চে গুয়েভারা, ম্যারাডোনা আর মেসির দেশে
এমিরেটস-এর বড়ো ডানার বিমানটি গোত্তা খেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠলো বুয়েনার্স আয়ার্স শহর। আর্জেন্টিনার রাজধানী। ফুটবলের বরপুত্র ডিয়াগো মারাডোনার শহর। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বলে অন্ধকার থাকার কথা। তবে, ওপর থেকে আমি দেখলাম খালি বাতি আর বাতি। আমাদের ঢাকা শহরেও এরকম নামার সময় বাতি দেখা যায় তবে সেখানে মাঝে মাঝে কালো ছোপ ছোপ থাকে। সেগুলো লোডশেডিং এলাকা! বুঝলাম বুয়েনার্স আয়ার্সে লোডশেডিং নাই!!!
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পয়াডের ৫৩ তম আসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা ম্যারডোনার দেশে এসেছি। রওনা দিয়েছি ২০১২ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখ রাতে বাংলাদেশ সময়। এখানে আসতে আসতে বাংলাদেশে ৯ তারিখে সূর্য উঠে পড়েছে। দুবাই থেকে প্রায় ২০ ঘন্টার বিমান যাত্রা। অবশ্য ফাঁকতালে আমরা পেলের দেশের এয়ারপোর্টও দেখে ফেলেছি! আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসতে হয় বলে, হয়তো, বিমানটি থামে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে। সেখানে প্লেনের ভেতরটা পরিস্কার করার জন্য আমরা যারা বুয়েনার্স আয়ার্সের যাত্রী তাদেরকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে নামিয়ে দেওয়া হয়। ঘন্টা দেড়েক সেখানে অপেক্ষা করে আবার বিমানে উঠে পড়া। আমি ভাবলাম আবার কবে ব্রাজিলে পা পড়বে, স্মৃতি হিসাবে একটি স্যুভেনির নিয়ে যাই!
আমার সঙ্গে বাংলাদেশ গণিত দলের পাঁচ সদস্য। ধনঞ্জয় বিশ্বাস, তানজীম শরীফ মুগ্ধ, সৌরভ দাশ, নূর মোহাম্মদ সফিউল্লাহ এবং আদিব হাসান। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে গণিতের একটি উৎসব হয়। দেশের শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ডাচ বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উৎসবের মূল পর্ব হচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াড!!!
অলিম্পিয়াড শুনে অবাক হচ্ছো? ভাবছো, অলিম্পিক তো খেলাধুলার। দৌড়, ঝাপ, সাঁতার আর অন্যান্য ক্রীড়ার। এখানে গণিত আসলো কোথা থেকে।
ঠিক শুনেছো। এটি গণিতেরই অলিম্পিয়াড। ১৯৫৯ সালে রুমানিয়ায় প্রথম একটি আন্তর্জাতিক মেধার লড়াই-এর আযোজন করা হয়। নানান দেশ থেকে সেখানে হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় অঙ্ক করবে বলে। আয়োজকরা এর ব্যাপ্তি আর লড়াই-এর ধরণ দেখে এর সঙ্গে অলিম্পিকের মিল খুঁজে পান। অলিম্পিকে যেমন নানান দেশের ক্রীড়াবিদরা ক্রীড়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য লড়ে তেমনি এখানে বিশ্বের খুদে গণিতবিদরা তাদের মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। কাজে এটিও অলিম্পিয়াড। (এখন অবশ্য গণিত ছাড়াও অন্যান্য বিষয় যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইনফরমেটিক্স ইত্যাদি বিষয়েরও অলিম্পিয়াড হয়ে থাকে)।
১৯৫৯ সাল থেকে শুরু হলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এই অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করছে এইতো সেদিন ২০০৫ সাল থেকে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি গঠন হওয়ার পর থেকে আমাদের এই অংশগ্রহণ। আমি যেহেতু এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের পক্ষে সমন্বয়কারী তাই প্রতিবছরই আমি বাংলাদেশ গণিত দলের সঙ্গে আইএমওতে যাই, উপ-দলনেতা হিসাবে।
আইএমওর নিয়মানুসারে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী দেশ ৬ জন পর্যন্ত প্রতিযোগী পাঠাতে পারে। এই প্রতিযোগীদের নির্বাচন করা হয় একটি কঠিন প্রক্রিয়ায়। এই ধরো আমাদের এই পাঁচজন। ওরা কেমন করে আর্জেন্টিনার জন্য নির্বাচিত হলো শুনবে?
২০১২ সালের জন্য সারাদেশের ১৭টি জেলা শহরে আঞ্চলিক গণিত উৎসব হয়েছে। এইগুলোতে অংশ নিয়েছে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে যারা বিজয়ী হয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৮০০ ছেলমেয়ে ঢাকার জাতীয় উৎসবে অংশ নিয়েছে। সেন্ট যোসেফ স্কুলে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার ও শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের জাতীয় উৎসব। সেখানে ওদের যে সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে তার কোনটি বাংলাদেশের কোন স্কুল বা কলেজের পরীক্ষায় কোনদিন আসে নি। কাজে সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার সমাধান করে সেখানে বিজয়ী হতে হয়েছে। বিজয়ীদের মধ্য থেকে ৪০ জনকে নির্বাচন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় গণিত ক্যাম্পের জন্য। গণিত ক্যাম্প এক মজার জায়গা। এখানে ক্যাম্পাররা সকালে অঙ্ক করে, দুপুরে অঙ্ক করে, বিকেলে অঙ্ক করে এমনকী রাতে যখন ঘুমোতে যায় তখনো স্বপ্নে অঙ্ক করে। তবে শুধু যে অঙ্ক করে তা নয়। ওখানে অনেক নতুন বন্ধু হয়, অনেক নতুন বিষয় শেখা যায় আর সবচেয়ে বড় কথা সবার সঙ্গে মিলেমিশে থেকে দেশের জন্য, আমাদের দেশের জন্য এক গভীর ভালবাসার জন্ম হয়। সেখানে পরীক্ষাও হয় আর তা থেকে ১৫ জনকে বাছাই করা হয় আর একটি ক্যাম্পের জন্য। এই ক্যাম্পটির কোন আলাদা নাম নেই। তবে এটিকে আইএমও দল নির্বাচনের ক্যাম্প বলা যায়। এই ক্যাম্পে সবাই খালি পরীক্ষা দেয়। সকালে, দুপুরে রাতে। আর মাঝে মধ্্যে বড়রা এসে সেখানে কিছু ক্লাস নেয়।
সব মিলিয়ে মানে বাংরাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড, জাতীয় গনিত ক্যাম্প দল নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আইওমওর জন্য দল নর্বাচন করা হয়। তবে, শুধু অঙ্ক করার দক্ষতা দেখা হয় না। দেখা হয় তাদের শৃংখলা, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা আর অন্যকে সাহায্য করার প্রচেষ্ঠা।
এবার তাহরে বুঝেছো যে কতো চড়াই-উৎরাই পার হযে ধনঞ্জয় আর অন্যরা আর্জেন্টিনার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
তো, আমরা এয়ারপোর্টে নেমে গরম জামাকাপর পরে নিলাম। জুলাই মাসে? হ্যা। কারণ আর্জেন্টিনা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ। আমাদের যখন গরমকাল ওখানে তখন অনেক শীত। নিজেদের বাক্সপেটরা নিয়ে আমরা যখন এরাইভাল লাউঞ্জে আসলাম দেখা হল আইওমও ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে। আমাদেরকে যেতে হবে বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে মারডেল প্লাটা শহরে। সেখানে এবারকার অলিম্পিয়াড হবে।
আমরা ঢাকা থেকেই এই যাত্রার টিকেট করে গিয়েছিলাম। সেটি ভলান্টিয়ারকে দেখাতে আমাদেরকে বাস কাউন্টারে যোগাযোগ করিয়ে দিল। আমরা আমাদের টিকেট হাতে পেলাম। আমাদের যাত্রা শুরু হবে রাত সাড়ে এগারোটায়। এখন বাজে মাত্র ৯টা! কী করি। এরাইভাল লাউঞ্জে আমরা পেয়ে গেলাম ম্যাকডোনালডের দোকান। ব্যাস। আলুভাজি, বার্গার আর চিকেন নাগেট দিয়ে হয়ে গের আমাদের রাতের খাবার।
রাত সাড়ে এগারোটায় আমাদের মিনিবাস যাত্রা শুরু করলো বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে। আমার সঙ্গীরা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মাঝে মধ্যে দেখছিলাম রাতের আকাশ।
২.
মার ডেল প্লাটা শহরে আমাদের সবাইকে রাখা হয়েছে একটি সুবিশাল হোটেলে। একশ’র বেশি দেশের প্রায় হাজারখানেক লোক সেখানে আছে সেটি টেরও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার সামনের তিনটে রুমে ওরা পাচজন। সৌরভের রুমমেট একজন হংকং-এর শিক্ষার্থী।
আমাদেরকে প্রভিন্সিয়াল হোটেলের গেটে অর্ভর্থনা জানায় আমাদের গাইড মাউরো শিলম্যান। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত আর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। ২০০৭ সালে ভিয়েতনামে আর ২০০৮ সালের স্পেনের আইওমওতে অংশ নেওয়া। ঝুড়িতে একটা ব্রোঞ্জ পদকও আছে। আমাদের রুমে পৌছে দিয়ে ও জানিয়ে গেল সকাল সাড়ে ৯টার সময় আমাদেরকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য রওনা হতে হবে। প্রায় ৪০ ঘন্টা জার্নির পর আমাদের হাতে ছিল মাত্র ২ ঘন্টা!
রুমে ফিরে আয়োজকদের দেওয়া ব্যাকপ্যাক খুলে দেখা গেল সেটাতে আছে একটা হাতাকাটা সোয়েটার আর একটি ছাতা!!! বুঝলাম আর্জেন্টিনার শীতের সঙ্গে বৃষ্টির কোন বৈরিতা নেই।
সব আইওমওতে কোন বড় থিয়েটারে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। সেখানে যেতে হয় হয় হেটে নাহয় বাসে করে। তবে, এখানে রেডিও সিটি অডিটরিয়ামটা কাছেই। কাজে আমাদের রওনা হতে হল হেটেই। হাটতে গিয়ে টের পেলাম এটি অন্য আইওমওর থেকে আলাদা। আমাদের শোভাযাত্রার সম্মুখে আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী গায়ক আর বাদকদের একটি দল। তারা পুরোটা পথ নেচে গেয়ে আমাদের নিয়ে গেছে উদ্বোধনী হলে। সঙ্গে রণপাওয়ালা দুইজনও ছিলেন। একটা হৈ হৈ ভাব নিয়ে আমরা পৌছে গেলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
সব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো এখানেও কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে। থাকে বক্তৃতা ও উদ্বোধন ঘেোষনা। যারা বক্তব্য দিয়েছেন তারা আশা প্রকাশ করেছেন যাতে আজকের খুদে গণিতবিদরা বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে। এরপর শুরু হয়ে যায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মার্চপাস্ট। ইংরেজি বর্ণমালা অনুসারে একে এক মঞ্চে ওঠে সব দেশের অংশগ্রহণকারী। বাংলাদেশের দুটো পতাকা নিয়ে আমরাও উঠে পড়লাম মঞ্চে। আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী নাচিয়েরা প্রত্যকেটি দলকে মঞ্চে স্বাগত জানায়। কুচকাওয়াচের শেষে ছিল ওদর গান আর নাচ।
আইএমওর নিয়মানুসারে নিজ নিজ দলের দলনেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগীদের ‘চোখের দেখা’ হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। মিলনায়তনে বাংলাদেশ দলের দলনেতা মাহবুব মজুমদার হাত নেড়ে আমাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আইএমওর প্রথা অনুসারে মাহবুব মজুমদার ৪ জুলাই থেকে অন্য দলনেতাদের সঙ্গে অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন। সেখানে তাঁরা অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন আর কীভাবে নম্বর দেওয়া হবে সেটি চূড়ান্ত করছেন।
অনুষ্ঠান শেষে অন্যদের সঙ্গে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। পরের দুইদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেবে। আমি হয়তো এদিক সেদিক যাবো। তবে তার আগে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার জন্য ঘুমের দরকার।
৩.
আইএমওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্রণ অংশ হলো দুইদিনের পরীক্ষা। আমাদের দেশের যেকোন পরীক্ষার সঙ্গে এর অনেক পার্থক্য। প্রতিদিন সাড়ে চারঘন্টার পরীক্ষা কিন্তু সমস্যা থাকে মাত্র ৩টি করে। শুধু তাই নয়, যে সমস্যাগুলো থাকে তা এর আগে সারা পৃথিবীর কোন পরীক্ষা, বই বা ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়নি। বিষয়গুলো খালি জানা আছে –জ্যামিতি, বীজগণিত, নম্বরতত্ত্ব ও কম্বিনেটরিক্স। বোঝা যাচ্ছে যে কাজটা সহজ নয়। তবে, অনেকই সেগুলো করে ফেলে। কোন কোন শিক্ষার্থী ৬টি সমস্যারই পূর্নাঙ্গ সমাধান করে পারফেক্ট স্কোরারের কৃতিত্ব দেখায়!
১০০টি দেশের ৫ শত ৪৮ জন শিক্ষার্থী ১০ ও ১১ তারিখ দুইদিনের পরীক্ষা দিয়েছে। আমার দেখা অলিম্পিয়াডগুলোর মধ্যে এবারই প্রথম প্রতিযোগীদের থাকার আর পরীক্ষার জায়গা একই স্থানে। হোটেল প্রভিন্সিয়ালের দ্বিতীয় তলায় একটি বড় এবং একটি ছোট হলে ৫৪৮ জন পরিক্ষার্থীর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সৌরভ ছাড়া আমাদের বাকী চারজন বড় হলঘরে পরীক্ষা দিয়েছে।
এই ফাকে কয়েকটি তথ্য বলে নেই। এই নিয়ে বাংলাদেশ অস্টমবারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজক দেশ হয়েছে। এর আগে ১৯৯৭ সালে ৩৮তম আইএমও হয়েছে এই মারডেল প্লাটা শহরে। সেই আইএমওতে অংশগ্রহণকারী আয়ারল্যান্ডের উপদলনেতা বাংাদেশ গণিত দলের অন্যতম সুহৃদ গর্ড লাসলি ১৫ বছরে শহরের অনেক পরিবর্তন চিহ্নিত করেছেন। তবে, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি বলে তিনি মনে করেন। আইওমও একটি গ্রীস্মকালীন অলিম্পিয়াড হলেও এই নিয়ে তুতীয় বারের মতো দক্ষিণ গোলার্ধে এটি শীতকালীন অলিম্পিয়াডে পরিণত হয়েছে। আর্জেন্টিনার দুইবার ছাড়া অস্ট্রেলিয়া আগে একবার এই আয়োজন করেছে। আর্জেন্টিনার ৭ম বৃহত্তম শহরটি রাজধানী থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে, আটলান্টিকের পারে এবং যথারীতি একটি পর্যটন নগরী। নগরীর সাড়ে ছয় লক্ষ অধিবাসীর সবাই কোন না কোনভাবে পর্যটন, মাছের বা বন্দরের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এটি একাধারে পোতাশ্রয়ও। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রতট জুড়ে প্রায় হাজারখানেক হোটেল, এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স রয়েছে। আমাদের গাইড মাউরোর ভাষ্যমতে তারপরও ট্যুরিজম সীজনে সমুদ্রের পাড়ে দাড়ানোরও জায়গা থাকে না! তবে, মার ডেল প্লাটাকে দেখে মূল আর্জেন্টিনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া মুশ্কিল। কারণ আর্জেন্টিনা মূলত গ্রাম প্রধান দেশ, শহর প্রধান নয়। সোয়া চারকোটি লোক থাকে ১০ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে! নামের সঙ্গে রুপা থাকলেও (ল্যাটিন আর্জেন্টাম মানে রূপা) এখানে রুপার কোন পাহাড় নাই। ধারণা করা হয় রূপার পাহাড়ের লোভে স্প্যানিশরা এখানে ঘাটি গেড়েছিল। এবং সেই কারণে দেশটির নাম হয়েছে আর্জেন্টিনা। শীতপ্রধান দেশ বলে আমরা ঝাল কোন খাবারের কবলে পড়লাম না। সকাল, দুপুর, রাতে মিস্টির আধিক্য বেশি।
প্রথমদিনের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমাদের মহাসমুদ্রে বেড়াতে নিযে যাওয়া হয়। ছোট ইঞ্জিন নৌকা, তবে আমাদের এখানকার মতো খালি চোখে সরাসরি তাকিয়ে চালানো হয় না। অনেক যন্ত্রপাতি আছে দেখলাম! ঘন্টাঘানেক চলার পর বোঝা গেল প্রকৃতি বিরুপ। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল কিন্ত সমুদ্রে সেটা ঝড়ের রূপ নিল। ফলে আমরা বেশিদূর যেতে পারলাম না।নৌকার দুলুনিটা যথেষ্ঠ ভয়ের ছিল। তবে জাহাজের ক্যাম্টেন আমাদের বেড়ানোর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য নৌকা নিয়ে গেলেন সীলের খাড়িতে। মোটা, ভুটকু, শুকনা আর লম্বা একদল সীলকে দেখা গেল সমুদ্র পাড়ে ঘুরে বেড়াতে। বেশি কাছে না গেলেও সীলের বোটকা গন্ধ টের পেয়েছি সম্যকভাবে।
পরদিন সকালে ওদেরকে সমুদ্রের কথা বলার সময় ধনঞ্জয় জানতে চাইলো সাতার জানি কিনা।
সাব জিরো তাপমাত্রা আর আটলান্টিক মহাসাগর – জানলেই বা কী!
৪.
পরীক্ষার পরেই শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের সময়। প্রভিন্সিয়াল হোটেলের নিচতলায় দুইটি বড় কক্ষকে খেলাধুলার হলে পরিণত করা হয়েছে। একদিকে রয়েছে দাবার মতো মাথা ঘামানোর খেলা আর অন্য দিকে রয়েছে টেবিল টেনিস আর ফুটবলের আয়োজন। দুই রকমের ফুটবলই রয়েছে। সমুদ্রপাড়ে বীচ ফুটবল আর টেবিলে পুতুল দিয়ে টেবিল ফুটবল। আমাদের সৌরভ আর আবিদ বীচ ফুটবলে হেরে গেলেও ধনঞ্জয় টেবিল ফুটবলে রানার্সআপ হয়েছে। ছিল একটি মেকানিক্যাল ষাঁড়ও। এর ওপর চড়লে সেটি লাফাতে থাকে। আরোহীর কাজ হয় সেটি ধরে ধুরে থাকা। দ্রুত গতিতে ষাড়ের সওয়ারী হয়ে ধনঞ্জয় কপালের পাশে ব্যাথাও পেয়েছে। একটি অনেক বড় ছবি মেলানোর পাজলও ছিল। সবাই মিলে শেষ পর্যন্ত সেটি মেলানো শেষ হয়নি!
শিক্ষার্থীরা যখন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নানান আনন্দে মত্ত তখন পাশ্ববর্তী আর একটি হোটেলে আমরা তাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছি। আইওমওর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে দুই পক্স। স্ব স্ব দেশের দলনেতা আর উপদলনেতা আর আযোজক দেশের একদল মূল্যায়নকারী। তারপর দুই পক্ষ একমত হলে তবে সকলের নম্বর চূড়ান্ত হয়। আমাদের খাতা দেখা যখন শেষ হয় তখন দেখা গেল ধনঞ্জয় পেয়েছে ২৫, সৌরভ আর সফিউল্লাহ ১৫, মুগ্ধ ১১ এবং আদিব ৮। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিশ্চিত হযে গেলাম বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রৌপ্য পদক পেতে যাচ্ছে। তবে সৌরভ আর সফিউল্লাহ ব্রোঞ্চ পদক পাবে কিনা এই নিয়ে আমরা একটু ইদ্বিগ্নই ছিলাম। কারণ ১ নম্বরের জন্য মেডের না পাওয়াটা আমাদের ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত যখন সব দেশের খাতা দেখা শেষ হয়ে গেল তখন দেখা গেল সৌরভ আর শফিউল্লাহও ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। আর ১০০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান দাড়িয়েছে ৫৪ তম।
অন্যদিকে কযেকদিন মুখ লুকিয়ে থাকার পর মারডেল প্লাটা শহরে আমরা প্রথম সূর্য দেখি।তবে, সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে আলটান্টিকের ওপরের আকাশে দীপ্যমান হয়ে ছিল বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। দক্ষিণ গোলার্ধে আকাশ দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকমের সেটা এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকাতে আমি টের পেয়েছি। তবে, ভোরের আকাশে জ্বলজ্বলে তারাদের দেখার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম। পূবাকাশে খুব সহজে শুক্র আর বৃহস্পতিকে দেখা গেছে। চাদের উপস্থিতিও যথেষ্ট সমাদৃত। বিকেলের দিকে আটলান্টিকে রূপালী আভা দেখা যায়। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য!
এই ফাঁকে শীতের প্রকোপও কমে আসে। আগে রাতের দিকে তাপমাত্রা শূণ্যের কাছাকাছি নেমে আসলেও ১৪ তারিখ থেকে সেটি একটু বাড়তে থাকে। সুযোগ পেয়ে আমি শহর দেখতে বের হই। সমুদ্রতীরবর্তী শহরগুরো যেমন হয় মার ডেল প্লাটাও সেরকম। সারি সারি হোটেল বা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সঅ তবে, অনেক উচু ভবন নেই। কিন্তু হোটেলগুলো অনেক জায়গা নিয়ে রয়েছে। কখনো কখণো একটি ব্লকের পুরোটাই একটি হোটেল। প্রভিন্সিযাল হোটেলের পাশেই কেন্দ্রীয় অডিটরিয়াম। হাটতে গিয়ে পড়লাম এক রেলির মধ্যে! না, বেতন বাড়ানোর জন্য ওদের অডিটরিয়াম কর্মীদের আন্দোলন। তবে, মিছিলে বা সমাবেশে কোন শ্লোগান নেই। ব্যানার নিয়ে নিশব্দে দাড়ানো। আমি কাজে যেতে আমাকে একটা লিফলেট দিতে চাইলো। বলতে হল আমি স্প্যানিশ জানি না। তখন একজন ভাঙ্গাভাঙ্গা ইংরেজিতে তাদের বেতন বাড়ানোর কথা আমাকে বললো। নিরাপদ দূরত্বে পুলিশও আছে।
আমি আরো হাটতে হাটেত শহরে কেন্দ্রে চলে গেলাম। কয়েকটি সড়কজুড়ে ওদের বিপনীবিতানগুলো। সব ধরণের সাম্রগী পাওয়া যায়। বড় কযেকটি সুপার স্টোরও দেখলাম। তবে, ভয়ানক দাম। মাউরো বরলো এটা পর্যটন নগরী এবং ধণীরা এখানে বেড়াতে আসে বলে এই শহরে সব কিছুর দাম বেশি।
দুইদিন হাটতে হাটতে গেলাম আটলান্টিকে। সমুদ্রতটটি পরিস্কার। কংক্রিটের একটি পাটাতন তৈরি করে ক্রমশ সমুদ্রের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়। এই প্ল্যাটফর্মে হেটে সমুদ্রের অনেকখানি ভেতরে হেটে চরে যাওয়া যায়। এতে একটি চমৎকার াভিজ্ঞতা হয় যেটি াকমার অন্য কোথাও হয় নি। সব জায়গায় সমুদ্রের ঢেউ আমি দেখি সামনে থেকে। আমার দিকে সেটি তেরে আসে। কিন্তু এখানে সমুদ্রের ঢেউকে দেখা যায় পেছন থেকে। এই অভিজ্ঞতা আমার এবারই প্রথম। পাহাড় সমান ঢেউ যখন তটে আছড়ে পড়ছে তখন সেটিকে পেছন থেকে দেখতে পারাটা একটি অন্য রকম অনুভুতির। আমার স্মৃতি থেকে এটি সহজে হারাবে না।
শিক্ষার্থীরা যখন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নানান আনন্দে মত্ত তখন পাশ্ববর্তী আর একটি হোটেলে আমরা তাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছি। এই হোটেলের রুম থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যায়। আর আর এখানে এসে প্রথম টের পেলাম রূপা কাহিনী। কযেকদিন মুখ লুকিয়ে থাকার পর মার ডেল প্লাটা শহরে আমরা প্রথম সূর্য দেখি। তবে, সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে আলটান্টিকের ওপরের আকাশে দীপ্যমান হয়ে ছিল বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। চলার পথে চাঁদ সেখানে ত্রিভুজ রচনা করে। আর চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করতে থাকে আটলান্টিকের পানি। দূর থেকে মনে হয় রুপালী আভা! শুধু যে সকালে এই ঘটনা হয় তা নয়। এই বিচে সূর্যোদয় দেখা যায়, সূর্যাস্ত দেখা যায় না। কিন্তু বিকেলেও রূপালী আভা ছড়িয়ে পড়ে।
৫.
১৫ তারিখ ছিল পদক দেওয়ার আর সমাপ্তি টানার দিন। লাল সবুজের পতাকা জড়িয়ে রূপার পদক নেওয়াম জন্য মঞ্চে উঠেছে ধনঞ্জয়। সঙ্গে বাংলাদেশ। বিকেলে ৫৩তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে উজ্জ্বল মূহুর্ত। ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো রূপার পদক পেয়ে এবার তার দ্বিতীয় মাইরফলক স্পর্শিত হল। ধনঞ্জয়ের আগে পতাকা জড়িয়ে ব্রোঞ্জ পদক নিয়েছে আমাদের বাকী দুই পদক জয়ী সৌরভ দাশ ও নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। সেখানে পদক নিয়েছ আরো ২৭৪ জন। অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন আর্জেন্টিনার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং মার ডেল প্লাটা শহরের মেয়র। অলিম্পিয়াডে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থী ৪২ এ ৪২ নম্বর পেয়ে চৌকস নৈপুন্য দেখায়। তার সোনার পদক প্রদানের সময় অডিটরিয়ামে উপস্থিত সকলে দাড়িয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়।
এবারের আইওমওতে আমাদের সেরা অর্জন নিয়ে মনের আনন্দে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। রাতের পার্টিতে আমি বেশিক্ষণ থাকিনি। তবে শুনেছি ভোর রাত তিনটে পর্যন্ত আনন্দে মেতেছিল শতাধিক দেশের ছেলেমেয়েরা। পরদিন সকালে আমাদের ফিরতি যাত্রা শুরু হয়। আইওমও থেকে রুপার পদক জিতে আমরা আবার বুয়েনার্স আয়ার্সের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ১৫ জুলাই ভোরে। রাস্তায় আমার মনে পড়লো, আরে আর্জেন্টিনাতো কেবল মারাডোনা-মেসির দেশ নয়! এটিতো আমাদের চে গুয়েভারার জন্মস্থান। বিপ্লবী চের দেশে তাকে কেমন করে স্মরণ করে সেটি জানা দরকার। ততক্ষণে অবশ্য আমরা বুয়েনার্স আয়ার্সের এয়ারপোর্টে এসে পড়েছি। ভাবলাম এখানেই ভালভাবে খুজি। অন্তত কোন টি-শার্টে বা কোন চাবির রিঙ-এ এই বিপ্লবীকে পাওযা যাবে। তবে, তার কিছুই পাওয়া গেল না। তবে, শেষ বেলায় এসে মারাডোনার সন্ধান মিললো। মারাডোনার ক্লাব (মেসিরও কি? আমি জানি না!) বোকা জুনিয়র্সের একটি সুভ্যেনির শপ পাওয়া গেল! যাক, বাঁচলাম। মারাডোনা আর মেসির প্রভাব বুঝলাম তখন। যত জার্সি আছে সেগুলোর সবটির নম্বর ১০! তবে, ছবিওয়ালা কিছু নেই। কাউন্টারে বসা মজিলাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার মারাডোনার চেহারা আছে এমন কিছু দরকার। মহিলা কী ভাবলেন কী জানি। তবে, একটু পর বের করলেন একটি স্মারক মুদ্রা। মারাডোনার মুখচ্ছবিওয়ালা ঐ মুদ্রা বুক পকেটে নিয়ে উঠে পড়লাম দুবাইগামী বিমানে!
মুচো গ্রাসিয়াস!