কবিতা পড়াটা কখনো কখনো খুবই আনন্দের হয়
ছোটবেলায় কবিতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। যতদূর মনে পড়ে প্রত্যেক ক্লাসেই একটা না একটা কবিতা পরীক্ষার জন্য মুখস্ত করতে হতো। বাংলা ব্যাকরণও আমি ছোটবেলায় না বুঝে পড়েছি যতোদিন না তাহের স্যারের ছাত্র হয়েছি। ওনার কল্যানে বাংলা ব্যাকরণের ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে, কবিতার যন্ত্রণা ছিলই।
কিছুদিন পরে আবিস্কার করলাম যারা কবিতা আবৃত্তি করতে পারে বা গড় গড় করে বলতে পারে তাদের একটা আলাদা ভাব। কোন আত্মীয়স্বজন বাসায় আসলে আমাদের এই পরীক্ষা দেওয়া লাগতো। শেষমেষ দেখলাম এ থেকে বাঁচার একটা রাস্তা। কয়েকদিন চেষ্টা করে মুখস্ত করে ফেললাম-
এতোক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে
জানিনু আসি কেমনে পশিল লক্ষ্নণ রক্ষপুরে
হায় তাত; উচিত কী তব একাজ
নিকষা সতি তোমার জননী, সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ
শুলীসম্ভুনিবু ভ্রাতস্পুত্র বাসব বিজয়ী!!!
আমি এটুক আসতে আসতেই শ্রোতারা আতকে উঠতেন। বলতেন – বাবা, থাক থাক। এতো কষ্ট করতে হবে না। আমিও বেঁচে যেতাম। যদিও ঔটুকুর পরের লাইন আমি জানতাম না।
কবিতা পড়ার কথা মাথায় আসলো যখন আউল্লা থেকে বাংলা মোটর আমার নিত্য যাতায়াত। তখন অনেক কবিতার বই পড়ে ফেললাম। কোনটাই মনে হয় বুঝিনি। কিন্ত জাতে থাকার জন্য সোনালি কাবিন কিনে বালিশের পাশে রেখে দিলাম। মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে দেখি!!!
সেই সময় কে জানি একদিন খবর দিল আর্নেস্ত্রো কার্দেনাল নামে নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রীও কবি। তার কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছে কে জানি।
আরে দেখলাম ওখানে অনেক কবিতা আছে যেগুলো চিঠি লেখার সময় কাজে লাগে। ব্যাস সোনালী কাবিনের পাশে কার্দেনাল। বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনাও ছিল।
যদি তুমি ঢাকায় থাকো
ঢাকায় শুধু তোমাকেই দেখি
তুমি যখন ঢাকায় থাকো না,
ঢাকায় আমি কাউকে দেখিনা।
চিন্তা করুন। এমন লাইন যদি আপনি কাউকে লিখে পাঠান তাহলে তার কী অবস্থা হতে পারে?
কাজেই অচিরেই হলে আমার অন্যতম কাজ হয়ে গেল জুনিয়রদের চিঠির জন্য কবিতার লাইন সরবরাহ করা।
হে সাড়ে তিনহাত ভূমি, যদি নির্বাসন দাও, আমি বিষপান করে মরে যাবো
কিংবা
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি
তার পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন!
ফলে আমি এমন একটা ভাব করতাম, “যে কবিতা শুনতে জানে না, সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে”।
কবিতাপ্রীতি আরও কিছুদিন চললো, তবে অচিরেই সেটি নির্বাসিত হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কী অনেকদিন পর নিজে আগ্রহী হয়ে গতবছর বইমেলাতে গুলতেকিন খানের ‘আজো, কেউ হাটে অবিরাম” সাম্প্রতিক কবিতার বই যা এক বসাতে পড়েছি। তারপর আফতাব স্যারের সঙ্গে ওনার যুগলবন্দী কাব্যনাটকটিও এবার পড়েছি।
বাড়ি গেলে আমি বিকেলটা খালি রাখি। কারণ ঐ সময় আমি ‘বাতিঘরে’ বসে থাকি। গেলবার বাতিঘরে বসে থাকার সময় মামুন গুলতেকিন খানের দূর দ্রাঘিমায় উপহার দিয়ে যায়। কিন্তু ফেরার সময় বোনের বাসাতে সেটা ফেলে আসি। গতকাল সকালেই আমার আর্কিটেক্ট ভাগনী আমার ব্যাগে আবার বইটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর এখন বসে বসে পড়লাম।
মোট ২৫টা কবিতা। নানান দেশের। লেখক লিখেছেন এই কবিতার একসময় তাকে কোন না কোনভাবে মুগ্ধ করেছে। অনুবাদে এই মুগ্ধতারই প্রকাশ বেশি। যেমন গাবিবা বাদেরুনের কবিতার দুটো পঙ্তি
আমরা আমাদের যুদ্ধের গল্পগুলিকে
প্রেমের গল্পের মত বলি, পাপহীন ডিম যেন তারা।
কিংবা মনিকা আসপ্রং-এর সাগর দেখার ব্যাপারটাও আমার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে, আমার ছোটবেলার সৌন্দর্যের মতো-
একটি সাগর আমি দেখলাম সদাচারী হওয়ার ইচ্ছায়
একটি সাগর আমি দেখলাম সাহসী হবার চেষ্টায়।
তবে এই বই-এর সেরা কবিতাটা মনে হয় এর শেষ কবিতাটি
লরা এসেরবোনির শীতলতা।
শীতলতা
বেশ খানিকটা অপ্রিয় তো বটে।
যদি তুমি কাঁপতে থাকো
তোমার বিশ্বাসযোগ্যতার কোঠা
শূন্যে নেমে আসে।
সে জন্যেই আমি আমার তালুতে ঠুক
নিয়েছি পেরেক।
এখন আমি
অনড় একজন।
লেখক মনে হয় কষ্টেরগুলোই বেঁছে নিয়েছেন বেশি। কবিতার সঙ্গে কবিদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে – কবিতা পড়াটা কখনো কখনো খুবই আনন্দের হয়
ধন্যবাদ গুলতেকিন খান।
[যারা পড়তে চান তাদের জন্য রকমারির লিংক- https://www.rokomari.com/book/128663/]