হ্যাপি ইন্টারনট ডে
১৯৫৭ সালে রাশিয়া ধুম করে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয় স্ফুটনিক। রাশিয়ার মহাকাশ বিজয়ের এই কাহিনী একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে দিয়ে যায় মার্কিন মুলুকে। ফলাফল হলো বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণায় ম্যালা বিনিয়োগ। এর মধ্যে একটা লক্ষ্য ঠিক করা হল চাঁদে মানুষ পাঠানো, রাশিয়ার আগে।
আর একটা হলো রাশিয়া যদি ক্ষেপে গিয়ে পরমাণু বোমা পাঠিয়ে দেয় মার্কিন মুলুকে তাহলে সেটা থেকে কেমনে বাঁচবে সেটা বের করা। তো, বাচঁতে হলে সবচেয়ে প্রথমে দরকার যোগাযো ব্যবস্থা ঠিক রাখা। তখন পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা মানে টেলিফোন কিংবা টেলিগ্রাম। এসবই কিন্তু কমপ্লিট সার্কিটের ব্যাপার। কিন্তু বোমা পড়লেতো সেটা সম্ভব হবে না। তাহলে এমন কোন বুদ্ধি বের করতে হবে যাতে একটা বার্তাকে কয়েকভাগে ভাগ করে একাধিক রাস্তা দিয়ে পাঠিয়ে গন্তব্যে সেটাকে জোড়া দেওয়া যায়। এই চিন্তা থেকে ১৯৬০ এর দশকে প্যাকেট নেটওয়ার্ক নিয়ে ভাবতে থাকে মার্কিন বিজ্ঞানীরা। ১৯৬১ সালে এমআইটির লিওনার্ড ক্লেইনর্ক প্রথম প্যাকেট সুইচিং থিউরি নিয়ে পেপার লিখেন।
১৯৬২ সালের এই এমআইটিরই জে.সি.আর লিকলাইডার অনেকগুলো মেমো লিখেন যেখানে তিনি একটা “গ্যালাকটিক নেটওয়ার্কের” ধারণার কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যদি বিভিন্ন স্থানের কম্পিউটারকে একটা কোন বুদ্ধি করে একটার সঙ্গে আর একটাকে লাগিয়ে দেওয়া যায় তবে একটা কানেকটিভিটি তৈরি হবে। এর পরপরই তিনি ডারপা (DARPA) প্রকল্পের প্রধান হোন। সেখানে তিনি আইভান সুথারল্যান্ড, নন টেইলর, লরেন্স জি. রবার্টসহ অনেককে তার নেটওয়ার্কিং পাগলামিটা বোঝাতে সক্ষম হোন। ৬৪ সালে লিওনার্ডের একটা বই বের হয়। ক্লেইনর্ক রবার্টকে সার্কিট সুইচিং এর পরিবর্তে প্যাকেট সুইচিং-এর ব্যাপারে রবার্টকে রাজি করান।
রবার্ট আর থমাস মেরিল ১৯৬৫ সালে মাসে TX-2 আর ক্যালিফোর্নিয়ায় Q-32 কম্পিউটারকে টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে যুক্ত করেন!!! এটা দিয়ে বোঝা গেল যে দুইটা কম্পিউটার ভালই কথা বলতে পারে কিন্তু টেলিফোন লাইনটা যথেষ্ট নয়। রবার্ট দৌড়ালেন ডারপা’তে সবাইকে বোঝালেন তার প্যাকেট সুইচিং এর প্ল্যান এবং দ্রুত করলেন “আরপানেট (ARPANET)”। সেটা ১৯৬৭ সালের কথা। একটা কনফারেন্সে তিনি তার পেপার পড়লেন যেখানে আরো পেপার পড়া হল একই বিষয়ে। সেখানেই “প্যাকেট” শব্দটা প্রথম গৃহীত হয়। আর আরপানেটের গতি ২৪ কেবিপিএসের পরিবর্তে ৫০ কেবিপিএস ঠিক করা হয়।
এরপর একটু ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে আমরা চলে আসি ১৯৭২ সালে। এর মধ্যে টাকা পয়সা, টেন্ডার-টেন্ডার করে আরপানেট দাড়িয়ে যায় আর ই-মেইলও চালু হয়ে যায়। ভয় থেকেই শুরু মনে হয় ইন্টারনেটের।
এই গবেষকদের দলে যোগ দেন বব কান (Bob Kahn)। তাঁর চিন্তা, ইন্টারনেট হবে মুক্ত-স্থাপত্যের ভিত্তিতে, প্রকৃতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, দ্রত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। পরে বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেটের বিকাশ হতে থাকে দ্রুত। ববই প্রথম প্রস্তাব করেন ইন্টারনেট চলার রীতি-নীতি যা এখন টিসিপি/আইপি (ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রটোকল/ইন্টারনেট প্রটোকল)নামে পরিচিত। এই টিসিপি/আইপিকে বলা যায় নেটওয়ার্কের প্রাণভোমরা। ইন্টারনেট দ্রুত বিকশিত হওয়ার একটা বড় কারণ হলো এর সব রীতিনীতিকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং যে কেও সেটা মেনে তা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। এভাবে কারিগরি দলিলাদি ‘মন্তব্যের জন্য অনুরোধ’ ( Request for Comment RFC)-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
তবে, ইন্টারনেটকে সাধারণ মানুসের কাছে নিয়ে যাওয়ার কাজটি ইন্টারনেটের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্রে হয়নি। ইউরোপের গবেষণাগার, সার্নে। সেখানে কাজ করছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী টিম বার্নাস লী। তিনি ভাবতেছিলেন ই-মেইলে তথ্য আদান প্রদান ছাড়াই কেমন করে তথ্য উন্মুক্ত করা যায়, মানে যার যখণ লাগবে তখন সে নিশ্চিন্তে সেটা পেয়ে যাবে। ১৯৮৯ সালে তিনি প্রথম একটি ওয়েবসাইট বানান, সার্নের মধ্যে। তবে তার আগে তিনি তিনটি নতুন নতুন জিনিষ ডিজাইন করেন- এগুলো হলো
- এইচটিএমএল (HTML) – ওয়েবসাইটের বেসিক ভাষা। এটি মার্ক-আপ ল্যাঙ্গুয়েজ কারণ একটার সঙ্গে আর একটা দলিলকে মার্কড করা যায়।
- ইউআরআই (URI) – এটি একটা ইউনিক ঠিকানা। ইউনিফরম রিসোর্স আইডেন্টিফায়ার। এ দিয়ে ওয়েবে একটি সাইটকে চেনা যাবে। এখন আমরা শেষের আইকে এল (Locator) বানিয়েছি।
- এইচটিটিপি (HTTP) : এটা হলো সে প্রটোকল বা নিয়ম যা কিনা ওয়েবের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
টিম বার্নাস লী’র নেকস্ট কম্পিউটারে বিশ্বের প্রথম ওয়েবসাইটটি চালু হয়। এই ওয়েবসাইটে ছিল ওয়েবের মৌলিক বিষয়গুলো। এরপর ১৯৯৩ সালের ৩০ এপ্রিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সব সফটওয়্যার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর ২৩ আগস্ট (আজকের দিনে) টিম বার্নাস লী তার ওয়েবসাইটটি সর্ব-সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
সেই থেকে ইন্টারনেটকে আর পেছনে ফিরে যেতে হয়নি।
প্রথম ৫ কোটি লোকের কাছে পৌছাতে টেলিফোনের লাগে ৭৫ বছর, রেডিওর ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। কিন্তু ইন্টারনেট সে পথ পাড়ি দেয় মাত্র ৪ বছরে। এবং শুধু তাই নয়, বিশ্বজুড়ে একটি নতুন বিপ্লবের সূচনাও করে যাকে বরা হয় তথ্য বিপ্লব! যা এখন আমাদের আষ্ট পৃষ্টে আটকে রেখেছে।
১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশও ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু কয়েকটি সমযোপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে অন্যান্যদের মতো বাংলাদেমে ইন্টারনেট সেভাবে বিকশিত হয়নি। ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের আহবানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারে নতুন জোয়ার আমরা দেখেছি। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের হিসাবে দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ কোটি। তবে, অনেকেই এই হিসাবের সঙ্গে একমত হতে পারেন না ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারে ধরণ দেখে। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা এখনো ঢাকার বাইরে স্বপ্নের মতো।
সারাদেশের মানুষের কাছে সাশ্রীয় মূল্যে ইন্টারনেট পৌছে দিতে না পারার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যে কারণে, ২০০৫ সালে যে ব্যান্ডইয়িডথের দাম ৭৫ হাজার ছিল তা এখন এক হাজার টাকার নিচে নামলেও গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম এখনও সাশ্রয়ী নয়। ধাপে ধাপে মূল্য সংযোজন করের অপপ্রয়োগের ফলে ১০০ টাকার ব্যান্ডউয়িডথ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাতে ২০০ টাকার বেশি খরচ পড়ে যায়। এছাড়া ঢাকার বাইরে ব্যান্ডউয়িডথ নেওয়ার জন্য এনটিটিএন নামে “বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচি”র মতো এক ব্যবস্থার কারণে এই সেবা ছড়িয়ে দেওযা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ব্যান্ডউয়িডথের দাম ১০০ টাকা সেটি ঢাকা থেকে খুলনা নিতে খরচ পড়ে যায় আর ৩০ টাকা!!!
স্যার টিবিএলের ওয়েব উন্মোচনের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ পালিত হচ্ছে ‘ইন্টারনট ডে’ হিসাবে। এটি এসেছে ইন্টারনেট আর এস্ট্রেনট এর সম্মিলন থেকে। মানে হলো ইন্টারনটরা নভোচারীর মতো আকাশে ঘুরে বেড়ায়। এরাই ইন্টারনেটের নানার বিষয়ের নকশা করে, প্রকোটল ডিজাইন করে এবং ইন্টারনেটকে উপভোগ করে।
তবে, যখন ইন্টারনেটের আবির্ভাব হয় তখন অনেকেই এটি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। বলেছিলেন এর কোন বিকাশ বা ভবিষ্যৎ নাই। এদের মধ্যে আমাদের দেশের সেই বিখ্যাত আমলাটিও আছেন যিনি বলেছিলেন সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ নিলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার হযে যাবে।
হ্যাপি ইন্টারনট দিবস।