শেরিল স্যান্ডবার্গ ও বিশ্বের মেয়েরা
কবি কাজী নজরুলের কথা দিয়েই এই বইটির আলোচনা শুরু হতে পারে। “পৃথিবীতে যা কিছু মহান চির কল্যানকর, অর্থেক তার আনিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। তবে, প্রশ্ন হচ্ছে যে সত্যটি কবি সহজে দেখতে পেয়েছেন সেটি এখন কী আমরা সহজে দেখি? বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে নারীদের এখনো অন্ত:পুরে বেঁধে রাখার নানান তরিকা সেখানকার কথা না হয় বাদ দেই। কিন্তু আমেরিকার মতো উন্নত দেশে নারী কি সকল ক্ষেত্রে “অর্ধেক” হতে পারছে?
টাইম সাময়িকীর দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ের বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০ নারীর অন্যতম শেরিল স্যাণ্ডবার্গও এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে চেয়েছেন। জনপ্রিয় সামাজিক যোগোযোগ সাইট ফেসবুকের শীর্ষ পরিচালন কর্মকর্তা ও ধনকুবের শেরিলের পক্ষে আমেরিকার কর্মক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান, শীর্ষারোহন এবং কর্মক্ষেত্রের ভোগান্তির চিত্র কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আর তার ফলে তার বিশ্লেষণগুলোকে মেনে নেওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। আমেরিকার প্রেক্ষাপটে শেরিলের লেখা আবর্তিত হলেও এর সাধারণীকরণগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক, বিশ্বের প্রায় দেশের তুলনায়।
আমরেকিার কলেজগুলোতে মেয়েদের গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলেদের সমান সংখ্যক হয়েছে প্রায় ৩০ বছর আগে। কিন্তু এখনো সিদ্ধান্তগ্রহণ, নীতি নির্ধারণ, এমনকী বেসরকারি পর্যায়ে শীর্ষ নেতৃত্বে মেয়েদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। এর কারণ কী?
প্রতিযোগিতার সমান সুযোগের অভাব যেমন এর জন্য দায়ী তেমনি সামাজিক রীতিনীতি এবং সংসার-কর্মের মেলবন্ধনের ব্যাপারটাও এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে।
বইটি শুরু হয়েছে শেরিলের প্রথম মা হওয়ার সময়ের কষ্টের বর্ণনা দিয়ে। ২০০৪ সালে শেরিল গুগলের অনলাইন বেচাবিক্রি দেখতেন। সেই সময়ে গুগলের পার্কিং লটে গর্ভবতী কর্মীদের জন্য আলাদা কোন জায়গা বরাদ্দ ছিল না। ফলে, শেরিলকে দীর্ঘ পথ হেটে অফিসে আসতে হতো। অথচ একই সময়ে প্রতিদ্বন্ধী সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহুতে গর্ভবতী কর্মীদের জন্য প্রত্যেক ভবনের সামনেই গাড়ি রাখার জায়গা ছিল। স্বামী ডেভের কাছে এই তথ্য জেনে পরদিন শেরিল গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই বিনকে জানায়। সের্গেই সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয় এবং জানায় যে, এর আগে তিনি বিষয়টি নিয়ে কখনো ভাবেননি! মজার কথা হল, নিজে গর্ভবতী হওয়ার আগ পর্যন্ত শেরিল নিজেও কিন্তু এই বিষয়টি ভাবেননি। এই ঘটনা থেকে শেরিলের উপলব্দি হচ্ছে আমাদের সমাজ এখনো নারীর ভাল-মন্দের বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে ভাবে না, যদি না কেও তাদের ভাবতে বাধ্য করে।
তবে, শেরিল দেখেছেন কেবল পারিপার্শ্বিকতা নয়, ওপরে না যাওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে খোদ নারীদের মধ্যেই। অনেক নারীই একটি পর্যায়ের পর আর যেতে চান না। এমনকী নিজের অবস্থান সম্পর্কেও তারা সচেতন নন। মিটিং কিংবা পার্টিতে মেয়েদের দেখা যায় মূলকেন্দ্র থেকে দূরে থাকতে কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে মেতে থাকতে যেন বা “টেবিলে বসাতে তাদের ঘোরতর আপত্তি”।
এই বইতে শেরিল নারীর নেতৃত্ব বিকাশে পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো গভীরভাবে খুটিয়ে দেখেছেন। স্বভাবজাত মার্কিনীদের মতো তাঁর প্রতিটি তথ্য পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে উপস্থাপন করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং নিজের চরপাশের সঙ্গে তুলে ধরেছেন গবেষণার তথ্য, ফলাফল এবং ব্যখ্যা করেছেন নিজের মত করে।
এই বইতে মোট ১১টি অধ্যায় রয়েছে। নাম থেকেই এগুলোর ভেতরকার বিষয়টি সহজে বোঝা যায় – দি লিডারশিপ এম্বিশন গ্যাপ, সিট ইন দি টেবল, সাসেস এন্ড লাইকাবিলিটি, ইট’স ও জাঙ্গল জিম নট এ লেডার, আর ইউ মাই মেন্টর, সিক একন্ড স্পিক দি ট্রুথ, মেইক ইয়োর পার্টনার এ রিয়েল পার্টনার, দি মিথ অব ডুয়িং ইট অল, লে৫টস স্টার্ট টকিং এবাউট ইট এবং ওয়ার্কিং টুগেটদার টুওয়ার্ড ইকুয়ালিটি।
সংসার ও কর্মের মধ্যে কেমন করে ব্যালান্স করে এগিয়ে যেতে হয় সেটিও এই বই-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য নিজের নারীত্ব বা মাতৃত্বকে বিসর্জন দেওয়ার কথা শেরিল বলেননি। বলেননি বলে এই বইটির প্রতি আমার আকর্ষন বেড়েছে এবং শেরিলকে মনে হয়েছে “অপ্রথাগত নারীবাদী”। ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে অনেকেই ঠিকমতো মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারে না। এটিরও বিরোধিতা করেছেন শেরিল। বলেছেন নেতৃত্বের বিকাশে এবং পুরষ সহকর্মীদের নেতৃত্ব দেওয়ার সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই। পাশাপাশি সংসারের সঙ্গীকে নিজের ভালমন্দ বোঝানোর ব্যাপারটিতেও তিনি জোর দিয়েছেন। তবে, সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে নারীদের ভয়েস তুলে ধরার ব্যাপারে। শেরিল মনে করেন, তাঁর আগেও গুগলে তার সহকর্মী কয়েকজন মা হয়েছেন কিন্তু তারা তাদের কষ্টের কথা টপ ম্যানেজমেন্টকে জানায়নি বলে ঘটনাটা নিজের বেলায় এসেছে। এবং শেরিল উচ্চকণ্ঠ না হলে আরো অনেকদিন সেটি ঘটতে থাকতো!
পড়াশোনার ক্ষেত্রে এখনো অনেক মেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলো নিতে চাননা। কিন্ত, শেরিল তথ্য উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন “যা কিছু পারে নর, তার সবটুকুই পারে নারী”। এমন কী কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের সমগোত্রীয় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে থাকে।
তারপরও কেন মেয়েরা কাঙ্খিত পজিশনে যেতে পারে না?
কারণ অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের আপন শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। নিজেদের অন্তর্নিহিত সত্য ও শক্তিকে তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে পারিপার্শ্বিকতার বাঘ তাদের মনের বাঘকে আরো শক্তিশালী করে ফেলে। ফলে তারা “যা পায়” তাতেই খুশি থাকে।
কাজে উচ্চকন্ঠ হওয়ার পাশাপাশি নিজের শক্তিসামর্থকে শাণিত করতে না পারলে বিশ্বব্যাপী নারীর এগিয়ে যাওয়া ক্রমাগত হোচট খেতেই থাকবে।
2 Replies to “শেরিল স্যান্ডবার্গ ও বিশ্বের মেয়েরা”