ক্ষুধার্ত থাকো, বোকা থাকো-৭: রাজসিক প্রত্যাবর্তন-২
ক্ষুধার্ত থাকো, বোকা থাকো-৬: রাজসিক প্রত্যাবর্তন-১
১৯৭১ সালে যখন স্টিভ জবসের বয়স ১৬ বছর তখন একদিন এক প্রতিবেশী একটা জিনিষ দেখাতে নিয়ে গেলেন। ঐ প্রতিবেশি জবসকে নিয়ে যান কয়েকটা বাড়ি পরের একটা বাড়িতে। সেখানে যে থাকে তার নামের প্রথম অংশও স্টিভ। এর তিন বছর আগে দ্বিতীয় স্টিভের বয়স যখন ১৮ তখনই সে বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা “কম্পিউটার” বানিয়ে ফেলেছে। তখন অবশ্য কম্পিউটার বলতে কী বোঝাতো?
এক বিরাট বাক্স, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকে। আর শাদা জ্যাকেট পড়া লোকেরা সেখানে কী জানি করে। [এটা পড়ার পর আমার নিজের প্রথম মেইনফ্রেম দেখার কথা মনে পড়েছে। বিস্তারিত আমার পড়োপড়োপড়ো বইতে লিখেছি।] স্টিভের কম্পিউটারটিও আসলে তেমন কিছু করতে পারতো না, কয়েকটা বাতি জ্বালানো-নেভানো ছাড়া। তবে, সেটিই বা কম কীসে! জবস খুব তাড়াতাড়ি ওজনিয়াককে চিনেছে , প্রযুক্তি প্রেমী হিসাবে!!! দেখা গেল কিছু কিছু বিষয়ে দুইজনের অনেক মিল কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে দুই জন দুই মেরুর বাসিন্দা।
ছোটবেলা থেকে জবস খুবই দুদা এবং দুষ্টু প্রকৃতির। প্রথমদিককার ক্লাসগুলোতেও পড়াশোনার ধারেকাছে যাওয়ার বান্দা সে নয়। ফলে শিক্ষকরাও বিরক্ত। কিন্তু, মিসেস হিল, গ্রেড ফোরের ক্লাস টিচার ভাবলেন অন্যকিছু। তাঁর মনে হলো ছেলেটি ব্রাইট। শুরু হলো স্টিভ জবসকে পটানো। কখনো ক্যান্ডি, কখনো টাকা। এমনকী এবার দেওয়া হলো ক্যামেরা বানানোর কিটু। দেখা গেল লাইনে চলে এসেছে আমাদের জবস। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে জবস বলছেন সেই এক বছরে তিনি একাডেমিক্যালি যতো শিখেছেন, বাকী জীবনেও তা শেখেন নাই! একজন সত্যিকারের শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী হতে পারে।
গ্রেড ফোরের শিক্ষা জবসে এতোটা প্রভাবিত করেছে যে, এপল তার শুরু থেকে শিক্ষার্থী এবং মিক্ষকদের জন্য স্পেশাল ডিসকাউন্ট চালু করেছিল। আর এক স্মৃতিচারণে জবস লিখেছেন তার মধ্যে এমন সব কোয়ালিটি ছিল যে, তার শেষ পরিণতি ছিল জেলখানা, চৌদ্দ শিক। কেবল মিসেস হিলের জন্য তা হয়নি। “When you are young, a little bit of correction goes a long way”.
হাইস্কুল শেষে জবস গেলেন ওরগনের পোর্টল্যান্ডের রীড কলেজে। যদিও পরিবারের জন্য এটার টাকা যোগানো সহজ ছিল না। কিন্তু স্টিভের সৎ পিতা ও মা চেয়েছে স্টিভ জবস তার কলেজ এডুকেশন শেষ করুক। কিন্তু জবস কোনরকমে এক সেমিস্টার শেষ করেই ক্ষান্ত দিল। যদিও তারপর কিছুদিন অডিট ক্লাসে আনাগোনা করেছে।
ভ্যালিতে ফিরে এসে জবস আটারি’তে একটা কাজ নিল, রাতের পালা। উদ্দেশ্য মহান। কিছু টাকা জমাতে হবে যাতে “পূবে বেড়াতে যাওয়া যায়”। পূবের সফর থেকে ফেরার পর স্টিভ জবসের আসলে পুনর্জন্ম হয়। ফলাহারী ও জেন বৌদ্ধ স্টিভ যেন হোন এক অন্য মানুষ। ফিরে এসে জবস আবার আটারিতে যোগ দেন। আর তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ওজনিয়াকের। ওজ তখন দিনের বেরায় চাকরি করতো হিউলেট প্যাকার্ড আর অবসর সময়ে বানাতো অন্যদের জন্য পিসিবি, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড। হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাব নামে একটি কম্পিউটার ক্লাবের সঙ্গেও ওজ জড়িত। (এই ক্লাবটি পরে এতোই বিখ্যাত যে, আলাদা একটা ব্লগ পোস্ট দাবী করে)
দুরন্তপণার কারণে জবস যে কনো বিষয়ে এমন একটা পয়েন্ট খুঁজে পায় যা অন্যরা দেখতে পায় না। এখন হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, এগুলোর বেশিরভাগই হয় ব্যবসা সংক্রান্ত। ওজের পিসিবির কথাই ধরা যাক। জবস দেখলো, আরে ওজের পিসিবিগুলো তো বেঁচা যায়!!! আর বেঁচার বুদ্ধি বের করতে গিয়ে জবস খেয়াল করে কোন কা প্যাশনেটলি করলে সেটাতে সফল হওয়া যায়।
হোমব্রিড ক্লাবে গিয়ে জবস একটা মজার জিনিষ আবিস্কার করলো। দেখা গেল ওজের অনেক বন্ধু (আমাদের মতো), অনেক আলাপ আলোচনা করে কম্পিউটার নিয়ে, কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে নিজের জন্য একটা সার্কিট ডিজাইনও করে। কিন্তু বেশিরভাগ সেটা আর বানায় না। জবস ভাবলো – আরে এখানেই তো একটা বাযবসা হতে পারে।
জবস ওজকে বোঝালো যাতে অন্যদের ডিজাইন করা সার্কিটগুলোর বোর্ড বানায় এবং তখন দুজনে মিলে সেটা বিক্রি করবে। ওজের অবশ্য মাথায় আসে নাই এ করে টু-পাইস কামানো যাবে। তবে, তার মনে হল “এটা খুব ফানি একটা ব্যাপার হবে। নিজেদের পকেটের টাকা খরচ হবে। তবে, আমরা তো বলতে পারবো যে, আমাদের একটা কোম্পানি আছে”। কাজে দুই স্টিভ মিলে একটা অংশিদারী চুক্তি স্বাক্ষর করলো (এই সেই চুক্তি যা এপল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে!)। তাদের যৌথ কাজের সময়ে একবার দরকার হলো ইনটেলের DRAM চিপের। কিন্তু সেটার অনেক দাম! কিন্তু জবস ইনটেলের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে একটা ফোন করলো এাং তাদের ভুজং-ভাজং দিয়ে ভজিয়ে ঠিক্ব সেটা এনে হাজির করলো ওজের কাছে।
ওজের আত্মজীবনীতে আরও একটি ঘটনার কথা আছে। একবার জবস ফোন করলো হিউলেট প্যাকার্ডে এবং কেমনে কেমনে প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম হিউলেট পর্যন্ত পৌঁছে গেল। জবস তাঁকে বাধ্য করলো তার সঙ্গে ৩০ মিনিট কথা বলতে। ফোন ছাড়ার সময় উইলিয়াম হিউলেট জবসকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে সামার জবের অফার দিল!
যারা মারিয়ো পূজোর গডফাদার পড়েছেন তারা হয়তো জবসের সঙ্গে গডফাদারের একটা মিল খুঁজে পাবেন। গডফাদারের মূল চরিত্রের কথা ছিল, “কোন ভাল প্রস্তাব কেউ কখনো ফিরিয়ে দেয় না”।
জবস এটিকে আর একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নানান ভাবে ভাল প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেই সেটা বাস্তব হয়ে যায়। কেবল লেগে থাকতে হয়।
স্টিভ জবসের এপল জীবন কিংবা নেক্সট জীবনের বাঁকে বাঁকে এটিই কেবল দেখা যায়।
আমরা ছিলাম জবসের এপল প্রত্যাবর্তনে। আবার সেখানে ফেরা যাক।
পরের পর্ব – রাজসিক প্রত্যাবর্তন -৩