একজন বটবৃক্ষ
২৮ এপ্রিল ২০২০
কোনো কোনো দিন এমনভাবে শুরু হয় যে, বুঝতে পারি মাথার ওপরের ছায়াটা সরে গেছে। বটবৃক্ষ আর নেই। সকালে ঘুম ভাঙার পরপরই খবরটা পেয়েছি। বিশ্বাস হয়নি। তাই ফোন করেছি এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার স্যারকে। তারপর থেকে স্তব্দ হয়ে বসে আসি। আমাদের অভিভাবক জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, জেআরসি স্যার, আমাদের জামিল স্যার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
নানা রকম ছবি ভেসে উঠছে মনে। মনে পড়ছে নানা ঘটনা। জামিল স্যার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আর আমি পড়েছি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। কাজেই স্যারকে আমি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক হিসেবে পাইনি। কিন্তু ১৯৯২ সালে আমাদের সমাবর্তনের মূল অনুষ্ঠান শেষে আমরা যখন বুয়েট মাঠে ইস্ততত ঘোরাঘুরি করছি, তখন একদিন স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার আমাকে নাম ধরে ডাকলেন, অভিনন্দন জানালেন এবং কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমার পুরকৌশলী বন্ধুরা অবাক হয়ে জানতে চাইল, স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য কেমনে হলো? আমি তো ‘সিভিল’ না!
তখন বলতে হলো, স্যার যখন বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক, তখন থেকে স্যারের সঙ্গে আমার জানাশোনা। তারপর পাস করার কিছুদিন পর স্যার একদিন ডেকে পাঠান। বললেন, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির একটা মুখপত্র বের করতে চান। আমি দায়িত্ব নেব কি না। কাজটা সহজই। কাজেই রাজি হলাম। কী কী থাকবে, কে কে লিখবে, কার ইন্টারভিউ যাবে—সবকিছুই স্যারকে দেখিয়ে নিয়েছি। তখনই টের পেয়েছি স্যার কতটা আন্তরিক এবং কতটা গভীরে যেতে পারেন। ১৯৯২ সালের শুরুতে স্যার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সভাপতি হন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই স্যার ইনস্টিটিউটের মুখপত্র ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ নিয়মিত প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সাইফুল্লাহ ভাইকে (প্রকৌশলী সাইফুল্লাহ) সম্পাদক করা হয়। আর আমাকে ডেকে একদিন পরিচয় করিয়ে দেন সাইফুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে। ব্যস, পরের দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজে কাজ করেছি। পরিকল্পনার বেশির ভাগ সাইফুল্লাহ ভাই করতেন, আমি আর মাহবুব (নৌযন্ত্র প্রকৌশলী মাহবুব মোরশেদ) ছিলাম জোগালি। সে সময় আমি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারে (এখন ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি, আইআইসিটি) কর্মরত। বিকেলে প্রায়ই হাজির হতাম ইনস্টিটিউটের পুরাতন ভবনে। যেদিন সভাপতির কোনো মিটিং থাকত না, সেদিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠাতেন। বিভিন্ন আইডিয়া দিতেন। কী কী নিয়ে লেখা যেতে পারে, সেটা বলতেন। কখনো কখনো কোনো কাগজ দিতেন, যেখানে কোনো নিউজ বা আর্টিকেল থাকত। বলতেন, এটা নিয়ে ভাবো। মজার বিষয় হলো, কখনো বলতেন না, এটা ছাপো বা এটা করো। বেশির ভাগ বলতেন, আমাদের সম্পাদক সাইফুল্লাহর সঙ্গে কথা বলো। যদিও সভাপতি হিসেবে তিনি আমাদের বলতে পারতেন, এটা ছাপো, এটা ছেপো না। কিন্তু বলতেন না।
ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের সমাবর্তনের কয়েক মাস পরেই আমার বুয়েটের চাকরির ইন্টারভিউ। জামিল স্যার আমার প্রথম ভাইভা নিলেন। ভাইভা বোর্ডে স্যারের সঙ্গে আরও ছিলেন বুয়েটের সে সময়কার উপাচার্য শাহজাজান স্যার ও বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক মুজিবুর রহমান স্যার। টেকনিক্যাল প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর জামিল স্যার বললেন, তোমাকে যদি আলাদা করে কিছু টাকা দেওয়া হয়, তাহলে সেন্টারের উন্নয়নের জন্য তুমি কী করবে? বললাম। তখন কিছু পরামর্শ দিলেন। সেই ভাইভা বোর্ডে আমি টের পেলাম আইসিটি আসলে কেবল প্রোগ্রামিং নয়, সেটা অনেক বড় একটা ব্যাপার।
স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গভীর হয় আইইবির ওই দুই বছরে। টার্ম শেষে স্যার ইউনিভার্সিটিতে মনোযোগ দেন। আমিও এসে পড়ি নিজের কাজে। কিন্তু নিয়মিত স্যারের সঙ্গে দেখা করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কাজে আমি নিয়মিত স্যারের রুমের সামনে যাই এবং স্যারের সঙ্গে গল্প করি। তত দিনে আমি জেনে গেছি, হাতে সময় থাকলে স্যার গল্প করতে ভালবাসেন, স্যারের স্মরণশক্তি অসাধারণ এবং স্যার খুবই অমায়িক। তত দিনে ভোরের কাগজের প্রকাশনা শুরু হয়েছে। সেখানে আমি একুশ শতক নামে একটা ফিচার পাতা সম্পাদনা করি আর ছোটদের জন্য সাময়িকী ইস্টিকুটুমে ‘গল্প গল্পে ধাঁধা’ নামে একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখি। সে সময় স্যার আমাকে ই-মেইল করতে শুরু করেন বিভিন্ন বিষয়ে। বিশেষ করে, দেশের বাইরে বাংলাদেশিরা যারা ভালো করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, তাদের সম্পর্কে কোনো খবর থাকলেই আমাকে পাঠাতেন। এ ছাড়া দরকার হলে ফোন করে বলতেন, ওই বিষয়ে খোঁজ নাও। অথবা সরাসরি বলতেন, ড. আরিফকে নিয়ে তুমি একটা লেখা লিখতে পারো। আমাকে সিসিতে রেখে মেইল দিও। আমি বলে দেব। প্রথম আলোয় আমার অনেক প্রোফাইল লেখার উৎস জামিলুর রেজা স্যার।
ভোরের কাগজ–এ দেশীয় ধাঁধার একটি নতুন ফরম্যাট চালু করার জন্য আমি সেখানে একেবারে চলতি বিষয়গুলো নিয়ে আসতাম। যেমন জনতার মঞ্চ, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ইত্যাদি। এসবের কোনো কোনোটাতে চরিত্র হিসেবে হাজির হতেন দ্বিজেন শর্মা কিংবা জহুরুল হক। সেভাবে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নিয়ে ধাঁধার গল্পে জামিল স্যার হাজির হলেন ‘জামিল কাকা’ নামে। স্যারের চোখ এড়াত না কিছুই। কারণ এই কলাম চালু করার পর স্যার একদিন ফোন করলেন, মুনির (স্যার মু-এর ওপর একটু জোর দিয়ে আমাকে ডাকতেন) তোমার জন্য একটা বই এনেছি। সন্ধ্যায় বাসায় এসে নিয়ে যেও। সন্ধ্যায় স্যারের এলিফেন্ট রোডের বাসায় গেলাম। দেখলাম স্যার আমার জন্য শকুন্তলা দেবীর ‘পাজলস টু পাজল ইউ’ নামে একটি ধাঁধার বই নিয়ে এসেছেন। বললেন, তুমি দেখলাম ধাঁধা লিখছ। দুবাই এয়ারপোর্টে বইটা দেখে ভাবলাম তোমার কাজে লাগবে।
স্যার এমনই ছিলেন। প্রথম আলোয় যখন থেকে সুডোকু ছাপা শুরু হলো, তখন থেকে তিনি সকালে সেটির সমাধান করতেন। তারপর সমাধান মোবাইলে পাঠিয়েও দিতেন। সেই সময় আমরা বিজয়ীদের ফোন নম্বর ছাপাতাম। স্যারের মোবাইল নম্বর ছাপা হয়েছে অনেকবার। তারপর দেখি স্যার আর পাঠান না। বললেন, ফোন নম্বরে লোকে ফোন করে জানতে চায় আমি কীভাবে এটা মিলাই। হাসতে হাসতে আমাকে পরামর্শ দিলেন তুমি বরং সুডোকু সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে একটা বই লিখে ফেলো। তারপর স্যার আমাকে সুডোকু–সম্পর্কিত কয়েকটা বই দিয়ে দিলেন! প্রথম আলোতে কখনো কোন সুডোকু ভুল ছাপা হলে তিনি আমাকে বা আমাদের সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমকে ফোন করতেন। এ রকম একদিন সকালে ফোন করে বললেন, ভুল আছে। আমিও করে দেখলাম ভুল আছে। কিন্তু পরদিন ঠিকই আমরা পুরস্কার দিলাম। স্যার আমাকে বললেন, ‘ভুল’ সুডোকুর ‘সঠিক’ সমাধান কেমনে হলো?
জানালাম স্যার আমরা তো পুরো সমাধান দেখি না, শুধু চারটা নির্দিষ্ট ঘরের নম্বরটা মিলাই। যাদের সেটা মিলে তারাই বিজয়ী! স্যার হাসতে হাসে বললেন, এভাবে শুধু উত্তর দেখার মধ্যে যে ঝামেলা হয় সেটা প্রযুক্তিবিদদের নানাভাবে বুজতে হয়েছে।
এভাবে স্যার আমাকে প্রায়ই বইপত্র আর লিংক পাঠাতেন। আর আমার মাথায় কোনো আইডিয়া এলে আমি হয় স্যারকে বলতাম, না হয় জাফর স্যারকে (অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল)।
২০০১ সালে আমরা প্রথম আলোয় এক অভিনব গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি। জাফর স্যার ও কায়কোবাদ স্যার (অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ) মিলে শুরু করেন নিউরনে অনুরণন। সেটার ধারাবাহিকতাই ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। সেটার সমাপনী অনুষ্ঠানে স্যার যোগ দেন। সেখান থেকে ফিরে আমি গণিত অলিম্পিয়াডের একটা কমিটি করার কথা ভাবি। কমিটির কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্যারের কথা মনে হলো। স্যার তত দিনে আর বুয়েটে নেই। চলে গেছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, উপাচার্য হয়ে। স্যারের কাছে গেলাম, সব কিছু বললাম। বললাম, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যেতে হরে আমাদের একটা ন্যাশনাল সিলেকশন কমিটি লাগবে। বললাম, স্যার, আপনি যদি কমিটির সভাপতি হন তাহলে আমরা এগোতে পারি। স্যার সব শুনলেন। তারপর বললেন, কার কার কথা ভাবছ। আমি তখন কয়েকজনের নাম বললাম। স্যার বললেন, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তো কারও থাকা দরকার। তারপর একটা মিটিং দিতে বললেন।
সেই আমাদের মিটিং হলো ২০০৩ সালের ১৩ এপ্রিল। মহাখালীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের কক্ষে। হলো বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আমার আবার স্যারের কাছে যাওয়া।
তারপর থেকে এই সেদিন পর্যন্ত স্যারের নেতৃত্বে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের যত কার্যক্রম। ২০০৪ সালে ছয়টি বিভাগীয় আয়োজন হয়ে জাতীয় আয়োজন। নটরডেম কলেজের অডিটরিয়ামে সমাপনী পর্বে সভাপতির ভাষণে স্যার গণিত অলিম্পিয়াডকে ঘিরে নিজের তিনটি স্বপ্নের কথা বলেন, ২০১০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে পদক জয়, ২০২২ সালের মধ্যে কোনো এক বাঙালির গণিতে ফিল্ডস মেডেল ও ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।
সেই সিলেটের আয়োজন থেকে স্যার প্রতিবছর ঢাকার আয়োজনের সকালে, জাতীয় আয়োজনের প্রথম দিন সকালে ও দ্বিতীয় দিন পুরস্কার বিতরণীতে উপস্থিত থাকতেন। উদ্বোধনের পর পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই সেন্ট যোসেফ স্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনে বসতাম। সেখানেই স্যার কিছু নির্দেশনা দিতেন।
২০০৪ সালে আমি আর স্যার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে পর্যবেক্ষক হিসেবে যাব বলে ঠিক করলাম। তবে ঠিক হলো আমি চলে যাব এবং যদি মনে করি সদস্য পদের জন্য স্যারের যাওয়া দরকার, তাহলে স্যার যাবেন। আমি একটা ফাইল রেডি করে নিয়ে যাই। ফাইলে কী কী থাকবে, কোনটার পরে কোন কাগজ থাকবে, সবই স্যার দেখে দেন। যাহোক, স্যারকে আর যেতে হয়নি। আমার উপস্থিতিতেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সদস্যপদ লাভ করে।
স্যার যত দিন ব্র্যাকে ছিলেন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির মিটিং ওখানেই হতো। আমরা বছরে মাত্র দুটো মিটিং করতাম। ২০১০ সালের পর মিটিং নেমে আসে একটাতে এবং সেটা হয় স্যারের বাসায়। স্যারের বাসায় মিটিংয়ে আমরা যারা কনিষ্ঠ তাদের আর একটা লাভ হতো। সেটা ম্যাডামের বানানো হাজার রকমের খাওয়া। স্যারদের গল্প তো থাকতই।
সে রকম একটা মিটিংয়ে আমাদের সহসভাপতি মুনিবুর রহমান স্যার বললেন, আপনার কি এখনো মনে আছে?
আমরা জানলাম ১৯৫০ সাল থেকে তৎকালীন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এসএসি পরীক্ষার মেধাতালিকার প্রথম হওয়াদের নামধাম এবং তারা এখন কোথায় আছে, সেটা জামিল স্যার বলতে পারেন। আমরা বলাতে স্যার বলতে শুরু করলেন, ১৯৫০ সালে প্রথম হন আবদুল মতিন পাটোয়ারি (পরে অধ্যাপক, বুয়েটের উপাচার্য, বর্তমানে অবসরে আছেন)। তারপর গড়গড় করে বলে গেলেন ১৯৭০ সাল পর্যন্ত! আমার মনে আছে মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহারের আগ পর্যন্ত স্যার তাঁর পরিচিতদের ফোন নম্বর বলতে পারতেন, কাগজ না দেখে।
গণিত অলিম্পিয়াডের মঞ্চে আমার উপস্থাপনার শুরু। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ধরে রাখার জন্য আমি মঞ্চে কখনো লাফালাফি করি, কখনো ম্যাজিক দেখাই, কখনো তামিম শাহরিয়ারের সঙ্গে ঝাগড়া করি। আর অসংখ্য গল্প বলি। এর মধ্যে টমাস আলভা এডিসনের মায়ের একটা গল্পও আমি কয়েক জায়গায় বলেছি। জাতীয় উৎসবেও বলেছি। উৎসব শেষে স্যারকে যখন গাড়িতে তুলে দিতে গেছি, তখন আমি একা। স্যার বললেন, এডিসনের এই গল্পটার অথেনটিসিটি দুর্বল। সামনের কোনো পর্বে দরকার না হলে এই গল্পটা আর বলবে না। এ হচ্ছে স্যারের কারেকশন করিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি।
স্যারের স্মরণশক্তির আরও অনেক ঘটনা দেখেছি। পত্রিকা পড়তেন অনেকগুলো। ভোরের কাগজ–এ আমি নিজেই বেনামে অনেক লেখা লিখতাম। সে রকম একবার ভিন্ন নামে এফ আর খানকে নিয়ে একটা নিবন্ধ লিখি। পরে কথা প্রসঙ্গে স্যারকে ওই কথা বলাতে স্যার বললেন, ওইটা কি তোমার লেখা? আমি দেখছি কী একটা নাজনীন নাম ছিল। বাধ্য হয়ে স্যারকে আসল কথা বলে দিতে হলো।
আমাদের যেকোনো নতুন পরিকল্পনা হলেই আমি স্যারের কাছে যাই। সর্বশেষ গেছি ইন-জিনিয়াসের পরিকল্পনা নিয়ে। স্যার শুনে বললেন, করতে পারো। তারপর তৎক্ষণাৎ বললেন, দেশের কোথায় কোথায় পুরকৌশলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কী রকম প্রতিযোগিতা হয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী কী হয়। তারপর আমার পরিকল্পনার কিছু অংশ পরিমার্জনের পরামর্শ দিলেন। ফেরার সময় আমার মনে হয়েছে, দুজনকে কাজে লাগিয়ে এক মাস সময় নিয়ে আমরা যেসব তথ্য–উপাত্ত জোগাড় করেছি, সেটা স্যারের কাছেই ছিল। পুরকৌশলী ও স্থপতিদের নিয়ে নতুন একটা আয়োজনের ব্যাপারে স্যারের পরামর্শের জন্য যাওয়ার কথা ছিল। সে আর হলো না।
২০২০ সালের গণিত অলিম্পিয়াড নিয়েই স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় মার্চের শেষের দিকে। বললেন, মুনির, তাড়াহুড়া কোরো না। আইএমও কী করে, সেটা দেখো। আমরা যা করব, ভেবেচিন্তেই করব।
গণিত অলিম্পিয়াডে আমরা একটা ধীরে, ধীরে, শর্পিলাকার পদ্ধতিতে আমাদের টার্গেট একটু একটু করে এগোতাম। কমিটির স্যাররা প্রায় সবাই আমার আর আমাদের কোচ মাহবুব মজুমদারের এই ধীরে চলা নীতিটা মেনে নিয়েছেন। ২০০৯ সালে, স্যারের বেঁধে দেওয়া সময়ের এক বছর আগেই আমরা প্রথম পদক পাই। ২০১২ সালে রুপার পদক পাওয়ার পর স্যার একদিন বললেন, আমাদের সোনার পদকের কী হবে, মুনির?
বলতাম সময় লাগবে। তবে, ২০১৮ সালে রোমানিয়ায় যাওয়ার আগে স্যারদের বলে গিয়েছি, এবার হবে স্যার। হলঘরে ফলাফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে স্যারকে সবার আগেই ফোন করি। স্যার ফোন ধরেই বললেন, অভিনন্দন। তোমার ফোন পেয়েই বুজেছি আমাদের জন্য সুখবর। স্যার জানতেন, ওই সময়ে ফলাফল ঘোষিত হবে, তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন আমার ফোনের।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে আরও অনেক সাফল্য বয়ে আনবে। কিন্তু ফোনের এপারে অভিনন্দন বলার জন্য আমাদের জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার থাকবেন না।
স্যার নিয়ে নির্মিত এই প্রামাণ্য চিত্র
ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।
(প্রথম আলো’তে প্রকাশিত)
2 Replies to “একজন বটবৃক্ষ”