মাহমুদের জন্য এলিজি
চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব-এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে আমার নানান জনের সঙ্গে পরিচয়, সখ্যতা এবং শত্রুতা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই হয় উদ্যোক্তা হয়েছেন অথবা হবেন। এদের মধ্যে কেও কেও একেবারে ভিন্ন রকম। ভিন্ন ধারার লোকদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদ, মাহমুদ হাসান খান।
গ্রুপের কারণে তার পোস্ট, তার লেখা এবং তার সম্পর্কে নানান কথা আমি জেনেছি। তার কাজের ধরণ সম্পর্কেও জানতাম। অবাকও হতাম। ২০১৪ সালে আমরা গ্রুপের উদ্যোক্তা সম্মাননাতে একটি বিশেষ সম্মাননা চালু করার সিদ্ধান্ত নেই। এটি আমাদের আউট অব বক্স উদ্যোক্তা নুরুল কাদেরের নামে, নুরুল কাদের সম্মাননা। বলা হল এমন একজনকে আমরা সম্মাননাটা দেবো যিনি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও একটা নতুন কিছু করেছেন, সেক্টর পুরানো হতে পারে।
প্রথম বছরের সম্মাননার জন্য নাম খুঁজতে আমাদের তেমন একটা কষ্ট হয়নি কারণ মাহমুদ হাসান।
মাহমুদ হাসান খান ট্রিপ টু বাংলাদেশ নামে একটি ট্যুর কোম্পানী চালাতেন, গতকাল পর্যন্ত। মুলত এটি ট্যুর অপারেটিং কোম্পানী হলেও এর মূল কাজ বাংলাদেশে আসা বিদেশি পর্যটকদের নানান রকম সেবা দেওয়া। এবং কখনো কখনো সেটি টাকা-পয়সা ছাড়া। মাহমুদ আমাদের দেশের পর্যটনের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছেন, গ্রাম বাংলা ট্যুরিজম। মুলত গ্রাম বাংলাকেই প্রমোট করে থাকেন। বিদেশী অতিথিকে বরিশালের খালবিলগুলোতে সারাদিনের ট্যুর করাতে নিয়ে যান আর গ্রামের একটা গৃহস্ত বাড়িতে ১-২ দিন রাখার ব্যবস্থা করেন। অতিথিদেরকে বিনামুল্যে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকেন। যেমন- তাদের ট্রিপ প্লান করে দেওয়া, ট্রেন বাস টিকেট বুক করা, হোটেল রিজারভেশন, সবই। এসব কাজই করা হয় কোনপ্রকার অতিরিক্ত চার্জ ছাড়া। ট্যুরিষ্টদের পঠিয়ে দেশের অপরিচিত ট্যুরিষ্ট স্পটগুলো আস্তে আস্তে পরিচিত করার কাজটা করেছেন। একান্ত মমতার সঙ্গে।
কাজটা শুরু করেছিলেন প্রায় ১৪ বছর আগে, ২০০২ সালে। সে সময় শামস হাশমি নামে এক ভারতীয় জাহাজী ভদ্রলোকের একটা ই-মেইল পান মাহমুদ। ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে আসবেন। কোথায় থাকবেন ইত্যাদি বিষয়ে যদি মাহমুদ সাহায্য করতে পারেন। ঘটনা সম্পর্কে মাহমুদ পরে লিখেছেন – আমি তাকে আমার বাসায় থাকার আমন্ত্রন জানালাম। উনি এলেন এবং ৭ দিন আমার বাসায় থাকলেন। হাশমির মাধ্যমে মাহমুদ জানতে পারেন বাংলাদেশ নিয়ে ইন্টারনেট জগতে খুব একটা আপডেটেড তথ্য নেই। তার অনুরোধে মাহমুদ ভার্চুয়াল ট্যুরিষ্ট, লোনলি প্লানেটের ট্রাভেল ফোরামে বাংলাদেশ নিয়ে আপডেটেড তথ্য দেওয়া শুরু করেন। আর এভাবে শুরু হয় এক নতুন পথযাত্রা। পর্যটকদের কাছে নিজের দেশকে তুলে ধরা।
সেই কাজটা তিনি কেমন করতেন?
অস্ট্রেলীয় একজন পর্যটক র্যাচেল তার ব্লগে এই মানুষটির কথা লিখেছন। ‘ট্রাভেলিং ইন বাংলাদেশ, এইট মাস্ট ডু থিংস’ শিরোনামের ব্লগের দ্বিতীয় আইটেম হলো – মিট মাহমুদ। সেখানে তিনি লিখেছেন -If you’re going to Bangladesh and haven’t yet come across Mr Mahmud then please let me introduce you! Mahmud is your answer to everything. He is a business man who is passionate about his country. He is especially enthusiastic about assisting those who travel to his home country. He isn’t after your money. He doesn’t charge a fee. He does everything he does out of the goodness of his heart and his passion for Bangladesh. Mahmud can help you organise bus, train or boat tickets (a must in Bangladesh as they are often sold out!). He can give sound advice on your itinerary. He can organise pick ups for you, accommodation and so much more. He is a frequent visitor to the Lonely Planet Thorn Tree Forum (this is where I first met him). I was lucky enough to even stay at his house and go on a four day Sundurban boat cruise with Mahmud, his wife and son AND thirty of his Bangladeshi friends. A trip to Bangladesh is made so much easier with Mahmud. Utilise him! And if possible meet up with whilst you are in Dhaka.
বোঝায় যাচ্ছে বিভিন্ন ফোরামে মাহমুদের বিনয়ী তৎপরতা ব্যাক-পেকারদের বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে।
“এসব ট্রাভেলাররা ঢাকা এসেই আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমরা একসাথে চা খাই, আমার বাসায় মাঝে মাঝে ডিনার করাই, তাদের ট্রিপ প্লান করে দেই, ট্রেন-রকেটের টিকেট করে রাখি এমনকি মাঝে মাঝে গ্রামীন ব্যাংক এ গিয়ে তাদের ইন্টার্নশীপ রিকোয়েষ্ট এর কি অবস্থা সেটারও খোজ নিয়ে দেই। আর কাপল বা শুধু সলো ফিমেল ট্রাভেলার হলে আমার বাসায় ফ্রি রাখি ৩/৪ দিন। একটি রুম আলাদা রাখা আছে এদের জন্য। এতে কোন প্রকার টাকা নেইনি। নিজের চাকরীর ফাকে ফাকে এটা করতাম। এভাবে আমি ১৩ বছরে প্রায় ৫০০০ বিদেশী ট্রাভেলারদের সাথে মিশেছি, সাহায্য করেছি তাদের।”- মাহমুদ লিখেছেন।
২০০৯ এর দিকে মাহমুদের মাথায় হঠাত করেই বরিশালের অসাধারন সুন্দর খাল-নদীগুলোকে নিয়ে কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় আসে। যে চিন্তা সে কাজ। পরীক্ষামুলকভাবে জার্মানীর কয়েকজন ট্রাভেলারকে বরিশাল পাঠিয়ে দেখা গেল তারা “জীবনের অন্যতম সেরা ভ্রমণটা” করেছে। তারপর থেকে বরিশালের ট্যুরটা তার কাজের একটা অংশ হয়ে দাড়ায়। ২০১২ সালে ট্রিপ টু বাংলাদেশ গঠনের পর এটার নাম দেন কেরালার ব্যাকওয়াটারের আদলে “বরিশাল ব্যাকওয়াটার এন্ড ভিলেজ ট্যুর”।
বলা যায় মাহমুদ বাঙলাদেশ রেসপন্সিবল ট্যুরিজমের ব্যাপারটাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়েছেন। মাহমুদের পথ দেখানোর আগে আমাদের ট্যুরিজমের বড় অংশই হল কক্সবাজার, রাতারগুল, কুয়াকাটা, সিলেট কেন্দ্রিক। সেখান থেকে অপরিচিত স্পটগুলোকে পরিচিত করানোর কাজটা মাহমুদ শুরু করেন। শুধু তাই না, গ্রাম বাংলার বাড়িঘরও যে ব্যাপপেকারদের থাকার জায়গা হতে পারে এটাই বা তাঁর আগে কে চিন্তা করেছে।
নিজের সম্পর্ক মাহমুদ যা বলতো সেটাই যদি আমাদের উদ্যোক্তারা মনে রাখে তাহলে হয়তো তাকে স্মরণ রাখতে আমরা পারবো- কারো দিকে না তাকিয়ে, কে কি দিলো, সরকার কি দিলো সেদিকে না দেখে নিজের কাজ নিজের মতো করে যাই, সাফল্য নিজেই ধরা দেবে। একদিন।
আল্লাহ মাহমুদকে বেহেস্ত নসীব করুন।