সিলিকন ভ্যালিতে তারিক আদনানের স্টার্টআপ 

Spread the love

সিলিকন ভ্যালির বাংলাদেশি উদ্যোক্তা তারিক আদনান মুন তার ছয় মাস বয়সী ব্লকচেইন ভিত্তিক স্টার্টআপের জন্য প্রি-সীড বিনিয়োগ পেয়েছেন। তারিকের স্টার্টআপটি কাজ করছে ডিসেন্ট্রলাইজড ফিন্যান্স যা সংক্ষেপে ডিফাই(DeFi) নামে পরিচিত। ব্লকচেইন হলো একটি পরস্পরস্পর্কযুক্ত ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি যেখানে কোন কেন্দ্রীয় তথ্যাধার বা স্টোরেজ সিস্টেম থাকে না। কিন্তু প্রতিটি নোড বা পৃথক স্বত্ত্বা পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তথ্যের যথার্থতা অক্ষুন্ন রাখতে পারে।

তারিক আদনান মুন

এই সিস্টেমের বিকাশের ফলে অনেক ধরনের নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। যেমন ব্যাংক ছাড়াই টাকা ধার দেওয়া-নেওয়ার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে যিনি টাকা ধার দিতে চান এবং যিনি এই টাকা নিয়ে কাজে লাগাতে চান উভয়েই একটি ব্লকচেইন প্লাটফর্মে যোগ দেন। প্ল্যাটফর্মে গ্রহীতা নিজের কোন ডিজিটাল সম্পদ জামানত রেখে দাতার কাছ থেকে টাকা নিতে পারেন। এতে কোন তৃতীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের প্রয়োজন হয় না।
তারিক আদনানের স্টার্টআপ এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ার কাজ করছেন যা বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমাদের প্ল্যাটফর্মটি দাতা-গ্রহীতার আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ করবে” এক ভিডিও আলাপচারিতায় মুন আমাকে বললো। 

প্রি-সীড রাউন্ডের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আছেন পলিগন এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জয়ন্তি কানাই, ড্রাগনফ্লাই ক্যাপিটালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এলেক্স প্যাক, রিভারল্যান্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী রিচার্ড হাকল প্রমূখ। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে সিমা ক্যাপিটাল, ফোর এরো’জ ভেঞ্চার,টাগোমি, টেরা ইকোসিস্টেম ইত্যাদি। 

কোন কোন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান নিজেদের লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে কাজ করতে পছন্দ করে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা মিডিয়া বা প্রকাশ্যে তৎপরতা দেখায় না। এই ধরণের স্টার্টআপকে বলা হয় স্টিলথ (Stealth) স্টার্টআপ। তারিক আদনানের স্টার্টআপটিও তাই। “এরই মধ্যে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম কয়েকবার বদলেছি। কাজেই শেষ পর্যন্ত কোন নামে আমরা আত্মপ্রকাশ করবো তা এই মুহুর্তে সঠিকভাবে বলা মুশ্কিল”  মুনের হাসি। 

কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী থাকাকালীন মুন আমাদের ডাচ বাংলা ব্যাংক – প্রথম আলো গণিত উৎসবে। নিজের মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ২০০৭ সালেই বাংলাদেশ দলে জায়গা করে নেয়। ২০১০ সালে কাজাখস্তানে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে ব্রোঞ্জ পদক বয়ে আনে। পরের বছরেই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যায়। সেখানে ফলিত গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনার পাশাপাশি একই বিষয়ে এমআইটির একাধিক কোর্সেও অংশ নিয়েছে। হার্ভার্ডে পড়ার সময় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে ই-বে এবং গোল্ডম্যান সাকে। পাশ করার পর হার্ভার্ডের সিনিয়র ও বন্ধুদের সঙ্গে ইডিও নামে একটি স্টার্টআপে ডেটা সায়েন্টিস্ট হিসাবে কাজ করতে শুরু করে। ২০১৮ সালে চিনের সাংহাইতে কেভ্যালেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান কারিগরী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে। এ সময় দেশেও একটি টিম তৈরির চেষ্টা করেছে মুন। এরপর ২০১৯ সালে আবার সিলিকন ভ্যালিতে ইডিওতে ফিরে যায় ডেটা সায়েন্স টিম লিড হিসেবে। এ বছরের শুরুতে নিজের স্টার্টআপ নিয়ে কাজ শুরু করে।

গণিত অলিম্পিয়াডের কথা স্মরণ করে সে, “আমিতো এখনো গণিত নিয়েই কাজ করছি। আমাদের কাজটার জন্য গণিতের দক্ষতাটা আবশ্যিক”। তিনি বলেন, “ডাচ বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডের কারণেই আমি হার্ভার্ডে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এর মাধ্যমে আমি একটা বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছি। স্টার্টআপের জন্য বিনিয়োগ যোগাড়  করতে গিয়ে টের পেয়েছি এই নেটওয়ার্ক আমাকে দারুনভাবে সহায়তা করেছে”।

গণিত উৎসবের ছবির ছেলেমেয়েরা ক্রমাগত আমাদের চার্জ করে

মুন আমাদের বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের মেন্টর ছিল ২০১২ সাল পর্যন্ত। এর পরও তার সঙ্গে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া গণিত ক্যাম্পের কারণে গণিত অলিম্পিয়াডের সিনিয়রদের সঙ্গে নতুনদের একটি সখ্যতা গড়ে ওঠে। “আমরা তো এখন জানি আমাদের আইএমও মেডেলিস্ট বা ক্যাম্পাররা সবাই গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভাল দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আমাদের স্টার্টআপে তাই আমরা তাদেরকেই নিচ্ছি।”

আলাস্কাতে গণিত উৎসবের পাঁচ গ্র্যাজুয়েট। বাঁ থেকে – মুন, আদিব, শাহি, সৌমেন ও সামির। ছবি – মুনের ফেসবুক থেকে

এই মুহুর্তে তারিকদের ৬ জনের টিমের তিনজনই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের গ্র্যাজুয়েট। এদের মধ্যে রয়েছে দেশের হয়ে আইএমও থেকে তিনটি ব্রোঞ্জ পদক জয়ী আদিব হাসান। আদিব এই স্টার্টআপের প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। এছাড়া তার সঙ্গে খন্ডকালীন ভাবে যুক্ত আইএমও-র দুইটি ব্রোঞ্জ ও একটি রৌপ্য পদক বিজয়ী নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। দলে আছে আরও দুইজন গুগল প্রকৌশলী। ‘এছাড়া বাংলাদেশ, তুরস্ক ও আমেরিকাতে আমাদের চুক্তি ভিত্তিক কর্মী রয়েছে। বাংলাদেশের টিমটি আমাদের ওয়েবসাইট তৈরি করছে।”

তারিক আদনানের মতে বিনিয়োগ যোগাড় করা যতোটা সহজ একটি পন্য বা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা ততো সহজ নয়। এজন্য এখন একটি বড় দল গঠন করে নিজেদের প্ল্যাটফর্মকে উন্মুক্ত করার কাজটিতেই বিনিয়োগের অর্থ কাজ লাগাবে সে। স্টার্টআপের আলফা স্তরে ১০০ ব্যবহারকারী যোগাড় করে তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার  পরিকল্পনা। প্ল্যাটফর্মটি টেকসই  করাটা দরকার। 

গ্লোবাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট-এর বর্তমান বাজার প্রায় ১১২ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এছাড়া দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউটেড ফাইন্যান্স-এর পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হয়েছে। ব্যবহাকারীর সংখ্যাও এখন প্রায় ২৬ লক্ষ। সেই বাজারেই নিজেদের পদচিহ্ন রাখার জন্য কাজ করছে মুন।  

নিজে নতুন বলে নতুনদের জন্য কোন পরামর্শ দিতে রাজি হয়নি। আমার জোরাজুরিতে বললো, “আমি এখনও শিখছি। তবে, আমি খুব পরিস্কার করে বলতে চাই নিজের একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজটি মোটেই সহজ নয়। খুবই দূরহ ও কঠিন। সেটি মাথাই রেখে নিজের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হবে।”

তারিক আদনান মুন ও তার স্টার্টআপের জন্য আমাদের ভালবাসা ও শুভ কামনা।

[ফিচার ছবিটি মুনের ফেসবুক প্রোফাইলের কভার। সমঝদারদের জন্য ইশারাই কাফি]

[আমাদের ব্লকচেইন সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব ১৮ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুর ২টাতে হবে। নিবন্ধনের লিংক]

One Reply to “সিলিকন ভ্যালিতে তারিক আদনানের স্টার্টআপ ”

  1. আপনার লেখা সব সময় আমাকে খুবি উপকৃত করে, প্রায় সবগুলো বই পরে ফেলেছি, কিছু দিন আগে আপনার লেখা বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ পড়ে ডিটেইল রিভিউ লিখেছি! বাংলা ভাষার মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে খুবি প্রয়োজনীয় একটা বই। আমার রিভিউ পড়তে
    https://hirahasan.com/%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%a8-%e0%a6%a1%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a6%86%e0%a6%aa/

Leave a Reply