পাটের জিন-নকশার উদঘাটক বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম : স্বপ্ন দেখো, তুমি পারবে
ঢাকার কেরানিগঞ্জ। নদীর পাড়ে ছোট্ট একখন্ড জমি। কিনারে একটি ছোট ঘর, এক কক্ষের। প্রায়শ দেখা যায় এক কিশোর ঐ জমিতে কী জানি খুঁজে ফেরে। দিনশেষে কিশোর যখন ঘরে ফেরে তখন তার আজলা ভরা থাকে নানা জাতের গাছ ও লতাগুল্ম । পরের কয়েকদিন ধরে একটার সঙ্গে আরেকটার মিল-অমিল খুঁজে দেখাটাই হতো ঐ কিশোরের কাজ। মাঝে মধ্যে নদীর পাড়ে কিংবা জংলার ধারে গাছের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকা কিশোরকে দেখতো আশেপাশের লোকেরা। বৃক্ষের অপার সৌন্দর্য আর রহস্য বুঝি তাকে মুগ্ধ করত। বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ যখনই কেরানীগঞ্জের ঐ জমিতে যেতেন যে করেই হোক ঐ কিশোর তার সঙ্গী হয়ে যেতো।
সেবার ব্যাপক বন্যা হলো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাবা জমিতে ঢ্যাঁড়সের বীজ লাগালেন। কয়েক মাস পরে দেখা গেল সেখানে বিশাল আকৃতির ঢ্যাঁড়স হয়েছে। আগে কখনো এত বড় ঢ্যাঁড়স হয়নি। অবাক হয়ে কিশোর ভাবে, বন্যার আগেও তো বাবা ঢ্যাঁড়সের চারা রোপণ করেছিলেন। তখন তো এত বড় ঢ্যাঁড়স জন্মায়নি! এবার এত বড় ঢ্যাঁড়স কীভাবে হলো? নিশ্চয়ই মাটি, পানি, বীজ সব মিলিয়ে এখানে এমন কোনো একটা ব্যাপার ঘটেছে, যা ফসলের চেহারা ও আকৃতিতে প্রভাব ফেলেছে।
কী করলে সারা বছর ওসব জায়গায় একই রকম ফসল পাওয়া সম্ভব, সে ব্যাপারে কিশোরের কৌতূহলী মন জেগে উঠল। শুরু হল এক সত্যানুসন্ধানের কাজ।
প্রত্যেক জীবিত প্রাণী, হোক সে মানুষ, জন্তু কিংবা উদ্ভিদ; সবার রয়েছে এক জেনেটিক নীলনকশা, জেনোম বা সংক্ষেপে জীন-নকশা। জীন হল বংশগতির একক যা বলে দেয় কেন কেও নীল-নয়না, কেনই বা কোন কোন পরিবারে ডায়াবেটিস রোগের প্রতাপ। তো এই জিনের নীল নকশা লেখা হয় ডিএনএ এবং ভাইরাসের বেলায় আরএনএ-তে। তার এই এই নকশাটি মাত্র চারটি – A, T, G, C রাসায়নিক অক্ষরেই লিখিত। এই নকশাটা বুঝতে পারলে বোঝা যায় কী কারনে আপেলর কাটলে পড়ে দ্রুত সেটি লাল হয়ে যায়, কেন আমরা বাবা-মার মতোন হয়েও ঠিক বাবা-মা নই কিংবা কাঠাল গাছে কেন আম হয় না! জীবনের এক পর্যায়ে এসে ঐদিনের এই কিশোর বুঝে ফেলে উদ্ভিদের ভাল-মন্দের খবর নিতে হলে তার জীন-নকশাটা জেনে নেওয়া ভাল। তখন থেকে সে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করলো এই নীল-নকশার উদঘাটক হিসাবে।
যেমন ধরা যাক পাটের কথা। পাটেরও আছে এক জেনোম। এই জিন-নকশায় লিখিত আছে পাটের পাটত্ব। আর পাটকে ভবিষ্যতের জন্য যুগোপযোগী এক সম্ভাবনাময় ফসলে পরিণত করার চাবিকাঠিও লুকিয়ে আছে এই নকশার ভেতরেই। পাটের এই নকশা ও প্রোগ্রামের কথা জানতে পারলে এমন পাট তৈরি করা যাবে, যার তন্তু হবে আরও অনেক সরু জাতের। সহজেই তাকে তুলা কিংবা উলের সঙ্গে মেশানো কিংবা সংগ্রহ করা যাবে। পাটের যে শোলা বা কাঠি আছে, তা দিয়ে তৈরি করা যাবে কাগজ অথবা বাড়িঘর বানানোর বিভিন্ন সরঞ্জাম। পাটের সব জিনের খবর পাওয়া গেলে আমাদের জন্য খুলে যাবে জিনভিত্তিক কাজের নতুন সব সম্ভাবনা। কাজে পরিনত বয়সে আমাদের কিশোর ভাবে তাঁকে এই পাটের নীল-নকশা জানতে হবে। তাতেই ফিরবে বাঙ্গালির সোনালী আঁশের ঐতিহ্য।
শুধু পাট নয়, এই ২০১৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে খুব বেশি উদ্ভিদের সম্পূর্ণ জিন-নকশা উন্মোচিত হয়নি। এর মধ্যে পেঁপে, রাবার, দুই ধরনের পাট আর ছত্রাক – অর্থাৎ পাঁচ পাঁচটি উদ্ভিদের জিন-নকশা উন্মোচনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন কেরানীগঞ্জের মাঠে ঘুরে বেড়ানো ঐ ভাবুক কিশোরটি। আমাদের দুর্ভাগ্য মাত্র ৬০ বছর বয়সে তিনি গত ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
ততদিনে বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্থায়ী আসন পেয়ে গেছেন আমাদের এই বিজ্ঞানী, মাকুসুদুল আলম।
ফরিদপুর থেকে হাওয়াই
ফরিদপুরের সন্তান ড. মাকসুদুল আলমের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (অধুনা বিজিবি) কর্মকর্তা। মা লিরিয়ান আহমেদ সমাজকর্মী ও শিক্ষক। মাকসুদ ঢাকায় গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর ভর্তি হলেন লয়ালপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশ তখন উত্তাল। যুদ্ধের দামামা দেশ জুড়ে। কাজে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ঢাকা ফেরৎ আসলেন।
আর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাকসুদের বাবা শহীদ হোন। আট ভাই-বোনের বিরাট সংসার নিয়ে বিপদে পড়ে যান তাঁদের মা লিরিয়ান আহমেদ। শুরু করেন শিক্ষকতা। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা শেষে ড. মাকসুদুল আলম বিশ্বের জিন-নকশার অন্যতম সেরা উদ্ঘাটক হওয়ার পর একদিন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রেরণার কথা। ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা।’ তখন বলেছিলেন ড. মাকসুদ। ‘তাঁর কাছ থেকেই আমি এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পেয়েছি। আর আমার শিক্ষকেরা আমাকে দেখিয়েছেন প্রকৃতির রহস্য-সন্ধানের চাবিকাঠি।’
লয়ালপুর থেকে মাকসুদ দেশে চলে এসেছেন। সেই সময় তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু বৃত্তি দেয়। তারই একটি পান মাকসুদ। চলে যান রাশিয়ায়। মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। হয়ে যান ড. মাকুসুদুল আলম। তারপর আবার জার্মানির বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট থেকে প্রাণরসায়নে পিএইচডি করেন। এরপর কর্মজীবন, গবেষণা।
প্রকৃতির অজানা রহস্যের সন্ধানে
মস্কোয় ড. মাকসুদ সংস্পর্শে আসেন ভ্লাদিমির পেট্রোভিচ মুলাচেভের। প্রাণরসায়নের নানা শাখায় পেট্রোভিচের রয়েছে অনেক অবদান। তাঁর কাছ থেকে আমাদের মাকসুদ জানতে পারেন, কীভাবে প্রকৃতির অজানা রহস্য সম্পর্কে ভাবতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয়। জার্মানিতে কাজ করার সুযোগ পান প্রাণরসায়নের অপর দুই দিকপাল ডিয়েটার ওয়েস্টারহেল্ট ও জেরাল্ড হেজেলবাউয়ের সঙ্গে।
ডিয়েটারের কাছে তিনি শেখেন কীভাবে অজানা বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করতে হয়, আর হেজেলবাউ ও লিন্ডা রন্ডালের কাছে তিনি ঋণী প্রকৃতির চমৎকার বিষয়গুলো কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, তা জানার জন্য।
এক আলাপচারিতায় আমাকে তিনি বলেন, ‘আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে আমি প্রাণরসায়নের এসব কীর্তিমান মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের কারণেই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে, প্রকৃতির অজানা রহস্য ভেদ করার কাজে আমি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।’ প্রকৃতির রহস্য সন্ধানকে তিনি যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি সেখানেই খুঁজে পেতেন নানা আনন্দ।
জীবনের উৎস সন্ধানে
জার্মানির পর তিনি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন বাইপ্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের সহযোগী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য ড. আলম ও তাঁর দলবলকে এক মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। এ সেন্টারে কাজ করার সময় ২০০০ সালে তিনি ও তাঁর আরেক সহকর্মী রেন্ডি লারসেন প্রাচীন জীবাণুতে মায়োগ্লোবিনের মতো এক নতুন ধরনের প্রোটিন আবিষ্কার করেন। মাংসপেশিতে বিদ্যমান মায়োগ্লোবিন ও রক্তের হিমোগ্লোবিন জীবদেহে অক্সিজেনের পরিবহন ও মজুদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ড. মাকসুদ ও ড. লারসেনের আবিষ্কৃত নতুন এই প্রোটিনের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারায় কীভাবে মায়োগ্লোবিন ও হিমোগ্লোবিনের সৃষ্টি হয়েছে, তার ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে।
‘১০০ থেকে ২০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন প্রাণীদের জন্য একসঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুই-ই ছিল।’ বলেন ড. মাকসুদ। কারণ অক্সিজেন একদিকে যেমন শক্তি সরবরাহ করতে পারে, আবার তা বিষাক্তও বটে। কাজেই সেই সময়কার অনুজীবদের মূল অভিযোজনই ছিল অক্সিজেনকে ঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে পারা। তাঁদের আবিষ্কৃত এই হিমোপ্রোটিনটি ঠিক এ কাজটিই করত।
হাওয়াইয়ান পেঁপের গল্প
ঢাকাইয়াদের কাছে যেমন গাজীপুরের পেঁপের আলাদা কদর, তেমনি পশ্চিমাদের কাছে হাওয়াইয়ান পেঁপের বিশেষ কদর। যুক্তরাষ্ট্রের ছোট দ্বীপরাজ্যটির দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থকরী ফল এই পেঁপে। ১৯৪০ সালের দিকে হাওয়াইয়ের বেশির ভাগ পেঁপের চাষ হতো ওয়াহু দ্বীপে। ১৯৪০ সালে সেখানে প্রথম রিংস্টোন ভাইরাসের সংক্রমণ হয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ওয়াহুর সম্পূর্ণ পেঁপেক্ষেত ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় সংক্রমণমুক্ত এলাকা পুনা দ্বীপে পেঁপের চাষ শুরু করা হয়। তবে বারবার এভাবে পেঁপেকে যে বাঁচানো যাবে না, তা বুঝে ফেলেন হাওয়াইয়ের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা শরণাপন্ন হন বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরা শুরু করেন রিংস্টোন ভাইরাস ঠেকানোর উপায় বের করার গবেষণা।
১৯৯২ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনবিজ্ঞানীরা রিংস্টোন ভাইরাস ঠেকানোর জিন খুঁজে পান। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পেঁপের জিন-নকশা (জেনোম) পরিবর্তন করে, সেখানে রিংস্টোন প্রতিরোধী জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ১৯৯২ সালে শুরু হয় ট্রায়াল। আর ঠিক সেই বছর পুনার পেঁপে আক্রান্ত হয় রিংস্টোন ভাইরাসে। পরবর্তী চার বছরে পুনার পেঁপের উত্পাদন কমে আসে অর্ধেকে। এর মধ্যে সফল হয় জেনিটিক্যালি মডিফায়েড পেঁপের পরীক্ষা। দেখা যায়, এ পেঁপে আক্রান্ত হয় না রিংস্টোন ভাইরাসে। মাঠে শুরু হয় নতুন পেঁপের চাষ, ১৯৯৮ সালে। আজ হাওয়াই দ্বীপের পেঁপে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে নয়, জাপানের মানুষের কাছেও অত্যন্ত উপাদেয়। আর হাওয়াই ফিরে পেয়েছে তার বাণিজ্য।
পেঁপের জিন–নকশা
তবে রিংস্টোন ভাইরাসের কীর্তি এবং তা সামলে ওঠার ঘটনা থেকে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় পেঁপের সম্পূর্ণ জিন-নকশা উদ্ঘাটনের। তৈরি হয় জেনোমিক্স ও প্রোটিওমিক্স বিভাগ। ২০০০ সালে বিভাগের দায়িত্ব দিতে খুঁজে নেওয়া হয় একজন তরুণ বিজ্ঞানীকে, যিনি বড় হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে উল্টো দিকের একটি দেশে। ড. মাকসুদুল আলম দায়িত্ব নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিভাগটি গড়ে তোলার। তৈরি করেন শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ইন্ট্রানেট এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনবিজ্ঞানীদের একটি নেটওয়ার্ক। ফলাফল—২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পেঁপের সম্পূর্ণ জিন-নকশার উন্মোচন!
আমারি বঁধুয়া আন বাড়ি যায় আমারি আঙ্গিনা দিয়া
পেঁপের জিন-নকশা উন্মোচনের পর বিজ্ঞানী মাকসুদ ভেবেছিলেন তিনি পাটের জিন-নকশা উন্মোচন করবেন। সে জন্য তিনি কয়েকবার বাংলাদেশেও আসেন। কিন্তু আমাদের দোনোমোনার ভেতর মালয়েশিয়া সরকার খুঁজে নেয় বিজ্ঞানী আলমকে। মালয়েশিয়ার দরকার রাবারের এই জিন-নকশা মালয়েশিয়াতেই উন্মোচন করা। কারণ এতে সেটির মেধাসম্পদ নিজেদের হবে। এরই মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াও তাদের কাজ শুরু করে। ফলে রাবারের জিন-নকশা উন্মোচন করার জন্য সময়ের সঙ্গে দৌড়াতে হয়েছে মাকসুদকে। এবং মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় রাবার জিনের ২০০ কোটি বেস-যুগলের নকশা উন্মোচিত হয়েছে মাকসুদ ও তাঁর দলের হাতে।
হায় পাট, সোনালী আঁশের পাট
রাবারের পর পাট নিয়ে মাকসুদের আফসোস আরও বাড়ে। পাট তো নিছক একটি উদ্ভিদ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সরকারি আনুকল্য ছাড়া্ই ২০০৮ সালে অন্যান্য বিজ্ঞানী এবং তথ্য প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে স্বপ্নযাত্রা নামে একটি উদ্যোগ নেন। এবং শুরু করেন পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের কাজ।
পাট হলো পৃথিবীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ তন্তুজ। পাট থেকে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক, পুনর্ব্যবহার্য এবং সর্বোপরি পচনশীল সেলুলোজ তন্তু। অবশ্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ তন্তুজ শস্য হলো তুলা। পৃথিবীর প্রধান পাট উত্পাদনকারী দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, রাশিয়া ও মিয়ানমার। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে উত্পন্ন হয় বিশ্বের ৯০ শতাংশ পাট।
প্রকৃতির জন্য ভয়াবহ সিনথেটিক প্লাস্টিকের তুলনায় পাট হলো সম্পূর্ণ সবুজ তন্তু। পাটের ৭৫ শতাংশ সেলুলোজ, ১১-১৪ শতাংশ লিগনিন ও ১২ শতাংশ জাইলিন। একরপ্রতি সেলুলোজ তন্তুজ উত্পাদন পাটের বেলায় সবচেয়ে বেশি, যা কাগজ ও জৈব জ্বালানি উত্পাদনে ব্যবহূত হতে পারে। পাটের পাতা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহূত হয় (আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও কৃমির সংক্রমণ রোধে দারুণ কার্যকর)। এ ছাড়া পাটের পাতা ভিটামিনসমৃদ্ধও বটে। চীন ও ভারতের দ্রুত বিকাশের কারণে প্যাকেজিং, কাগজ ও নির্মাণশিল্পে কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা পাটের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশের ক্ষতি ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়ছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে পাটের উন্নয়ন
ধান বা অন্য অনেক শস্যের সঙ্গে পাটের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো, প্রকৃতিতে এর জাতের সংখ্যা কম। বিশ্বে লাখখানেক জাতের ধান আছে। এর কোনোটি লবণ-সহনশীল, কোনোটি খরাপ্রতিরোধী ইত্যাদি। ফলে একটির গুণ অন্যটিতে ঢুকিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা যায়। কিন্তু পাটের বেলায় সে সুযোগ কম, কারণ জাত কম। ‘কাজেই পাটের উত্পাদন বাড়ানোসহ এ নিয়ে যা কিছুই করতে চাই না কেন, আমাদের জিনকৌশলের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হবে।’ সে সময় একদিন আমাকে বলেছিলেন মাকসুদ। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দরকার জেনেটিক্যালি উন্নত জাত ও সহায়ক পরিবেশ।’
পাটের জিন-নকশা উন্মোচন এবং নতুন জাতের পাট
২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল – পেঁপের পর রাবারের জিন–নকশা উন্মোচন করলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। উন্মোচিত হোক আমাদের পাটের জিন–নকশা। সেই প্রতিবেদন পড়ে তখনকার কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ফোন করে দেশে আসতে বলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমকে এবং তারপর শুরু হয়ে আমাদের পাটের স্বপ্ন যাত্রা।
মাকসুদুলের নেতৃত্বে তোষা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন হয় ২০১০ সালে। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া পাটের দুটি প্রধান জাতের মধ্যে এটি একটি। ২০১২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে উন্মোচিত হয় পাটের জন্য ক্ষতিকর একধরনের ছত্রাকের জীন-নকশা। আর ২০১৩ সালে উন্মোচিত হয় সাদা পাটের জিন-নকশা। বলা যেতে পারে নতুন জাতের পাট উদ্ভাবনের ভিত্তির কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
পাটের সম্পূর্ণ জিন-নকশা উন্মোচনের পর এখন আমাদের দরকার নতুন জাতের পাটের উদ্ভাবন। কম পানিতে জাগ দেওয়া যাবে, তন্তু অনেকটা উলের মত মিহি হবে কিংবা পাটখড়ি দিয়েই বানানো যাবে আসবাব। এই কাজটাই শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। কিন্তু কাজ মাঝখানে রেখে তাঁকে চলে যেতে হল। নতুনদের ঘাড়ে সেই দায়িত্বটা তিনি দিয়ে গেলেন, যাদের ওপর তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস। যে কারণে স্বপ্নযাত্রা দলে ছিল একদল নবীন বিজ্ঞানী।
‘স্বপ্ন দেখো, তুমি পারবে’
ড. মাকসুদুল আলমের সবচেয়ে বড় আশাবাদ ছিল আমাদের তরুনরা। তিনি প্রায়শ তাদের প্রশংসা করে বলতেন “ওরাই আমাদের দেশকে একদিন বদলে দেবে।”
কয়েক বছর আগে একদিন নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি স্বপ্ন দেখতে পারো, তাহলে তা তুমি করতেও পারবে। কাউকে তোমার স্বপ্ন ধ্বংস করতে দেবে না। নিজের অনুভূতিকে মর্যাদা দাও, পরিশ্রম করো। যাদের সহায়তা পাবে, সবাইকে ধন্যবাদ দাও। প্রকৃতির অজানা রহস্যের সন্ধান তুমি পাবে।
স্বপ্ন দেখো, তুমি পারবেই।’