আমাদের অন্যরকম উদ্যোক্তা
গণিত অলিম্পিয়াডের শুরুর দিকের কথা। আমি বুয়েটের আইআইসিটিতে কাজ করি আর সারা দেশে গণিত অলিম্পিয়াডকে সংগঠিত করছি। আমার ছোট্ট রুমে একদিন কয়েকজন বুয়েটের শিক্ষার্থী দেখা করতে এসেছে। তাদের ইচ্ছা, ময়মনসিংহ শহরে তারা একটি গণিত অলিম্পিয়াড করবে। বললাম, ‘সিইং ইজ বিলিভিং।’ কয়েক দিন পরই জাতীয় উৎসব। উৎসবে যোগ দিলেই জানা হয়ে যাবে সব। এভাবেই গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান। পরিচিত মহলে তার পরিচিতি সোহাগ নামে। পরের বছরই সোহাগ হয়ে যায় গণিত অলিম্পিয়াডের অন্যতম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং একাডেমিক দলের কান্ডারি। প্রশ্ন করা, খাতা দেখার টিম ঠিক করা, তাদের জড়ো করে আনা আর প্রশ্নোত্তর পর্বে সামাল দেওয়া—সবটাতেই সোহাগকে দেখা যায়। ও এখন আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলর।
এর মধ্যে বুয়েটের পড়াশোনাও শেষের দিকে চলে এসেছে। চাকরি করবে না বলে মনস্থির করেছে আগেই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রনিকস নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা থেকে আইআইসিটির পরিচালক ড. লুৎফুল কবীরের তত্ত্বাবধানে শুরু করে একটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তৈরির কাজ। সঙ্গে সতীর্থ মাসুম হাবীব ও রাজিব মিকাইল। ২০০৫-০৬ সাল থেকে এর কথা আমরা শুনেছি। ওই কাজ করতে করতে শেষ হয় শিক্ষাজীবন। গবেষক হিসেবে যোগ দেয় আইআইসিটিতে। প্রি-পেইড এনার্জি মিটার আর স্মার্ট কার্ড নিয়ে কাজ। তবে বাঁধাধরা কাজে মন টিকল না। বের হয়ে এসে গঠন করল নিজেদের প্রতিষ্ঠান, পাইল্যাবস বাংলাদেশ। মাসুম, মিকাইল আর আবুল হাসান সঙ্গে। ঠিক করল পাইল্যাবসের লভ্যাংশ কখনো নিজেরা নেবে না। এটি পুনর্বিনিয়োগ হতে থাকবে গবেষণা ও উন্নয়নে। ইভিএমের গবেষণার বৃহত্তর বিনিয়োগ পাইল্যাবসের। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে, সবই নির্মিত হয়েছে পাইল্যাবসে!
সোহাগদের প্রথম বাণিজ্যিক কাজের গল্পটিও চমকপ্রদ! পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে তারা একদিন হাজির হয় এক ভদ্রলোকের কাছে। বিজ্ঞাপনদাতা রি-রোলিং মেশিনের জন্য একটি সেন্সর খুঁজছিলেন। তাঁর মেশিনটির অনেকখানি ম্যানুয়াল। হাতে লিভার টানাটানি করতে করতে সময়মতো সবকিছু করা হয় না। সোহাগদের সমস্যাটা দিয়ে বললেন, কাজটা পারবেন কি না, সেটি কয়েক দিন পরে এসে জানাতে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন ওরা আর ফিরবে না। কারণ, এর আগে বেশ কয়েকটি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিন পর যখন সোহাগরা ফিরে আসে, তখন তিনি যুগপৎ অবাক ও বিস্মিত হলেন। কারণ, ওরা কোনো কাগজপত্র নিয়ে আসেনি, যন্ত্রটি বানিয়ে তবেই এসেছে!!!
সোহাগদের বিলের দাবি ছিল ২৫ হাজার টাকা। ভদ্রলোক দিয়েছিলেন এক লাখ টাকা!
এই আমাদের মাহমুদুল হাসান। ১৯৮১ সালের ৭ জুন জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে শিক্ষক বাবা আবুল হোসেন ও ডাক বিভাগের কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম। বড় দুই বোন আশরাফুন নাহার ও জেসমিন নাহার এখন গৃহবধূ। কি পড়ালেখায়, কি গান-বাজনায়, কি বিজ্ঞান প্রকল্প বানানো—সবটাতেই সোহাগ ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৯৮ সালে সরিষাবাড়ি থেকে ঢাকা বিভাগের এসএসসি পরীক্ষায় পঞ্চম হওয়া, জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ে চলে আসা, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্কুলের নেতৃত্ব দেওয়া—সবই তার কিছু প্রকাশ মাত্র। ২০০০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে চতুর্থ হয়ে বুয়েটের তড়িৎকৌশলে পড়তে আসা।
ইলেকট্রনিকস নিয়ে কাজ করার প্রতিষ্ঠান পাইল্যাবস সোহাগ ও তার সঙ্গীদের প্রথম উদ্যোগ। তাদের ধারণা, মুনাফার সর্বোচ্চায়ন নয়, সমাজের উন্নতি হওয়া উচিত ব্যবসার লক্ষ্য। ‘সমাজ ভালো থাকলেই না আমরা ভালো থাকব।’ সোহাগ বলে। এ কারণে পাইল্যাবসের লভ্যাংশ ব্যয় হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অন্যরকম বায়োইনফরমেটিকস ল্যাবরেটরি সেই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টারই একটি অংশ মাত্র।
পাইল্যাবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি নিজেদের। গড়ে তুলেছে সফটওয়্যারের প্রতিষ্ঠান অন্যরকম সফটওয়্যার, আমদানি-রপ্তানির অন্যরকম সলিউশনস, ইন্টারনেট নিয়ে অন্যরকম ওয়েব সার্ভিস, সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশের
অন্যরকম প্রকাশনী আর ওয়েস্টার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। এসব নিয়ে তাদের অন্যরকম গ্রুপ। মাহমুদুল হাসান তার চেয়ারম্যান আর আবুল হাসান লিটন তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বন্ধু এবং সঙ্গীদের মধ্যে মানিকজোড়ের আরেকজন লিটনের কথা বলে। ‘লিটন খুব ঠান্ডা মাথায় কাজগুলো শেষ করতে পারে।’ গ্রুপের বাইরে রয়েছে তার নিজের ইনট্র্যাক নামের প্রোডাকশন হাউস।
তবে, ছাত্রজীবনে শুরু করা একাডেমি কোচিং সেন্টার “উদ্ভাস” এর পেছনেও প্রচুর সময় দিতে হয়। শুরু থেকে একটি অন্যরকম কোচিং সেন্টার করতে চেয়েছিণ সোহাগ ও লিটন। এ কারণে ওরা উদ্ভাসকে কোচিং সেন্টার বলে না, বলে একাডেমিক কেয়ার। আর অন্যদের মতো সাজেশনও দেয় না!!
চলার পথে অনুপ্রেরণার কথা জানতে চাইলে স্টিভ জবসের উদ্ভাবনী শক্তি ও লেগে থাকার কথা বলার পাশাপাশি জাফর স্যার (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) আর গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদকের কথা জানায় সোহাগ।
তার স্বল্প কাজের জীবনে লক্ষ করেছে দেশে যোগ্য মানুষের বড় অভাব। তাই সে কাজেই মনোনিবেশ করতে চায় মাহমুদুল হাসান। এই কাজের জন্য প্রথমত দরকার ভালো ভালো বই সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত ‘ঢাকার বাইরে সহজেই কোনো ভালো বই পাওয়া যায় না।’ সেই অভাব দূর করার জন্য গড়ে তুলেছে দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বইয়ের দোকান রকমারি ডট কম (www.rokomari.com)। বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে রকমারিতে বই কেনা যায়। মাত্র ৩০ টাকা সার্ভিস চার্জ নিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসে বই পৌঁছে যায় ক্রেতার কাছে। বই পেয়েই বাহকের হাতে মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা।
নিজেদের তৈরি করা কিছু শিক্ষা ভিডিও ওরা বিতরণ করে বিনা মূল্যে। তবে প্রাপককে আবার এর দুই কপি বিতরণ করতে হয়, বিনা মূল্যে!
সোহাগের ইচ্ছা অন্যরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। যে প্রতিষ্ঠান কেবল জিপিএ ফাইভ-প্রত্যাশী শিক্ষার্থী গড়ে তুলবে না, বরং তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। তারা চাকরি খুঁজবে না, চাকরি দেবে। বণিক জাতির দুর্নাম ঘুচিয়ে বিশ্বের সামনে সৃজনশীল উদ্যমী জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবে।
[প্রথম আলো প্রতি বাংলা বছরের শুরুতে আশাজাগানিয়া তরুনদের খুঁজে বের করে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে প্রায়শ কাওকে না কাওকে নিয়ে আমার লিখতে হয়। বছরের এই একটা কাজে আমি ব্যাপক আনন্দ পাই। ২০১২ সালে সোহাগকে নিয়ে এই লেখাটি লিখেছিলাম। এর মধ্যে সোহাগের কাজর পরিসর ব্যাপ্তি এবং দর্শন আরো পরিনত হয়েছে এবং সোহাগ বিয়েও করেছে। আজ তার জন্মদিনে এই পুরানো লেখাটাই আমার ব্লগে প্রকাশ করে লাখলাম। একদিন আমি গর্ব ভরে বলতে পারবো সোহাগ আমাকে বড় ভাই বলে।]
প্রথম আলোতে আসা প্রতিবেদন এখানে পড়া যাবে