চাকরি আছে, লোক নাই — লোক আছে, চাকরি নাই!!!
করোনাকালের মধ্যেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি লোকজন নিয়োগ করার জন্য খোঁজাখুঁজি করছে। একটা ঝামেলা হয়েছে যে অনেকেরই কাজ নেই। ফলে কম্পিটিশনটা জোরদার হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান অনেক আবেদন পড়তে পারে এই ভয়ে হেড হান্টিং করছে সরাসরি। মানে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে তাদেরকে ডেকে চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলছে। নিজেদের এবং অন্যদের জন্য লোক খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে আমার কিছু নতুন-পুরাতন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সেসব নিয়েই এই লেখাটা।
পুরানো কথাগুলো আগে বলে নেই। বড় একটা মিসম্যাচ আমাদের কর্মপ্রত্যাশী ও কর্মবাজারের মধ্যে আছে। ধ্যান ধারণার মধ্যেও ব্যাপক ঝামেলা আছে মনে হয়। যেমন কদিন আগে এক নিয়োগকর্তা জানালেন এক ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট তার কাছে মাসিক ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে যদিও চাকরির বিজ্ঞাপনে বেতনের রেঞ্জ লেখা ছিল। আবার ২ বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছে এমন পদে আবেদন করে যার কিনা এখনও রেজাল্টই বের হয়নি। আমাদের ভার্সিটিগুলোর বেশিরভাগেরই কোন প্লেসমেন্ট/ক্যারিয়ার সাপোর্ট সেন্টার নেই। ফলে, শিক্ষার্থীরা ফাইনাল ইয়ারে বা পাস করার পরই কেবল কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করার কথা ভাবে। আজকাল কিন্তু সেটা অনেক কঠিন।
ইউরোপ-আমেরিকাতো বটেই, আশেপাশের দেশগুলোতেও ছাত্রজীবন থেকে ক্যারিয়ার নিয়ে সবাই অনেক সচেতন থাকে। রুবাই মাত্র পড়তে গেছে আমেরিকাতে। ও বললো সবাই হয় ক্যাম্পাসে কোন কাজ বা সামারে ইন্টার্নশীপের জন্য সেশনের শুরু থেকেই দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। ক্যাস্পাসে যে জবগুলো হয় তার মধ্যে আনপেইড কাজের সংখ্যা বেশি। যেমন ওদের ক্যাম্পাসে একটা গ্যারাজ আছে। যেখানে বিভিন্ন ছেলেমেয়েরা নিজেদের স্টার্টআপ করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগই আসলে শেষ পর্যন্ত দাড়ায় না।। কিন্তু তারা সেটি করে। ওদের সিইও, সিটিও থাকে। ওরা নতুনদের ইন্টারভিউ করে এবং কাজ দেয়। সম্মানী হলো স্টকের আশ্বাস। কারণ ওদের নিজেদের কোন টাকা নেই। আচ্ছা, এগুলো কেন করে? কারণ তাতে স্কিলটা বাড়ে, একটা বাস্তব প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ হয়। এই কাজের ফলে আর একটা বড় কাজ হয়। নেটওয়ার্কিং। এমন সব লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় যাদের সঙ্গে অন্য কোনভাবে পরিচয়ের কোন সম্ভাবনাই নেই। এরকম একটা গ্যারাজ জব থেকে হয়তো তোমার পরিচয় হয়ে যেতে পারে কোন স্টার্টআপের সিএক্সও-র সঙ্গে। তিনি যদি খুশি হন তাহলে তিনি তোমাকে তার ওখানে সুযোগ দিতে পারেন!
শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়লে যে লাভ নেই, সেটা পাশ্চাত্যের দিক তাকালেই আমরা দেখতে পারি। ওখানে ওরা বছরে তিন মাস কাজ-কর্ম করে। তখন রিলাক্স টাইম থাকে। আমাদের এখানে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাইমিস্টার নামে একটা অদ্ভুত বিষয় আছে। সেখানে দুই ট্রাইমিস্টারের মাঝখানে মাত্র দুই সপ্তাহের কখনো কখনো মাত্র এক সপ্তাহের গ্যাপ পাওয়া যায়। তারপর ১৩ সপ্তাহের ক্লাশে থাকে পড়া, মিড টার্ম, এসাইনমেন্ট, সিটি। ফলাফল ইন্ডাস্ট্রির খোঁজ নেওয়া হয় না বেশিরভাগের। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোটবেলা থেকে সিইও হওয়ার যণ্ত্রণা। সবাই ভাবছে একটা ফেসবুক পেজ খুললেই তো আমি সিইও হয়ে যাচ্ছি। আমি কোন ইন্টার্নশীপ বা প্রবেশনারী কাজে যাবো। ভাবছে না শুধু প্রোগ্রাম লিখেই বড় কোম্পানি এই দেশে করা যাবে না। সেজন্য আরও অন্য স্কিলও লাগবে। আর কিছু কিছু স্কিল শুধু পড়াশোনা করে কিন্তু হবে না।
কিন্তু আমি দেখেছি ক্যারিয়ার রিলেটেড প্রোগ্রাম আয়োজনে যতো উৎসাহ থাকে সেই প্রোগ্রামগুলোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ থাকে কম। ২০১৮ সালে আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ জন সিইওকে একটা সেশনে নিয়ে গেছি। দুর্ভাগ্যবশত ওখানে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা ছিল না। সম্ভবত ঐদিন ওদের ক্যাম্পাসে ছুটির দিন ছিল (শনিবার)। ডিএসডব্লিউ স্যার আমাকে বললেন – আজ সারাদিন যারা এই অনুষ্ঠানগুলোতে ছিল, তাদের তো একটা ভাল নেটওয়ার্ক হয়ে গেল। আমার স্টুডেন্টরাতো আসলো না!!! মজার বিষয় হলো ঐ ছেলেমেয়েগুলো ঠিক একমাস পরেই আমার কাছে বলেছে – স্যার, ওনার কাছে একটু পাঠান। অথচ ওরা নিজেরাই এই নেটওয়ার্কটা তৈরি করতে পারতো।
ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় সিভিতে ওরা ১০-২০টা স্কিল আছে উল্লেখ করে বসে থাকে। অথচ ঠিকঠাকমতো পারলে একটা স্কিলই তাকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। একটি বিষয় কতদূর পর্যন্ত ডীপে গেলে সেটিকে ‘দক্ষতা’ বলে সেটাও আসলে বোঝা সম্ভব হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে নিজেকে কীভাবে কর্মবাজারের জন্য তৈরি করা যায়। কাজটা কঠিন না। পড়ার সময় থেকেই শুরু করতে হবে। পড়ার সময় থেকেই নিজেকে তৈরির কাজে নিয়োজিত করতে হবে।
যারা হেসে-খেলে সময়টা পার করে ফেলেছে তারা চাইলে এখন এই কাজটা করতে পারে। এটি হলো কোথাও নিজেকে, দরকার হলে বিনে পয়সায়, যুক্ত করা। এটাতে নিজের একটা ধারণা হবে, নিজের দক্ষতারও যাচাই হবে। মার্কেট সম্পর্ক একটা ভাল ধারণাও গড়ে উঠবে।
আমাদের দেশে ইন্টার্নশীপের কালচারটা এখনও সেভাবে গড়ে উঠেনি। কাজে এক প্রজন্মকে এটা গড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
আমার কাছে কয়েকটি উদাহরণ আছে। অনার্স করা একটি মেয়ে তার বিনাবেতনে ইন্টার্নশীপ শুরু করে মার্চ মাসে এবং মে মাসেই সে একটি চাকরি পেয়ে যায়। আর একজন প্রকৌশলী প্রথমে ভলান্টারি কাজ করেছে, তারপর মাত্র ৭০০০ টাকায় ইন্টার্নশীপ করে এখন ঐ অফিসেই পার্মানেন্ট চাকরি করে। পেয়েছে একাধিক ট্রেনিং।
অন্যদিকে আর এক প্রকৌশলী ইন্টারভিউ না দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। তার ধারণা স্যারের তো তাকে চাকরি দিতেই হবে। তিনজনকে পাঠালাম এক অফিসে হেড অব এইচআরের সঙ্গে কথা বলতে। হেড অব এইচআর ঐ দিন অফিসে এসেছেন দুই ঘন্টা পরে। তিনজনই কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে চলে এসেছে। যে অফিসে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য দুই ঘন্টা বসে থাকতে হয় সেখানে কে চাকরি করে!!!
আমি বসে বসে ভাবি আমাদের তাহলে উপায় কী?
কাজ শেখার সময় কী ওদের আছে?
আমি জানি না।