দারোয়ান লিফটের সামনে এনে বললো, “১০-এ উঠে দিড়ি দিয়ে ছাদে ছলে যাবেন. ম্যাডাম। স্যার ছাদেই আছেন এখন”।

ছাদে এসে মনটা ভাল হয়ে গেল জাহিরার। ছাদটাই একটা বাগান। দূর থেকে দেখা গেল একজন বৃদ্ধমতো লোক হাতে একটা নিড়ানি নিয়ে একটা গাছের সামনে দাড়িয়ে আছেন। জাহিরাকে দেখে বললেন, “জাহিরা। আসো এখানে?”

জাহিরা চারিদিকে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল ওদিকে।

কাছে গিয়ে জাহিরা সালাম দিয়ে বললো, “স্যার। ফোনে বলেছি। নায়লা আর নায়মা সম্পর্কে জানতে এসেছি।”

হাতের নিড়ানিটা দিয়ে গাছের গোড়ায় কী জানি করতে করতে বললেন, “ মেয়ে দুটো আসলেই খুব ট্যালেন্টেড ছিল। চার বছরের মধ্যে দুই জনের তিন তিনটা জার্নাল পেপার হয়ে যায়। এমনকী কোন কনফারেন্সে ওরা কিছু পাঠালে সেটা অবশ্যই নির্বাচিত হয়ে যেত”।

কিসের গবেষণা?

নানা কিছু। তবে, বেশিরভাগ কাজই এক জীবের ডিএনএ অন্য জীবে বসানো সংক্রান্ত। মজার ব্যাপার হলো ওদের দুজনেরই চিন্তার একটা বিষয় ছিল – গাছকে চলৎশক্তি দেওয়া যায় কী না। এই নিয়ে দুই বোন তাদের মাস্টার্সের থিসিস করতে চায়। ডিপার্টমেন্ট থেকে তখন আমাকে বলা হয় তাদের কাজটা সুপারভাইজ করতে। আমি রাজী হই। তুমি চলো আমার সঙ্গে।

স্যারের পেছন পেছন জাহিরা নেমে আসলো ১৮ তলায়। দরজা খুলে একটা বড় বসার ঘর। সেটি পেরিয়ে দক্ষিনের দিকে এক বড় রুমে এসে পড়লো দুইজন। জাহিরা টের পেল এটি এই জ্ঞানী লোকটির স্টাডি। রুমজোড়া কয়েকটা বইয়ের থাক। একটা টেবিল আবার একটা ছোট কনফারেন্স টেবিলও। জানালা দিয়ে ঢাকার আকাশ দেখা যায়। অনেক দূরের কেসি টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছে।

ওরা এসে এখানেই আমার সঙ্গে কাজ করতো।

ওদের কাজটা কী ছিল ?

“ওদের একটা অদ্ভুত চিন্তা ছিল। ওরা ভেবেছে যদি কোন উদ্ভিদের জিনে কোন প্রাণির জিন ঢুকিয়ে দেওয়া যায তাহলে সেই গাছটা নড়াচড়া করতে পারবে!!!

কাজটা কী শেষ হয়েছিল?

সে লম্বা গল্প। তোমাকে সবটা শুনতে হবে।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলা প্রফেসর শামসুল ইসলামের পূর্বাচলের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় জাহিরা একবার থামলো।

“স্যার। আমি রেজিস্টার অফিসের ফাইল আর ঐ এতিমখানার ফাইল দুইটাই চেক করেছি। দুই জায়গাতেই ওদের বাবার নাম আছে কে চৌধুরী। আপনি কি এই কে চৌধুরী কে চেনেন?

প্রফেসর আহমাদ শামসুল আলম উদাস হয়ে গেলেন।

Leave a Reply