মার্ক দ্যা গ্রেট মার্কেটিয়ার টোয়েন
ইউলিসিস এস গ্র্যান্ট, জেনারেল গ্রান্ট নামে পরিচিত, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সাহসী জেনারেল এবং সেই দেশের ১৮তম রাষ্ট্রপতি। ১৮৬৮ সালে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে ভোটের যুদ্ধে জয়লাভ করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হোন।
টম সয়্যার ও হাকল বেরি ফিন – দুইজনের সঙ্গেই আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের কাজি আনোয়ার হোসেন, অনুবাদের বরপুত্র। তবে, তার আগে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের হাত কাটা রবিন (যাকে বন্ধুরা হাকারবিন নামে ডাকতো) এবং পরে দীপু নাম্বার টু পড়েছি। কাজে ডাকাবুকা হাক ফিন আর বুদ্ধিমান টম সয়্যার আমার মনোজগতে ভালই জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে টমের বেড়া রঙ করার ঘটনাটি আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আমি প্রায়শও এটি কাজে লাগাই। সঙ্গে রুশ দেশের উপকথার “কুড়োলের জাউ”।
তো, জেনারেল গ্র্যান্টের কথাতে টম বা হাক ফিন কেন আসে? আসে কারণ এই দুই বই-এর লেখকের নাম মার্ক টোয়েন। আমাদের যাদের এসএসসিতে সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা প্রবন্ধ পাঠ্য ছিল তারা তাঁর খানদানী লাইব্রেরি কেমন করে গড়ে উঠেছে সে কথা জানতাম। তো, মার্ক টোয়েনের জন্ম ১৮৩৫ সালে। তার মানে তিনি জেনারেলের কিছুটা ছোট হলেও মোটামুটি একই সময়ে বিচরণ করেছেন।
ভাগ্নের সঙ্গে মিলে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থা খোলেন। তারপর শুরু করেন পাণ্ডুলিপি খোঁজার কাজ।
এদিকে প্রেসিডেন্ট জেনারেল গ্রান্ট ১৮৮৪ সালে গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হোন। ১৩৮ বছর আগে এর কোন চিকিৎসা ছিল না। মৃত্যুপথের যাত্রী জেনারেলকে মার্ক বোঝালেন – আপনার আত্মজীবনী লিখে ফেলেন। তাহলে সেটার রয়্যালটি দিয়ে আপনার পরিবার চলতে পারবে আরামসে।
আর এর পাশাপাশি শুরু হয় দ্যা গ্রেট মার্কেটিয়ার মার্ক টোয়েনের মার্কেটিং। এ এক আশ্চর্য মার্কেটিং। লেখা প্রকবশ হওয়ার আগে থেকেই বই-এর প্রচার (যারা আমার পড়ো পড়ো পড়ো-এর ক্যাম্পেইন লক্ষ করেছেন তারা জানেন এটা কী)।
এই বই-এর জন্য মার্ক বের করেন আর্লি রিডিং পদ্ধতি। মানে কেউ কেউ প্রকাশের আগেই বইটা পড়ার সুযোগ পাবেন (আমার গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং বই-এর আর্লি রিডাররা ব্যাপারটা খুব সহজে ধরতে পেরেছেন)। ২২ জুলাই ১৮৮৫ সালে এই বই-এর পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ হয়। পরদিন, ২৩ জুলাই জেনারেল গ্রান্ট মারা যান।
তো, মার্ক এই বই মাত্র ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কপি বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন। জি, ঠিক পড়েছেন মাত্র ৩ লক্ষ ৫০ হাজার কপি। দুই খন্ডের হার্ড বাঁধাই বই!!!
কেমন করে এ কাজ করলেন মার্ক!!!
প্রথমত প্রেসিডেন্ট যখন লিখতে শুরু করলেন তখন থেকে উত্তরের পত্রিকাগুলো এটির কমেন্ট্রারি শুরু করে। বিশেষ করে মৃত্যুর আগে প্রেসিডেন্ট এটা শেষ করতে পারবেন কিনা সেটাও লোকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে।
মার্ক বের করলেন কে এই বই বেশি পড়বে। গৃহযুদ্ধের ২০ বছর পর উত্তরের লোকদেরেই এই বই বেশি পড়ার কথা কারণ এ তো তাদেরই গৌরব গাঁথা। মার্ক ১০ হাজার ইউনিয়ন আর্মির লোককে সেলস এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিলেন। কমিশন ছাড়াই তারা এটা করতেন। কমিশনটা বাড়তি। ওরা প্রত্যেকে এই বই বিক্রি করার সময় আলমিরা থেকে নিজেদের ইউনিফর্ম বের করে নিতেন। তারপর নিজেদের কাছের লোকদের কাছে গিয়ে গল্পটা ফাদতেন যেই গল্প কিনা খোদ মার্ক মুসাবিদা করেছেন। একে তো পত্রিকায় পড়েছেন, এমন লোক বইটা তার কাছে নিয়ে এসেছেন যে কিনা এই যুদ্ধ করেছেন এবং এটি তারই যুদ্ধ। তখন তো সেখানে রকমারি ছিল না। কাজে বই কিনতে হয়েছে সামরিক কুর্দির লোকেদের কাছ থেকে। সংস্করণ থেকে সংস্করণে এর দাম হয় ৩.৫ ডলার থেকে ১২ ডলার। ২০২২ সালের হিসেবে ২০০ থেকে প্রায় ৪০০ ডলার। তখনকার যে কোন বই-এর দাম থেকে বেশি। কারণ মার্ক জানতেন এই বই যিনি কিনবেন তিনি কতো পৃষ্ঠা দেখে কিনবেন না (কতো পার্সেন্ট কমিশন দেবেন এটা নিয়ে মুলামুলিও করবেন না।) কারণ এটা তার গৌরবের ব্যাপার।
তো, এই হচ্ছে The Personal Memoirs of Ulysses S. Grant-বই-এর মার্কেটিং-এ দ্যা গ্রেট মার্কেটিয়ার মার্ক টোয়েনের কারবার।
বই নিয়ে মার্কেটিং-এর কিছু কলাকৌশল আমার গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং বইতে লিখেছি। বিশেষ করে আমার পড়ো পড়ো পড়ো মার্কেটিং-এর ক্ষেত্রে মার্ক টোয়েনের বুদ্ধি কতোটা কাজে লেগেছে সেটাও ঐ বইতে আছে।
পাবলিশার আর লজ্জা পান না এমন লেখকদের জন্য মার্ক টোয়েন একজন আদর্শ।