জীবনের পরাজয় দেখতে চাই না
‘পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রনিকস বিষয়ে সদ্য ডিপ্লোমা শেষ করেছি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় চাকরিতে ঢুকতে পারছি না। অন্যদিকে ফ্যামিলি খুব চাপ দিচ্ছে, বাবা প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করছেন। আমি বর্তমানে কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে এসেছি। আর বাসায়ও ফেরত যেতে পারছি না। মরে গেলেও বাসায় ফেরত যাব না, স্যার।’ গত বুধবার মন খারাপ করে ফেসবুকে এই বার্তাটি পড়ছিলাম। দুই দিন আগে লেখা এই বার্তার লেখক কেমন আছে, আমি জানি না। তবে জানি, তার মতো বাংলাদেশের হাজারো তরুণের একই অবস্থা। তাদের কেউ কেউ বাসা ছেড়ে ঢাকায় এসে পড়েছে বা আসার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ নিজগৃহে পাচ্ছে ‘প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার’।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আমাদের যুবসমাজ। দেশের ৬৫ শতাংশই তরুণ। এদের প্রায় ২২ লাখ প্রতিবছর কর্মবাজারে আসছে। এদের মধ্যে লাখ সাতেককে আমরা ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিচ্ছি বিদেশে। কখনো মালয়েশিয়ায়, কখনো সৌদি আরবে তারা মানবেতর কষ্ট করে দেশের জন্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে এয়ারপোর্টে লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বাকিদের মধ্যে লাখখানেক সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিতে যুক্ত হয়। আর লাখ দুয়েক বেসরকারি উদ্যোগে বা নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান করতে পারে। বাকিরা?
তারা প্রতিদিন সকালে মন খারাপ করে ঘুম থেকে ওঠে। শেভ করার টাকাটাও তাদের মা বা ভাইয়ের কাছ থেকে হাত পেতে নিতে হয়। অথচ তাদের ৪৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছে। তাদের কাউকে কাউকে পড়াতে গিয়ে কোনো কোনো পরিবার নিঃস্বও হয়েছে। আমার মনে আছে, বুয়েট থেকে পাস করার পর চাকরি হচ্ছিল না দেখে বাবা একদিন বকা দিয়েছিলেন আমি কিছু করছি না বলে। মনের দুঃখে সেলুনে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করে এসেছিলাম। তার কয়েক দিন পর লেখার শুরুর ওই তরুণের মতো ঢাকায় চলে এসেছি। তবে আল্লাহর রহমতে, আজ থেকে ২৭ বছর আগে আমার অবস্থা ওই তরুণের মতো অত খারাপ হয়নি। কারণ, আমি বুয়েটে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে হলে থাকার একটা সিট পেয়েছি, টিউশনি করেছি আর কয়েক মাসের মধ্যে বুয়েটেই চাকরিতে যোগ দিতে পেরেছি। কিন্তু আমার মতো সৌভাগ্য হয়নি ওই ৩০ লাখ তরুণের, যারা সবাই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, কৃষি, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে কমপক্ষে ২৫ ধরনের পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছে আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে। কিন্তু তাদের না হচ্ছে নিয়োগ পরীক্ষা, না হচ্ছে চাকরি, জমছে শুধু দীর্ঘশ্বাস (নিয়োগ পরীক্ষার খবর নেই: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৩০ লাখ চাকরিপ্রার্থীর আবেদন, প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০১৭)। জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জনবল নিয়োগের বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না। কেবল এই ৩০ লাখ আবেদনকারী নয়, আরও অনেক আবেদনকারীর ভাগ্য ঝুলে আছে দীর্ঘসূত্রতায়।
জানা কথা, কেবল সরকারি উদ্যোগে দেশের কর্মসংস্থান সমীকরণের সমাধান সম্ভব নয়। পৃথিবীর বাকি সব দেশের মতো, বেসরকারি উদ্যোক্তারাই বাকিদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবেন। আমাদের দেশেও শতকরা ৮০টি কর্মসংস্থানই তৈরি করেন উদ্যোক্তারা। তবে সে জন্য তাঁরা কখনো সামান্য স্বীকৃতিও পান না। ফলে দিন দিন বেসরকারি উদ্যোগেও ভাটা পড়ছে। এ জাতি এতই অকৃতজ্ঞ যে দেশের শীর্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী উদ্যোক্তাদের কখনো একুশে বা স্বাধীনতা পদক দেওয়ার মতো সৌজন্য দেখাতে পারেনি। গার্মেন্টস শিল্পের কর্মীদের নিয়ে আজ আমরা কতই-না রচনা লিখি, কিন্তু গার্মেন্টস উদ্যোক্তাদের গালমন্দতেই সীমাবদ্ধ রাখি। প্রতিবছর যখন একুশে বা স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়, আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ি। না, সেখানে আমি শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের পথিকৃৎ ও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির প্রবক্তা নুরুল কাদেরের নাম দেখি না। আমি দেখি না আমাদের উজ্জ্বল কোনো উদ্যোক্তার নাম।
শুধু উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি নয়, যেসব তরুণ চাকরির বাজারের বোঝা না হয়ে ‘চাকরি না খুঁজে চাকরি দেওয়ার’ জন্য পথে নামতে চায়, তাদের জন্য প্রতি পদে আমরা বিছিয়ে রেখেছি কাঁটা। কোনো ব্যাংক তাদের পাশে দাঁড়ায় না। ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে থাকে, কিন্তু আমদানি বিকল্প এবং চায়নিজ প্রোডাক্ট থেকে উন্নত গাড়ির ব্রেক সু লাইনেজের উদ্ভাবককে ৬০ শতাংশ সুদে ব্যক্তি ঋণ নিতে হয়। যে মোবাইল ফোন আমদানি করলে ২১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, সে মোবাইল ফোন দেশে বানাতে চাইলে উদ্যোক্তাকে বাসাবাড়ি বন্ধক দিতে হয়। কারণ, ওই পণ্যের কাঁচামালের ওপর শুল্ক মাত্র ৬৯.৫ শতাংশ। যে তরুণ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে রাত জেগে কি–বোর্ডে ঝড় তুলতে চায়, তার জন্যও আমরা তৈরি করছি নতুন ‘ডিজিটাল’ বাধা। সে যদি পুরোনো দিনের সিডি-ডিভিডিতে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আমদানি করে, তাহলে তাকে কর দিতে হয় ৫ শতাংশ আর যদি সেটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে, তাহলে কর দিতে হয় ২৮ শতাংশ! এ তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু কী লাভ? আমরা নিজেদের তরুণবান্ধব হিসেবে প্রমাণ করতে চাই। কিন্তু প্রতি পদে তার উল্টোটা প্রমাণ করি।
আমি জানি হবে না, তারপরও সামনের বাজেটে তরুণদের পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রস্তাব রাখতে চাই। এবারের বাজেট হোক কর্মসংস্থানের বাজেট। না, কোনো কথার কথা নয়, সত্যিকারের কর্মমুখী বাজেট। আলাদা করে এক হাজার কোটি টাকা রাখা হোক তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য। এই টাকা পাবে তারা তাদের উদ্যোগকে বিকশিত করার জন্য। তথাকথিত এসএমই লোন বা সে রকম লাল সুতাতে আটকানো উদ্যোগ নয়। এ হবে সাত দিনে প্রসেসিং করা ঋণ (কিংবা এটি অনুদানও হতে পারে)। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতারা এবং বিশিষ্টজনেরা নিজ নিজ এলাকার তরুণদের আবেদন দেখে এই টাকা দেওয়ার সুপারিশ করবেন। তাঁদের সুপারিশ পেলেই নির্ধারিত ব্যাংক টাকাটা দিয়ে দেবে। আপনারা আমাকে যত ভয় দেখান না কেন, আমি জানি, আমাদের তরুণেরা বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো এই টাকাটা নষ্ট বা পাচার করবে না। তারা তাদের দিন বদলাবে।
বাজেটে ১০ কোটি টাকার একটা আলাদা বরাদ্দ রাখা হোক একটি ‘দ্রুত কর্মসংস্থান টাস্কফোর্সের’ জন্য। ওরা ব্যাংক সিলেকশন কমিটির মতো সরকারি চাকরির যে কোটিখানেক আবেদন নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে, সেগুলো সমাধান করবে ছয় মাসের মধ্যে। দরকার হলে স্কুল-কলেজ সাত দিনের জন্য বন্ধ রেখে আমাদের এই সব চাকরির পরীক্ষা-নিয়োগ তারা সম্পন্ন করবে।
১০০ কোটি টাকা রাখা হোক তরুণদের বিদেশে কর্মসংস্থানে সহায়তা করার জন্য। কর্মসংস্থান ব্যাংক এ টাকা বিদেশে কাজ পাবে যে তরুণ, তাকে বিনা সুদে ঋণ হিসেবে দেবে, যাতে সোনার হরিণের প্রত্যাশায় তাকে পিতা-মাতার জমিজমা বিক্রি করতে না হয়।
জানি, এ দেশে কর্মসংস্থানের সমীকরণের সমাধান খুবই কঠিন বিষয়। কিন্তু মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আমরা কি সেটা শুরু করতে পারি না?
(প্রথম আলোতে প্রকাশিত-২৪ মার্চ ২০১৭)