খুল যা সিম সিম-১
একেবারে ছোটবেলায় বালক জেনে গেছে ওর চেহারা সুন্দর না, ওর অস্থিরতাও কেও পছন্দ করে না। এমনকী তার গল্প বলার ব্যাপারটাও পছন্দ নয় সহপাঠীদের। ফলে স্কুলে সবসময় গঞ্জনা লেগেই থাকে। শুধু স্কুল কেন, বাসাতেও কি তার শান্তি আছে।
তিন সন্তানকে কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় তার বাবা প্রায় তাকে দেখিয়ে বলে – আর ওকে আমরা কুড়িয়ে এনেছি ময়লার স্তুপ থেকে!
এসব তাঁকে হীনমন্যতায় আক্রান্ত করার কথা। কিন্তু হলো তার উল্টা। এই বিষয়গুলো তাকে ক্রমশ জিদ্দি করে তুললো। নিজের একটা জগৎ তৈরি করতে শুরু করলো সে। আর সেটা বই দিয়ে। সময় পেলেই পড়ো, পড়ো আর পড়ো!
পছন্দের তালিকায় নানান কিছু। তবে, মার্শাল আর্টের বই-তেই তার যেন বেশি আনন্দ। সেখানকার রবিনহুডরাই তার আদর্শ- আক্রান্তের পাশে দাড়াচ্ছে কিন্তু বাকী সময় আনন্দ-স্ফূর্তির মধ্যেই থাকে।
যে ছোট্ট শহরটাতে তারা থাকে সেখানে কিছুদিন পর বিদেশীরা বেড়াতে আসতে শুরু করলো। স্কুলের ভুগোল শিক্ষক একদিন তাকে জানালো তিনি লেকের পাড়ে বিদেশীদের দেখেছেন। আমাদের বালক তৎক্ষণাৎ সাইকেল নিয়ে দৌড়। তারপর থেকে প্রতিদিনই স্কুলের সময় ছাড়া বালককে দেখা যেতো লেকের পাড়ে। উদ্দেশ্য বিদেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ইংরেজি শেখা। এখানেই তার সখ্যতা গড়ে ওঠে একটি অস্ট্রেলিয়ান পরিবারের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে তার পত্র-যোগাযোগও অব্যাহত থাকে এবং একদিন তাদের আমন্ত্রণে আমাদের কিশোর পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়ায়। ঐ পরিবারের কর্তাকে কিশোর মনে করতো “বাবার মতো”।
অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কিশাোর আবিস্কার করে – দেশের বাইরেটা কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের মত নয়। আরো বেশি সুন্দর।
বিদেশীদের সঙ্গে খাতিরের কারণে তার ইংরেজিটা ভালই উন্নতি করে কিন্তু সে বেচারা অংকে কাচা থেকে যায়। ফলে শহরের ইউনিভার্সিটিতে দুইবার ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। পরের বারে ভর্তি হয়। সেখানে কেমনে জানি সে ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠে। এভাবে আমাদের বালক হয়ে ওঠে যুবক।
পাশ করার পর স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি শেখানোর শিক্ষক হিসাবে যোগ দেয় আমাদের সদ্য স্নাতক। বেতন ঠিক হয় একুনে ৯৬০ টাকা! নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন এই শিক্ষক ক্লাসে পড়ায় অন্যভাবে। গৎবাঁধা পাঠ্যপুস্তক না পড়িয়ে স্যার ক্লাসে তার অভিজ্ঞতার গল্প করে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজি কথোপকথনের চর্চ্চা শুরু করে, হাস্যরসের কারণে ক্লাসগুলো হয় জমজমাট। ফলে, তার শিক্ষার্থীদের ইয়রেজি শেখা হয়ে সহজ আর আমাদের যুবকটি হয়ে ওঠে ক্যাম্পাসের জনপ্রিয়তম শিক্ষক। পাঁচ বছর ইংরেজির মাস্টারি করার পর তার একদিন মনে হল সে “চাকরি খুঁজবে না, চাকরি দেবে”।
চেষ্টা করতে দোষ কী। আর যদি না হয় তাহলে নতুন অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে মাস্টারিতে ফেরৎ যাওয়া যাবে। যেহেতু ইংরেজি ভাল, কাজে সে তার শহরের গুলিস্তানে খুলে বসলো একটা অনুবাদ কেন্দ্র। তার বেশিরভাগ কাস্টোমারই ব্যবসায়ী যারা ইংরেজি বুজে না কিন্তু দেশের বাইরে মালামাল পাঠাতে চায়। এলাকার পৌরসভার চেয়ারম্যান একজন ব্যবসায়ী। সে একদিন আমাদের উদ্যোক্তাকে বললো – আমার হয়ে আমেরিকা যাও। আমার সেখানকার পার্টনারের চিন্তাভাবনা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
আমাদের উদ্যোক্তা এক পায়ে খাড়া। কিন্তু বেচারা জানতো না লস এঞ্জেলসে তার জন্য ওৎ পেতে আছে পিস্তল। আমেরিকার কাউন্টার পার্ট তারা ভয় দেখিয়ে বলে দিল – ফিরে গিয়ে যেন সে পার্টনারকে বলে এখানে সব ঠিক আছে!
ভয়ের চোটে আমাদের উদ্যোক্তা দৌড়াতে দৌড়াতে হাজি হল সিয়াটলে যেখানে তার একজন লেক পাড়ের বন্ধু আছে। ঐ বন্ধুটি তার কম্পিউটারের সামনে আমাদের উদ্যোক্তাকে বসিয়ে দিল। কাঁপা কাঁপা হাতে উদ্যোক্তা কম্পিউটার আর ধরে না।
“আরে বেটা। ঐটা বোমা নয় তো।”
গুগলের শাদা পর্দায় সে একটি পণ্যের নাম লিখলো। নানান দেশের পণ্য দেখানেও তার দেশের সেই পন্যের কোন তালিকা সেখানে পাওয়া গেল না।
উদ্যোক্তার মনের গহীনে জ্বলে উঠলো আলো। আরে, আমি যদি আমার শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীদের ওয়েবপেজ বানাতে পারি তাহলেই তো আমি লাখপতি হয়ে যাবো।
কিন্তু বাড়ি গিয়ে সে আবিস্কার করলো তার শহরে কোন ইন্টারনেট নাই! কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তা মোটেই ঘাবরাবার পাত্র নয়। সে শুরু করলো ওয়েবপেজের মার্কেটিং।
ভাবা যায় এমন একটা জিনিষ সে বেচার চেষ্টা করছে যা সে কখনো দেখাতে পারে না। কিন্তু কেমনে কেমনে সে কিছু কাস্টোমার যোগাড় করলো। তাদের কন্টেন্ট, ছবি সব ঠিক করে সেগুলো নিজের শহর থেকে কুরিয়ার করে পঠানো হল সিয়াটলে। সিয়াটলের বন্ধু সেটার ওয়েবপেজ বানায়, রঙ্গিন প্রিন্ট আউট করে আর সেটা পাঠায় আমাদের উদ্যোক্তার কাছে। আমাদের উদ্যোক্তা ঐ ছবি নিয়ে হাজির হয় তার কাস্টোমারের কাছে বিলের জন্য। এর মধ্যে ঐ কাস্টোমার অন্য শহর বা অন্য দেশ থেকে একটা দুইটা টেলিফোন পেয়ে গেছে। তাতে সে বুঝে আমাদের উদ্যোক্তা বাটপার নয়। সেই ওয়েবপেজ সত্যিই বানিয়েছে!!!
আমাদের উদ্যোক্তার এই কারবার দেখে টিসিএল ওয়ালারা নিজেরা একই ব্যবসা শুরু করে দেয়। তাদের অবকাঠামো ভাল, অনেক টাকা কাজে উদ্যোক্তা টের পেল সে অচিরে হেরে যাবে। একটা বুদ্ধি সে বের করলো – এ কোম্পানির কাছে গিয়ে বললো চল আমরা প্রতিযোগিতা না করে জয়েন্ট ভেঞ্চার করি।
ওরা সানন্দে রাজী হল। কিছুদিন পর উদ্যোক্তা আবিস্কার করলো সে মোটামুটি এককোণায় পড়ে আছে। মনের দু:খে সেখান থেকে বের হয়ে আসলো সে।
এবার কী করি?
শহরের লোকেরা কিন্তু তার ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জানে। সরকারের একটা বিভাগ ভাবলো আচ্ছা ইন্টারনেট দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না?
কাজে ওরা ধরে আনলো আমাদের উদ্যো্ক্তাকে। বেচারা- সে ভাবছে ইন্টারনেট দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নতুন জগৎ খুলে যাবে আর তার বস ভাবছে ইন্টারনেট দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের “বশ” করা যাবে।
এই বৈপরীত্য কী আর চলে!!!
চলে না। কাজে ওখান থেকে বিদায়।
মাস্টারীতে ফিরবো নাকি আর একটা চেষ্টা করবো।
নিজেদর এপার্টমেন্টে কয়েকজন বন্ধুকে ডেকে এনে নিজের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলো। এমন কিছু করতে চায় যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের জন্য ইন্টারনেট এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করতে পারে।
এবার তার নতুন প্রতিষ্ঠানের মটো হল –
খুল যা সিম সিম!!!
[পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা – ঈদ মোবারক]
One Reply to “খুল যা সিম সিম-১”