মুসিলম হাই স্কুলের ভাঙ্গা ছাদ…
মুসলিম হাইস্কুলে মেট্রিক পরীক্ষা হতো। ফলে মার্চ মাসে আমরা একটা বাড়তি ছুটি পেতাম যেটা কেবল কলেজিয়েটওয়ালারা পেতো। যেহেতু পাড়ার অন্যরা তেমন পেতোনা তাই এই ছুটিটা ব্যতি্রমীভাবে কাটতো। আমি চলে যেতাম চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখতে। হেটে হেটে যেতাম কারণ বাস বা রিকশাভাড়া কখনো পাওয়া যেত না। ১০টার দিকে বাসায় ভাত খেয়ে বের হতাম। তারপর বিকেলের দিকে ফিরতাম। ফিরে গোসল করেই খেলার মাঠে। খেলার মাঠটা বাসার পেছনে। “হাতি কোম্পানির মাঠ”। ওখানেই আমাদের ফুটবল, ক্রিকেট যতো খেলা। এবং খেলা নিয়ে মারপিট।
যেবার আমরা ক্লাশ টেনে সেবার ছুটির পর স্কুলে ফিরে গিয়ে আমাদের সবার মাথায় হাত। আমাদের স্কুলভবনটি পর্তুগিজ আমলে্র। মোটামোটা খাম্বা, লোহার প্লেটের ওপর ছাদ। বিশাল সিড়ি। ছিল আসলে দুর্গ। তো, ১৯০৯ বা ১১ সালে সেটা স্কুল হয়েছে, হাজি মোহাম্মদ মহসিনের বদান্যতায়। তো, আমরা গিয়ে দেখলাম স্কুলের বারান্দার ছাদে এক বিরাট গর্ত আর দেয়ালে গণপূর্ত বিভাগের এক সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, এই ভবন বসবাসের অযোগ্য। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমরা এতই ক্ষুব্দ হলাম যে, কারও কোন প্ররোচণা ছাড়ায় আমরা একটা মিছিলের আয়োজন করে ফেললাম।
মুসিলম হাই স্কুলের ভাঙ্গা ছাদ
ছাত্র-শিক্ষকের মরণ ফাঁদ –
এই শ্লোগান নিয়ে আমরা রাস্তায় বের হয়ে পড়লাম। আমরা আসলে জানতাম না আমাদের কী করতে হবে। কিন্তু এটা বুঝলাম যে, আমাদের জীবন বাঁচাতে আর স্কুলের সম্মান রক্ষার্থে আমাদের কিছু না কিছু করতে হবে। আমার মনে আছে আমরা যখন মিছিল নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে যাচ্ছি তখন নুরুল ইসলাম স্যার, ওয়াজিউল্লাহ স্যার, কবীর স্যার সবাই গেটের সামনে দাড়িয়ে ছিলেন তবে কেউ আমাদের বাঁধা দেননি। (এখন আমি জানি, আমিও স্যারদের জায়গায় থাকলে বাধাঁ দিতাম না। কেন?)
আমরা বিভিন্ন রাস্তায় শ্লোগান দিয়ে দিয়ে আবার স্কুলে ফেরৎ আসলাম। আমরা স্কুলের ক্লাশ টেন। না চাইলেও লিডারশীপ আমাদের কাছে। মিছিল শেষ করে আমরা স্কুলের মাঠে বসলাম আমরা কী করবো। নুরুল ইসলাম স্যার আসলেন। বললেন, “বাবারা তোমরা কী করতে চাও?”
আমরা প্রবল উত্তেজিত। বললাম আমাদের নতুন ভবন লাগবে। এই বিল্ডিং-এ আমরা ক্লাশ করতে পারবো না।
স্যার কিছু বললেন না। দূরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকলেন।
আমরা তেমন কিছুই আসলে বুঝতে পারলাম না। আমাদের মধ্যে রাশেদ ছিল সাহসীদের অন্যতম। তার প্রস্তাব হলো – কাল থেকে স্কুলের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। কয়েকজন বললো যে এভাবে হবে না আমাদের ঠিক জায়গায় যেতে হবে।
শেষমেষ ঠিক হলো আমরা যার যার বাড়িতে, বড় ভাইদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে জানবো আমাদের কী করণীয়।
আমরা সবাই স্কুলে আসবো। বাসায় বসে থাকা চলবে না। কারণ বিল্ডিং আমাদের লাগবেই।
পরেরদিন থেকে আমরা সকালে স্কুলে জমায়েত হই। তারপর মিছিল করে বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। আমাদের তৃতীয়দিনের মিছিলের পর দৈনিক আজাদী আমাদের মিছিলের খবর ছাপালো সঙ্গে স্কুলের ভাঙ্গা ছাদের ছবি। গণপূর্ত বিভাগের কোন এক প্রকৌশলীর বক্তব্য।
আমাদের যখন মিটিং-মিছিল চলে তখন স্কুলে প্রধান শিক্ষক আর সহকারি প্রধান শিক্ষক (এই স্যার ছিলেন খুবই মজার। স্যার র্বিষাদ সিন্ধু পড়ানোর সময় পুরোটাই অভিনয় করে দেখাতেন। আমি স্যারের কাছ থেকে প্রথম গেরিলা ট্যাকটিস শব্দটা শুনি। ) বিভিন্ন সরকারি অফিসে ধর্না দিযে বেড়াচ্ছেন। নুরুল ইসলাম স্যার আমাদের মিছিলের সময় বলে দিতেন আমরা যেন পুলিশ দেখে ভয় না পাই, রাস্তার এক পাশ দিয়ে মিছিল নিয়ে যাই এবং কোন ভাঙ্গচুর না করি।
আজাদী সম্ভবত আমাদের কোন এক জনের (রাশেদ কী?) বক্তব্যও ছাপিয়ে ছিল। এরই মধ্যে আমরা জেনে যাই স্কুলের নতুন ভবনের জন্য ডিসির সুপারিশ লাগে। আরও জানি স্কুল কমিটির প্রধানই উনি। কাজে আমরা ঘোষণা করি কয়েকদিন পর আমরা ডিসির অফিস ঘেরাও করবো। আমরা হাতে লিখে পোস্টার বানালাম। শ্লোগান ঠিক করলাম – ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে, ডিসির অফিস ঘেরাও হবে।
জেলা প্রশাসককে ঘেরাও করা যে সহজ কাজ না উত্তেজনায় সেটা আমাদের কারও মাথাতেই আসে নাই। আসে নাই বলে আমরা যখন পরীর পাহাড়ে ডিসির অফিসের দিকে আগালাম তখনই দেখলাম পুলিশ আমাদের প্রথমবারের মতো বাঁধা দিল। আমরা ঠেলে-ঠুলে যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাম। পরে আমাদের কয়েকজন ডিসিকে মনে হয় একটা আবেদন পত্র পৌছানোর চেষ্টা করেছে যেটা ডিসি অফিসের কেও একজন নিয়েছে। ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্যাপক লাঠিগুতা খেয়ে নানান দিক হয়ে আমরা আবার স্কুলে পৌছালাম। নিজেদের প্রেস্টিজ বাঁচাতে আমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিলাম আমাদের ভয়ে ডিসি পালিয়ে গেছেন (হাহাহা। ছোটবেলাটা কতো মজার ছিল)।
এভাবেই প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আমরা সকালে স্কুলে আসি আর মিছিল করে শহর ঘুরে বেড়াই। দুপুরে যার যার বাসাতে চলে যাই। তবে, এসবের মধ্যে কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারটা চালু আছ। খুব ভোরবেলায় উঠে সাতটার মধ্যে পাথরঘাটায় সাইদুল হক স্যারের বাসায় পৌছানো। হেটে হেটেই। প্রায় ৪০ মিনিট লাগে। সেখানে চলে পদার্থবিজ্ঞান আর ইলেকটিব ম্যাথ করার পালা। ততোদিনে আমি শাদা-কাগজের জায়গায় নিউজপ্রিন্টে লিখতে শুরু করেছি। তারপর সেখান থেকে সাড়ে আটটা- ৯টার দিকে আবার হেটে হেটে বাসায় ফেরা। তারপর গোছল করে, ভাত খেয়ে ১১টার মধ্যে স্কুলে যাওয়া।
তারপর একদিন নুরুল ইসলাম স্যার জানালেন পরের সপ্তাহের প্রথম দিনে স্কুলের মর্নিং-শিফট আর ডে-শিফটের একত্রে এসেম্বলি হবে। এবং প্রধান শিক্ষক সাদত উল্লাহ স্যার বক্তৃতা দেবেন। এবং স্যার একটু ভয়ও দেখালেন। গত ক’দিন ধরে যারা হৈ হল্লা করেছে তাদের শাস্তিও দেওয়া হবে।
কাজেই, পরের সপ্তাহে আমরা আগেভাগে স্কুলে পৌছালাম। স্কুলের মাঠে দুই-শিফটের হাজার খানেক ছাত্র। স্যাররা আমাদের লাইন করে দাড় করালেন। খুবই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় হেড স্যার জানালেন সরকার বাহাদুর আমাদের নতুন ভবনের প্রস্তাব পাস করেছেন!
জীবনে সবচেয়ে বড় চিৎকারটা সেদিনই দিয়েছিলাম।
তারপর কিসের লাইন কিসের কি আমাদের কোলাকুলি, চিৎকার আর হৈ হল্লা। বেত হাতের স্যাররাও আমাদের খুশীতে উল্লসিত। তারপর যখন আবার সবাই থামলাম তখন আমরা মনোযোগ দিয়ে হেড স্যারের কথা শুনলাম।
স্যার জানালেন পরিত্যক্ত ভবনে আর ক্লাশ হবে না। কমন রুমকে বেড়া দিয়ে তিনটা ক্লাশ বানানো হবে। স্কুলের কয়েকজন স্যার থাকতেন একটা বেড়ার ঘরে। সেগুলোকেও ক্লাশরুম বানানো হবে। হোস্টেলের নিচতলায় কয়েকটা রুমও খালি করা হবে ক্লাশের জন্য। এসব কাজের জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে। আগামী সপ্তাহ থেকে আবার পুর্নদ্যমে ক্লাশ শুরু হবে।
জীবনের অন্যতম আনন্দের দিনটা কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। দাদা মনে করিয়ে দিলেন আগামীবার কিন্তু তোমার মেট্রিক পরীক্ষা!
আহ পরীক্ষা।
(আমার ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ পড়, পড়, পড় আল্লাহ চাহে তো এই ডিসেম্বরে প্রকাশিত হবে। লিখতে লিখতে কখনো কখনো মনে হলে এখানে সেটা শেয়ার করি। আগের একটা পর্ব এখানে পড়া যাবে আর বুয়েটের পর্বগুলো একসঙ্গে পড়া যাবে এখানে)