গণিত উৎসবের গান
গণিত উৎসব শুরু আর তার এগিয়ে চলা নিয়ে আমি মনে হয় আমার জীবনের অর্ধেক লেখা লিখেছি। কাজে এ গল্পের বেশিরভাগই সবাই জানে। নতুন করে লিখতে চাই না। জাফর ইকবাল স্যার আর কায়কোবাদ স্যারের মাথা থেকে বের হওয়া এই কাহিনীর শুরু প্রায় সবাই জানেন। তারপর আজ প্রায় দেড় দশক ধরে এই উৎসব আমাদের সামনে অনেকগুলো নতুন মাইলস্টোন আর টার্গেট সৃষ্টি করে দিয়েছে।
এবারের ১২ জানুয়ারি ফরিদপুর উৎসবে এক শিক্ষকের সংখ্যা দেখা। তিনি বাংলার শিক্ষক কিন্তু গোপালগঞ্জের ছেলে-মেয়েদের দুটি বাস আর দু্টি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে এসেছেন। ময়মনসিংহে গতবার একজন সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষককে পেয়েছিলাম যিনি উৎসবে থাকার জন্য কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। না, নিজের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসেননি। একাই এসেছিলেন।
শুরু থেকে এই উৎসবের জন্য একটা থিম সং লেখার কথা আমি ভেবেছি। ২য় গণিত উৎসব থেকে আমরা “আমরা করবো জয়” কে গণিত জয়ের গান হিসাবে গাইতে শুরু করি। এই গানটা গেয়েছে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। এটি গেয়েছে চিলির গণ মানুষ, গেয়েছে বাঙ্গালি, গেয়েছে কিউবানরা। ১৯৯৫ সালে মাছরাঙ্গা নামে একি জাহাজে ২২৫ জন অভিযাত্রী নিয়ে আমরা হিরণ পয়েন্ট থেকে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাই। সে সময় লঞ্চের ছাদে গানের আসর চালু করার জন্য আমি আর আদিত্য কবীর হেড়ে গলায় এই গান গাইতাম। আমাদের অত্যাচারে প্রথমে বুয়েটের স্থাপত্যের এক ম্যাডাম ঝাড়ি লাগিয়ে আমাকে হারমোনিয়াম থেকে উঠাতেন। তারপর নিজেই বসে পড়তেন। সেবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সারা দেশের ছেলেমেয়েদের আমি এই গান গাওয়াই দেবো। এই গান গাওয়ার সময় আমি কর্ডলেসটা নিয়ে সবার মাঝখানে চলে যেতে শুরু করি।
নানান সুরে, নানান ভঙ্গিমায় এই গান গাওয়া হবে আরও অনেক দিন। এখানে জোয়ার বায়েজের কন্ঠে।
এর তৃতীয় স্তবকটা আমরা লিখলাম এভাবে-
গণিতে নাই কোন ভয়
গণিতে নাই কোন ভয়
গণিতে নাই কোন ভয় আজকে।
আহা বুকের গভীরে
আমরা জেনেছি
গণিত করবো জয় নিশ্চয়।
তো, গানটা সবজায়গায় আমরা গাইলাম।
এই প্যারাটা আমিও হেড়ে গলায় গেয়েছি অনেকবার!
https://www.youtube.com/watch?v=VQv5t4Htd4A
প্রথম দুই স্তবক বাংলা আর ইংরেজিতে আমরা গাই। কিন্তু এটির ইংরেজি ছিল না। বরিশাল উৎসবে গিয়ে শুনলাম ওরা এই স্তবেকর ইংরেজি করেছে এভাবে –
We are not afraid of math
We are not afraid of math
We are not afraid of math today
Who ho deep in my heart
I do believe that
Math will overcome somedays!
তো সেই থেকে ঐ গানটা পুরস্কার দেওয়ার আগে সবাই মিলে গাওয়ার একটা চল হয় যায়। কিন্তু আমার মনে সবসময় একটা উৎসবের গানের আকাঙ্খা ছিল।এ নিয়ে একজন বিখ্যাত গীতিকারের সঙ্গে একদিন ঘন্টাখানেক কথা বললাম। সবশুনে তিনি বললেন, “মুনির ভাই, আপনার উৎসবের গান আমি লিখতে পারবো না”।
কেন?
“গানটা কেমন হবে এটা যখন আপনি বলছিলেন তখন আপনার চেহারার মধ্যে এক আশ্চর্য ধরণের আলো আমি দেখেছি। এই গান তাকেই লিখতে হবে যে এই উৎসবের একটা অংশ। আপনি আমাকে মাফ করবেন”।
সেদিন আমি টের পাই যে এই গানটা আমাদের কেউ একজন লিখতে হবে। তারপর আমি প্রথমদিককার মুভার্সদের এই গাণের কথা বলতে থাকি। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় কুষ্টিয়ার নওরিন হাসান চমক।ওর একটু গান বাজানার শখ আছে। বুযেট নিয়ে তার একটা প্যারোডি আমি শুনি। চমককে নিয়ে আমি একটা পূথিও লিখি-
শোনো, শোনো বিশ্ববাসী শোন দিয়া মন
চমক হাসানের কথা করিবো বর্নন।
একহারা গড়ন তার, হ্যালা ভালা সে বুয়েটের পোলা,
পোলাতো নয় যেন আগুনের গোলা!!!
সংখ্যা নিয়ে নিউরনে হয় যে তার অনুরণন
ভেবেচিন্তে চালু করে সংখ্যারও ভ্রমণ
ছেলে অতি সজ্জন, আছে অনেক গুণ
মুখে মুখে করতে পারে ম্যালা বড় গুন!!!
গণিত উৎসবের সঙ্গে তার আত্মারও বন্ধন
গানের সুরে তাই করে উৎসবের বর্ণন।
মেতে থাকে আনন্দে, থাকে হাস্যময়,
জীবনে নাই তার লজ্জা আর নাই ভয়!!!
সুরেলা গলা তার, কণ্ঠও সুন্দর
সুরের তালে কেটে যায় রাত, হয় যে ভোর।
নানান সুরে একই গান গাইতে সে পারে,
তাই না শুনে ছেলেমেয়ের হাসি না থামে।।।
হাস্যরসে ভুলে না সে নিজের দায়িত্বজ্ঞান.
এমনই মানুষ সে, চমক হাসান।
তো একবার এক ক্যাম্পে চমক আমাকে তার লেখা ও সুর দেওয়া একটি গান গেয়ে শোনায়। সে ক্যাম্পটা হয়েছিল ইস্কাটনে। ক্যাম্পের কোন এক সন্ধ্যায় টেবিলে তবলার বোল দিয়ে আর মুখে শব্দ করে চমক গানটি গায়। গানের কথাগুলো নিম্নরূপ –
মন মেলে শোন, শুনতে পাবি বিজয়ের আহবান
গণিতের ধ্বণিতে বাজে ঔ মুক্তির জয়গান
গণিতের প্রতি আছে যতো ভীতি আজ হবে সব দূর,
আজ লক্ষ প্রাণের ঐকতানে বাজবে একই সুর—
আয় আয় আয় কে স্বপ্ন দেখবি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়
আয় আয় আয় কে দেশটা গড়বি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়
একটি মানুষ দেখলে ম্বপ্ন, স্বপ্ন তারে কয়
দুজন দেখলে একই স্বপ্ন সেও তো স্বপ্ন রয়
যদি লক্ষ কোটি প্রাণ দোলে একই স্বপ্ন মূচ্ছনায়
সে আর তখন থাকেনা স্বপন, সত্যি হয়ে যায়।
আয় গণিতের পথ বেয়ে, আয় নবীনেরা সব ধেয়ে
দ্যাখ, আশা নিয়ে এক জাতি আছে তোদের পথ পানে চেয়ে
এই দেশ জাগাবি গণিতের জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায়
আয় আয় আয় কে স্বপ্ন দেখবি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়
আয় আয় আয় কে দেশটা গড়বি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়
কত না ধাঁধা গণিতের বাধা যেতে হবে পেড়িয়ে
সংখ্যার বৈচিত্রের মাঝে যাবে না কি হারিয়ে?
যদি দেশপ্রেম বুকে, গণিতে সুখে করিস বিচরণ
একদিন সত্যিই মিলে যাবে এ দেশের সমীকরণ
আর নেই কোন সংশয়, আজ গণিত করবি জয়
গণিতের ভাষাতে রাখবি বিশ্বে স্বদেশের পরিচয়
আমরাও পারি যে হতে সেরা বিশ্ব দেখবে তাই…
আয় আয় আয় কে স্বপ্ন দেখবি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়
আয় আয় আয় কে দেশটা গড়বি আয়
আয় আয় আয় গণিতের আঙ্গিনায়।
আমার একেবারে মরমে গিয়ে পৌঁছে। আমি তখন বুঝতে পারি কেন ঐ গীতিকার বলেছিলেন আপনাদের মধ্যে কাউকে এই গান লিখতে হবে। গণিত অলিম্পিয়াডের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই তাৎক্ষণিক হয়। কাজে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়ে যায় এই গানটি হবে আমাদের উৎসবের গান। আর এই গান দিয়ে শুরু হবে অলিম্পিয়াডের পরের পর্ব।
চমকের সুর ও তার কন্ঠে সেই গান
https://www.youtube.com/watch?v=7e1eyO-FIDI
২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমরা এই গান এই সুরে গেয়েছি। তবে, গত দুই বছর ধরে অনেকেই আমাদের বলেন গানটাতে একটু উন্মাদনা যোগ করতে কারণ গণিত উৎসব এখন এক উন্মাদনায় পরিণত হয়েছে। চমকের সুরে মায়াময়তাটা বেশি। এটিকে রক এন্ড রোল করা হোক।
আমরা শরনাপন্ন হলাম কবীর বকুলের। এর আগে আমরা চমকের অনুমতি নিয়েছি। কবীর বকুলের উদ্যোগে গানটিকে নতুন করে সুরারোপ করেন সুরকার মীর মাসুম। তার একটি পিকচারাইজেশনও আমরা করেছি।
নতুন সুরের গান
এবছর আমরা সব উৎসবে এই গান গাওয়ার চেষ্টা করছি। যদিও বোঝা যাচ্ছে কেবল হারমোনিয়াম আর তবলা দিয়ে নতুন সুরে গানটা গাওয়া কঠিনই বটে।
https://www.youtube.com/watch?v=MOBPQeLoXBU
যাইহোক এখন আমাদের দুইটা সুরে একটা গান। দুইটা নিয়েই আমরা আগাবো। শেষ পর্যন্ত একটা সুর রাখবো না দুইটা সুরই রাখবো সেটার সিদ্ধান্ত আমরা এখনই নেবো না। কারণ এখন আমরা এই গানের একটা নৃত্যরূপও ভাবছি। নাচের জন্য কোন সুরটা ভাল হবে সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। আপাতত ভোটাভুটি চলতে থাকুক।
জয়তু গণিত উৎসব