বই-এর জন্য ভালবাসা
বাদল বসু তার ‘পিওন থেকে প্রকাশক’ বই-এ সাগরময় ঘোষের উদ্ধৃতি দিয়ে এই গল্পটা লিখেছেন, “এক প্রকাশকের বাসায় ব্যপক খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সবাই কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছেন। দেখা গেল, এক লেখক মোটেই মাংস খাচ্ছেন না। তখন বিনীত প্রকাশক কারণ জানতে চাওয়াতে তিনি ফিসফিস করে জানতে চান, “মাংসটা কোন লেখকের”।
গল্পটা নিজ-ব্যাখ্যাতো। তারপর ও যারা আগের দিনের প্রকাশকদের সঙ্গে লেখকদের সম্পর্কটা জানেন না তাদের অনেকেই গল্পটা ধরতে পারবেন না। এর মানে হল বেশিরভাগ প্রকাশকই লেখককে ঠিকমতো রয়্যালটি দেন না! কয়েকবছর আগে জাফর স্যার এ দেশে ে্কটা উদ্যোগ নিয়ে একন লেখক-প্রকাশক চুক্তির ব্যাপারটা সামনে এনেছেন।
আজ বই দিবসে এ কথা তোলার কারণ হলো আমি অনেক লেখকের কাছ থেকে এই অভিযোগ শুনেছি। আমার নিজের ধারণা আমার প্রকাশকদের কয়েকজন আমার সঙ্গেও এ কাজ আনন্দের সঙ্গে করেন। কাজে এ দেশে হয়তো গল্পটা অনেক বেশি সত্য।
তারপরও এদেশের প্রকাশকরা বই বের করেন। এমন বই বের করেন যা হয়তো সাকল্যে ১০০ কপি বিক্রি হয়। তবুও তারা বই প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের প্রকাশনা এখনও শিল্প হয়ে উঠেনি। যে কোন শিল্পের একটা বড় অংশ হলো বিপনন, মার্কেটিং। আমাদের দেশে বই-এর বিপনন কেমন জানি। কেবল ফেব্রুয়ারি মাসে পত্রিকায়, বিশেষ করে, সাহিত্য পাতায় বিজ্ঞাপন দেওয়া। ফেসবুক আসার পরে কিছু ফেসবুক বিজ্ঞাপন। ইদানীং কিছু পোস্টারও দেখা যায়।
আমার গল্পে গল্পে ধাঁধা আর ধাঁধায় ধাঁথায় গল্প প্রকাশের পর আমি একটা লিফলেট করে সেটা বিভিন্ন স্কুলের সামনে বিতরণ করতাম, লোক দিয়ে! তারপরও ঐ বই দুটি গোটা পাচেক সংস্করনের বেশি বের হয়নি।
হুমায়ুন আহমেদ বা জাফর স্যারের বই-এর মতো আর কারও বই-এর সেরকম বিক্রি নেই। বিক্রি নেই বলে প্রকাশকদের কোন সম্পাদক নেই। আমাদের দেশই মনে হয় একমাত্র দেশ যেখানে সম্পাদনা ছাড়াই যে কোন বই প্রকাশিত হয়। আমি একবার এক বিখ্যাত লেখকরে বইতে ৩৯কে মৌলিক সংখ্যা, ১২কে পারফেক্ট সংখ্যা ইত্যাদি হিসাবে পড়েছি। পড়ে অবাক হয়েছে। একটা প্রতিবাদ পত্র লিখতে চেয়েছি। পরে, এক স্যার বললেন, “ঐটাতো গণিতের বই না। বাদ দাও”। তো বাদই দিয়েছি।
গত কয়েকমাস আমি বই নিয়ে ভাবছি। ভাবছি কেমন করে দেশে বই-এর বিক্রি বাড়ানো যায়। কীভাবে লোকজন বেশি করে বই পড়ে। মুদ্রিত কিংবা অমুদ্রিত। সেটা করতে গিয়ে কয়েকটা বিষয় ভাল মতো বুজতে পেরেছি। যেমন – বই কেবল ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। বেশির ভাগ বিক্রতা বই বিক্রির টাকা প্রকাশককে দেন না। ফলে তারাও আর বাকীতে বই দেন না। বিক্রেতা নিশ্চিত না হয়ে বই তখন বাংলা বাজার থেকে কেনে না।
আগে গল্পের বই সবচেয়ে বেশি কিনে দিতেন বাবারা। বাবারা বই-এর দোকানে যেতেন ছেলে-মেয়েদের স্কুলের বই কিনে দিতে, গ্রামার বই কিনে দিতে। এখন সেটা যাওয়া লাগে না। কারণ পাঠ্যপুস্তক স্কুল থেকেই সরকার দিয়ে দেয়। আর গ্রামার বই কোনটা পড়তে হবে সেটাও স্কুল ঠিক করে দেয়। খাতা-পত্রও আজকাল স্কুল থেকে কিনতে হয়। ফলে, বাবাদের বই-এর দোকানে যাওয়া বন্ধই বলা চলে।
আবার জন্মদিনে বই উপহার দেওয়ার চলটাও উটে যাচ্ছে কারণ বেশিরভাগ মার্কেটে কোন বই-এর দোকান নাই। আগে সব মার্কেটেই বই-এর দোকান ছিল। আর পাড়াতে একটা বই-এর দোকানতো ছিলই। এখন সেগুলো উঠে গেছে। একদলের বক্তব্য হলো , “বই কেউ কেনে না।“ আর একদল বলছে দোকান নাই বলে বই কেনে না।
বর্তমানে ঢাকা শহরে একটি ৪ জনের মধ্যবিত্ত পরিবার মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা হাবিজাবি-ফার্স্ট ফুডের পেছনে খরচ করে। সেই পরিবার মাসে একটা বই-ও কেন না। এমন কী আমি অনেক পরিবারকে দেখেছি যাদের বাসায় পত্রিকাও রাকা হয় না কারণ “এখন পত্রিকার দাম বেশি। মাসে ৩০০ টাকা খরচ হয়।“ এ দলের লোকেরা মাত্র ৯০০ টাকায় একটা পিৎজা খেয়ে ফেলে।
এগুলো সব নেগেটিভ দিক। তবে, এর উল্টোপথের সারথিরা আছে। এ যেমন সাভারের একদল ছাত্র। ওরা বইজান্তা ডট কম নামে একটা বই পড়ার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে। সেখানে সবাই বই পড়ে। তবে, ওরা কেবল বই পড়াতেই ক্ষান্ত দেয়নি। মাস খানেক আগে, তাদেরই একজন, ফেসবুকে আমাকে জানায় তারা সাভারে একটা বই মেলা করতে চায়। কিভাবে করবে সেটা তারা জানে না তাই তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
আমি প্রতিদিনই এরকম কোন না কোন প্রস্তাব, ধারণার কথা শুনি। আমার একটা এসিড টেস্ট আছে। আমি প্রথমেই সেটা করি। ওরা সেই টেস্ট পার হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলো। ওরা কেউ পড়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ ড্যাফোডিলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও মনে হয়। ওরা এসে যা জানালো তা হলো সাভার ঢাকার খুব কাছে হলেও সেখানে কখনো বই মেলা হয়নি। ওরা একটা বই মেলা করতে চায়। আর সেটা করতে চায় বাংলা নববর্ষে! আমি সানন্দে ওদের সাহায্য করলাম। ওরা প্রথমা প্রকাশনী আর আদর্শ প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলো। তারপর তারা মেলার আয়োজন করলো।
গত ১৬ এপ্রিল আমি সেখানে গিয়েছি। বিরাট আয়োজন। ২১টি পুস্তুক প্রকাশনা সংস্থা সেখানে স্টল ুলে বই বিক্রি করছে। কম-বেশি বই ব্রিক্রি হয়েছে। তাম্রলিপি প্রকাশনির রনি জানালো তার খরচ উঠেছে!
ওখানে ঐ ছেলেগুলোর একজনের বাবা আমাকে জানালেন – গত কয়দিন ওরা প্রতি রাতে মেলা পাহাড়া দিয়েছে যাতে কোন বই বিক্রি না হয়। পুরো সাভারে মাইকিং করেছে। নিজেরা একটি গানও লিখেছে যার মূর মন্ত্র হলো , “জ্ঞানের মূচ্ছর্ণা ছড়ি দাও।“
তোহা, কামরুল , ফাইজুল নামের এই তরুনেরা তাদের টিউশনির টাকা জমিয়ে এই মেলাটা করেছে, কোন স্পন্সর পায়নি এবং স্টলও ছিল বিনে পয়সায়। অনেক ধার দেনা করেছে যা আস্তে ধীরে শোধ করবে। “অসুবিধা হবে না স্যার, ছাত্র পড়ানো বাড়িয়ে দেবো”।
এই মেলাটা ওরা প্রতিবছরই করতে চায়। সে সঙ্গে গড়ে তুলতে চায় একটা মনের মতো পাঠাগার। একটা কক্ষ পেলেই পাঠাগারের কাজটা শুরু করবে। আমি ওদের পাঠাগারের জন্য বই জোগাড় করার কাজটা শুরু করেছি।
আমd গণিত অলিম্পিয়াড করি, বিজ্ঞান নিয়ে সারাদেশে যাই, তরুনদের উদ্যোক্তা হতে বলি। অনেকে আমার পঞ্চাশোর্ধ জীবনের প্রাণশক্তির রহস্য জানতে চায়। আমি গৌরবের সঙ্গে তোহা, কামরুলদের কথা বলি।
এ দেশ একদিন ওরাই সোনার বাংলা বানাবে।
আমার এবারের বই দিবসটি আমি আমার সাভারের বইজান্তাদের উৎসর্গ করেছি।
তাদের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।