এ বুক এবাউট ইনোসেন্ট : অবতরণিকা
আমাদের দেশে অনেক জায়গাতে আখের রস বিক্রি হতে দেখা যায়। এগুলো সরাসরি হাতের মেশিনে চাপ দিয়ে রস বের করে গ্লাসে করে পরিবেশন করা হয়। আমি একবার ভারতে দেখেছি একটা ছোট চাপ দেওয়ার যন্ত্র দিয়ে কমলার রস সরাসরি নিংড়ে নেওয়া যায়। ইদানীং অনেক জায়গাতে লেবুর শরবত পাওয়া যায়। গরম কালেতো বটেই, অন্য সময়েও শরবতের বিকল্প কেবল শরবরতই। বেশ কয়েক বছর আগে, কোন এক রমজান মাসের ইফতারীর সময় আমার বাসায় জাম্বুরা, আমড়া ইত্যাদির শরবত বানাতাম। বৈশাখ জৈষ্ঠি মাসে কাচা আমের শরবত বানানোতে মনে হয় কারোরই কোন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। হালের প্রায় বড় কফিশপগুলোতেও পুদিনা পাতার শরবত যথেষ্ট জনপ্রিয়। কক্সবাজারের পুদিনা ক্রাশারের কথা আগের একটা ব্লগেও লিখেছি।
শুধু শুধু নয়, কথাগুলো মনে পড়ছে ইউরোপের অন্যতম সবচেয়ে জনপ্রিয় শরবত ইনোসেন্টের ওপর একটা বই পড়তে গিয়ে। ইউরোপের১৩টা দেশের মাত্র আট হাজার আউটলেটে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ লক্ষ বোতল ইনোসেন্ট স্মুথি বিক্রি হয়ে থাকে। স্মুথির বাংলা হিসাবে আমি শরবতটাতেই বেঁছে নিয়েছি। যদিও একটা মৌলিক পার্থক্য হল শরবত আর স্মুথিতে পানির পরিমান। পরেরটাতে পানি কম থাকে। আমাদের লেবুর শরবতে অবশ্য ৯৯% পানিই।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বন্ধু রিচার্ড রীড, এডাম বেলন আর জন রাইট ১৯৯৮ সালে ইনোসন্ট নামের এই শরবত কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন মাত্র ৫০০ পাউন্ড হাতে নিয়ে। এখন তারা প্রত্যেকেই বিশাল ধনীলোক। আগে বলেছি ইনোসেন্ট বিক্রয় হয় ১৩টা দেশে। কোম্পানির ভ্যালুয়েশন মাত্র ১০ কোটি পাউন্ড!!! (এক হাজার কোটি টাকার বেশি) এর ৯০%এর বেশি ওরা বিক্রি করে দিয়েছে কোকা কোলা কোম্পানির কাছে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে তিনবন্ধু একত্রে একটা বিজনেজ করবে বলে চিন্তা করেছিল। তবে তারও আগে ওদের ভাল হাতে খড়ি হয়েছিল। কেমব্রিজে পড়ার সময় ওরা লক্ষ করে ওদের মতো অনেকেই আছে যারা বারে গিয়ে বিয়ার খাওয়া আর রাগবী গান গাইতে আগ্রহী নয়। এটিকে ক্যাশ করার জন্য তিন বন্ধু একটি নাচা-গানার প্রোগ্রাম শুরু করে তাদের রুমে। এটির নাম দেওয়া হয় “প্লিজ”। প্রতি পক্ষে তাদের রুমে এই পার্টি হত। শেষমেষ এটি এত বড় হয়ে যায় যে, কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত সেটি বন্ধ করে দেয়।
সেখান থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা লাভ করে-
- যেখানে কোন ‘অভাব’ সেখানেই সম্ভাবনা,
- কোন রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই কিছু একটা শুরু করা ও সফল করা সম্ভব,
- তিনজন একত্রে কাজ করতে ভালবাসে এবং তাদের একটি ভাল টিম হয়।
পাস করার পর তিনজনই তিনটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে ঢুকে যায় কিন্ত হল থেকে তারা তিনজন ওঠে একই বাড়িতে। বেশিরভাগ উইকএন্ডে তারা নিজেদের ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করতো।
আলাপের মূল অংশ ছিল বাজারে কি এমন অভাব আছে যেটি তারা পূরণ করতে পারে?
২৬ বছরের তিন যুবক, আমাদের ভাষায়, মেস বাড়িতে থাকে। রান্না বান্না করার তেমন সুযোগ নাই। তাহলে তাদের খাদ্য-পানীয় তালিকায় কী থাকে?
ফাস্ট পুড আর কোমল পানীয়। কিন্তু সবাই কি এই খেয়ে খুশী থাকতে পারে। ওদের মনে হল যদি এমন কোন স্বাস্থ্যকর পানীয় থাকতো যা পান করলে স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করতে হবে না কিন্ত পানীয়র তৃপ্তি পাওয়া যাবে। তারা নিজেরাই বুঝলো যে, এই ধরণের কিছু যদি বাজারে আসে তাহলে তারাই তার প্রথম ক্রেতা হবে।
এই থেকে তারা বাজারের “চাহিদা” নিরুপন করলো। আর নিজের মত করে তার একটা সমাধান চিন্তা করলো এই ভাবে – ফলের জুস করে সেটি বোতলে ভরে দিবে। বোতলে দেওয়া হলে কেও অফিসে যাবার পথে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে আর তার অফিসে হাবিজাবি পানীয় খেতে হবে না। ওরা সবাই শরবত বানাতে পারে। কাজে কাজটি কঠিন হবে বলে তারা মনে করে নাই।
নতুন নয়, একটু ভাল
বোতলে করে ফলের জুস বিক্রি করাটা নতুন কিছু নয়। সেই সময় ইংল্যান্ডেও বেশ কয়েকটা ভাল ব্র্যান্ডের জুস ছিল। তবে, সেগুলোর বেশিরভাগ জুস তৈরি হতো ফলের কনসেনট্রেশন থেকে। ফলে সেখানে সত্যিকারের জুসের স্বাদ থাকতো না। ওরা ভাবলো যে, ওরা সরাসরি ফলের রসটাই দেবে। সঙ্গে পানি এবং দরকার হলে কিছু আদা কিংবা গোল মরিচ (যখন যেখানে লাগে)।
১৯৯৮ সালের একটা খেলার মাঠে ওরা নিজেদের বানানো ২৪ বোতল ইনোসেন্ট ড্রিংক নিয়ে যায়। সঙ্গে দুইটি বড় বালতি। একটাতে লেখা ছিল – YES অন্যটাতে NO। যারাই শরবত নিচ্ছিল তাদের সবার প্রতি একটা অনুরোধ ছিল। “আপনি যদি মনে করেন এই শরবতটা ভাল তালে পানের পর বোতলটা ইয়েস ঝুড়িতে ফেলবেন। আর যদি না হয় তাহলে না’র ঝুড়িতে। যদি বেশিরভাগ লোক হ্যা বলে তাহলে আমরা চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করবো।”
দিন শেষে দেখা গেল মাত্র দুইটা বোতল না’র ঝুড়িতে।
কাজে পরদিন তিনবন্ধু অফিসে গিয়ে নিজ নিজ চাকরি ছেড়ে দিল। সন্ধ্যায় একত্রিত হয়ে গঠন করলো ইনোসেন্ট ইনকরপোরেট।
কিন্তু, ব্যবসা করা কি এতই সোজা?
[আমি বেশকিছুদিন ধরে আমরেকিার সিলিকন ভ্যালির আইটি স্টার্টআপ এবং তাদের লড়াই-সংগ্রাম-সাফল্যের কথা পড়েছি নানান বইতে, ইন্টারনেটে। এবার একটু ভিন্ন পরিমন্ডলে পড়ার চেষ্টা শুরু করেছি। মূলত সাবিরুলের দেশে আসার পর থেকে সেটা নিয়ে ভাবছি যে ব্রিটিশরা যেহেতু আমাদের এখানে একটা সংস্কৃতির আবহ তৈরি করে গেছে কাজে তাদের ব্যাপারগুলো দেখলে কেমন হয়। সেই ইচ্ছাতে আমি ইংলন্ডের কিছু কোম্পানির যা কিনা একেবার ছোট থেকে শুরু হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে পড়বো বলে ঠিক করেছি। এমনিতে আমি যা পড়ি তা সবসময় শেয়ার করার চেষ্টা করি। একটা কারণ হয়তো আমার মনে হয় আমাদের উদ্যোক্তাদের প্রচুর পড়া উচিৎ। ইউরোপে পড়ার একটা অন্যরকম সংস্কৃতি আছে। রেলস্টেশনে, পার্কে বাস স্টপেজে অনেককে দেখা যায় কোন না কোন বই-এ মশগুল থাকে। সুডোকু মেলায়, ক্রসওয়ার্ড সমাধান করে কিংবা পড়তে থাকে। আমরা কেন জানি সেরকম পড়ুয়া নই। মুজতবা আলীর ভাষায় – সে তো ওর একটা আছেই! যাকগে, বই -এর কথা শেয়ার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের নতুনরাও যেন পড়ে সেটার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া।
বুক এবাইট ইনোসেন্ট নিয়ে আমার পড়া আর যাত্রাটা আমি ধারাবাহিকভাবেই শেয়ার করবো আমার ব্লগে। যখনই সময় পাবো কিছু কিছু করে লিখে রাখবো।
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক]
11 Replies to “এ বুক এবাউট ইনোসেন্ট : অবতরণিকা”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
পড়ে ভালো লাগল। অসাধারণ লিখেছেন।
ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে………
Thanks. Vhalo laglo…
নতুন নয় একটু ভাল –
থিয়োরিতে উদ্যোগ নেয়ার মত এদেশে হাজারটা সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের চামড়া বড় নরম। ইগোর মোড়কে আবৃত্ত। অনেক কিছু ভাবলেও করা হয়ে উঠে না পাছে লোকে কিছু বলে সেই ভয়ে। ভরসা আর সাহস পেলাম। এমন একটি উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি এই বছরের প্রথম থেকে। আমাদের বিষয়টাও নতুন নয় একটু ভাল। পাইলটিং সফল হলে আপনাকে দিয়েই উদ্ভোদন করানোর ইচ্ছা আছে। 🙂
পুরো লেখাটা পড়ার প্রত্যাশায় রইলাম।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা এমন শম্বুক গতিতে শেয়ার কইরেন না ভাই। হজম হয় না। রাতে ঘুম হয় না। অস্থির লাগে। 🙁
“যেখানে কোন ‘অভাব’ সেখানেই সম্ভাবনা”
আসল সূত্রটা এটাই
ভাল লাগছে স্যার। ব্যাতিক্রম সফলতার গল্প।
Very inspiring real story. Good for beginners.
Valo laglo pore….