ইনোসেন্টের শেষ কিস্তি : কান পেতে রই
খুটিনাটি, খুটিনাটি
স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা মাত্রই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। সে তোমার ব্যবসা বড়, ছোট, নতুন বা পুরাতন যাই হোক না কেন তোমার প্রতিদ্বন্দ্বিরা সারাক্ষণই তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। তাদের ব্র্যান্ড বড়, ওদের পণ্যের মান তোমার থেকে ভাল, ওদের বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত এবং মিটিং রুমের বিস্কুটও হয়তো তোমার চেয়ে সুস্বাদু। তুমি যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে চাও তাহলে তোমাকে এর একটি এবং কখনো কখনো সব কটিতে পরাজিত করতে হবে। এখানেই শেষ নয়, ওদের হারিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তোমাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
এটি খুবই খারাপ খবর সন্দেহ নেই। সুখবর হচ্ছে একবার যদি তুমি তোমার বড় ব্যাপারগুলো সামলে নিতে পারো তাহলে ছোট ছোট কিন্তু ডিটেইল কাজ তোমাকে ম্যালা ফুরসত দিবে এই লড়াইয়ে জেতার।
ভার্জিন আইলান্টিক যখন মধ্য আকাশে যাত্রীদের হঠাৎ করে আইসক্রিম খাওয়ায়, যখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিছু কিনলে লেবুর শরবত খেতে দেয় কিংবা কোন কাপড় বিক্রেতা গাউছিয়া মার্কেটের প্রচন্ড গরমের মধ্যে বিনামূল্যে খাবার পানি সরবরাহ করে, তখন তারা সকলই ক্ষুদ্র কিন্তু ডিটেইলে কাজ করেন। তারা তাদের গ্রাহকদের বলার মত গল্পের খোরাক যোগায় এবং হয়তোবা আবার তাদের কাছে ফিরতে উদ্বুত্ত করে।
এজন্য আমরা একেবারে শুরুর দিন থেকে ফোকাস করেছি ডিটেইলে। বোতলের লেবেল থেকে শুরু করে ভ্যান গাড়ি, ফ্রুট টাওয়ার সাজানো কিংবা ব্লগের লেখাÑসবটাতেই আমরা ছোট ছোট বিষয়গুলোকে বড় করে দেখেছি।
একটি ছোট, ক্ষুদ্র ধারণা নিজে কিন্তু সে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এরকম ধারণা যদি বেশি হয় এবং সেগুলোর সুর-তাল-লয় যদি একই ছন্দে ছন্দিত হয় তাহলে তা হয়ে ওঠে একটা চমৎকার ব্যাপার, সম্পূর্ণ ব্যাপার।
একই সুর, একই তাল
আমাদের কোম্পানির মূলসুরটা এসেছে বন্ধুত্ব থেকে। কারণ আমরা তিনবন্ধু মিলে এটা শুরু করেছি। আমরা নিজেদের মধ্যে এবং গ্রাহকদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঢঙেই কথা বলি (শুধু কিছু শব্দ বাদ দেই!)। এর মাধ্যমে আমরা একটা সহজাত, উষ্ণ, মুক্ত কিন্তু ধারাবাহিক সম্পর্ক রাখতে পারি। এছাড়া বন্ধুর মতো কথা বলা ‘আমাদেরকে অতিরিক্ত সিরিয়াস’ হতে রক্ষা করেছে। এখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলোকে যাচাই করি সেগুলো ‘ইনোসেন্ট’ কী না?
লেবেল ডিটেইল
শুরু থেকে আমাদের মনে এই ধারণাটা পোক্ত ছিল যে স্মুথির লেবেল আসলে খুব একটা আকর্ষণীয় নয় এবং সেগুলো কেও পড়ে না। আমরা এটা নিয়ে ভেবেছি এবং আমাদের লেবেলকে কীভাবে পড়ানো যায় তার উপার খুঁজেছি। কয়েকমাস ধরে শরবত বেঁচার পর একদিন আমরা একটা চিঠি পেলাম স্থানীয় খাদ্য-মান কর্মকর্তার কাছ থেকে। তিনি দেখেছেন আমাদের একটা জুসে উপকরণের মধ্যে Ô2 plump nunsÕ লেখা আছে! আমরা দুঃখ প্রকাশ করে জানালাম যে, এটা একটা কমেডি কারণ কেও নিশ্চয়ই বোতলের মধ্যে নানদের খুঁজবে না। তিনি সেটা মানলেন না। বললেনÑএটা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। কাজে প্রচুর হিয়ারিং, আইনজীবির পর আমরা একটা চিঠি পেলামÑ”Remove ‘plump nuns’ on your lebels or start putting them in your juice’!!
একদিন দেখা গেল জন ফ্রুট টাওয়ারে এসেছে, ওর টি-শার্টে সব শরবত। ঘটনা কি?
বাসে করে ফেরার সময় জন ভাল করে স্মুথির বোতলটা ঝাকাতে শুরু করে। বেচারা ভুলে গিয়েছিল তার আগেই সে বোতলের মুখ খুলে ফেলেছে।
এর পরপরই আমরা লেবেলে লিখে দিলাম – খোলার আগে (পরে নয়) ঝাকিয়ে নিন।
আমাদের ভ্যান গাড়ি
ভেলিভারি ভ্যান হিসেবে আমরা শুরুতে একটা সাদা ভ্যান ব্যবহার করতাম। এটি ফ্রিজভ্যান ছিল। রিচার্ডই চালাতো। কিন্তু প্রায়শ সরু রাস্তাগুলো খেয়াল করা হতো না। ফলাফল হলো গাড়িটার চেহারা।
ক’দিন পরে আমরা ছোট আর একটা ভ্যান কিনলাম। কিন্তু এটাও সাদা। লন্ডন শহরে সাদা ভ্যানের কোন কমতি নেই। সব বোরিং। আমরা ভাবলাম কীভাবে ভ্যানটাকে আকর্ষণীয় করা যায়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভ্যান থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হলামÑ The Dumb and Dumber Mutt Cutts Van| আমরা গাড়িটাকে গরুর মতো করে সাজালাম। কারণ সে সময় আমরা দই বিক্রি করতে শুরু করেছি। লোকে এটাকে ভালভাবেই নিল। পরে আমরা আমাদের ভ্যানকে এস্টোট্রার্ফ দিয়েও সাজাই। কিছু হাইড্রলিক বুদ্ধি দিয়ে সেগুলোকে নাচানোয় বুদ্ধিও বের করা হল।
লন্ডন, ডাবলিন, প্যারিস, কোপেনহেগেন, হামবুর্গ, স্টকহোম ও সলজবার্গে আমাদের সাতটি অফিস। সবকটাকে আমরা একই রকমভাবে সুন্দর করে সাজিয়েছি খাতে লোকে সেখানে যেতে আনন্দ পায়। ঢোকার রুম থেকে কিচেন পর্যন্ত সবটাতেই আমরা যত্ন নিয়েছি।
আমাদের স্মুথি যে সকল দোকানে সাজিয়ে রাখা হয় তাদের জন্য আমরা কিছু হাতমোজা দিলাম। কারণ ওদের সারাক্ষণই ফ্রিজ খুলতে-বন্ধ করতে হয়। মাঝে মধ্যে আমরা আমাদের ক্রেটের মধ্যে টকলেট রেখে দিতাম। যাতে যারা ক্রেট থেকে স্মুথি নিয়ে শেলফে সাজায়, তারা যেন আগ্রহী হয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্মুথি বিক্রি করে তাদের জন্য সার্টিফিকেটেরও ব্যবস্থা করেছি।
তবে, মাঝে মধ্যে আমাদের ভিন্নরূপ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা দাওয়াত দিয়েছিলাম সিদ্ধ ডিম-স্ট্র দিয়ে একটা কিছু বানিয়ে। কিন্তু একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে সিদ্ধ ডিমের পরিবর্তে কাঁচা ডিম চলে যায়!!!
বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় কয়েকটি মাথা থেকে সেগুলো বের হয়। কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয় কিন্তু নিতে হয় সবার কাজ থেকে। কাজে আমরা সারাক্ষণ চোখকান খোলা রাখতাম এ ব্যাপারে।
কেবল মুনাফা নয়
তবে আমরা কেবল মুনাফার জন্য ব্যবসা করি নি, আমাদের মুনাফার একটা অংশ আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভাল কাজে ব্যয় করেছি, করছি। ভারত, মালাবি, কেনিয়াসহ নানান জায়গার আমরা আমাদের মুনাফা কাজে লাগাই। গরীব মানুষের জন্য।
কান পেতে রই
আমরা আমাদের কাস্টোমারদের ভালবাসি। ওদেরকে ছাড়া আমাদের সব কর্মকাণ্ড হয়ে যেত খরুচে শখ এবং আমাদের গুদামঘরগুলো ভরে থাকতো বোতলে। আমরা সবসময় আমাদের ড্রিংকারদের চিন্তা ভাবনা, কথা শুনতে চাই, জানতে চাই। একটা ডায়ালগ সব সময় চালু রাখি। আমরা আমাদের অফিসের দরজা সবসময় খোলা রাখি। আমরা আমাদের কাস্টোমারদের সঙ্গে দেখা করি, হ্যান্ডশেক করি, মোলাকাত করি, গল্প করি।
একদম প্রথম লেবেলে আমরা আমাদের গ্রাহকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কোন এজেন্ডা ছাড়াই। অনেকে আসেন। আমরা তাদেরকে একটা অফিসিয়াল ভিজিট দেই। সব ঘুরে দেখাই। একটা ড্রিংক অফার করি। হয়তোবা ছবি তোলা হয়।
আমরা সবসময় ইন্টারনেটে আমাদের কান পেতে রাখি। আমাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে ‘রেইট এন্ড রিভিউ’ বাটন। যে কেউ ইচ্ছে করলেই আমাদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে লিখতে পারে। কারণ আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শরবত বাই দি পিপল, ফর দি পিপল।
তারপর আছে আমাদের ব্লগ। ব্লগে আমরা মতামত, সাজেশন, রিভিউ করে যাচ্ছি। আমাদের আছে ব্যানানা ফোন। আমরা সবসময় ফোনে কথা বলি। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করা ছাড়া আমরা নিজেরাই চালু করেছি ইনোসেন্টের মেলা। নানানভাবে আমরা মানুষকে সম্পৃক্ত করেছি।
মানুষ ভালবেসে আমাদের অনেক কিছু উপহার দেয়। এরকম একটি ট্যাপেস্ট্রি আমাদের অফিসে পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের সাপ্লাই চেনের পুরোটাও দেখভাল করি। সবাইকে নিয়ে অথবা ছোট ছোট গ্রুপেসবসময় পার্টির ব্যবস্থা করি।
যে ব্যবসার কান নাই, সে বিরাজ করে না। কাজে আমরা আমাদের এই বিষয়টা সবসময় মাথায় রাখি।
যদি কখনো ফ্রুট টাওয়ারের পাশ দিয়ে যাও, আমাদের বাড়িতে এসো। তোমার জন্য একটা শরবত নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকবো।
[ব্রিটিশ স্মুথি ইনোসেন্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে এর তিন উদ্যোক্তার লেখা বই – এ বুক এবাউট ইনোসেন্ট। মূল অংশগুলো শেয়ার করছি সবার সঙ্গে, আমার মত করে। বইটি উত্তম পুরুষে লেখা এবং আমিও সে স্টাইল নিয়েছি। বেশিরভাগ জায়গা ওদের ভাষায় তুলে দিয়েছি। কতক ক্ষেত্রে আমার কিছু সংযোগ আছে মাত্র]। –
[যারা কষ্ট করে দীর্ঘ সময় ধরে আমার সঙ্গে এই চমৎকার মনোমুগ্ধকর বইটি পড়েছেন তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। সম্ভবত এই প্রথমবার আমি কোন বই সম্পূর্ণটা শেয়ার করতে পারলাম।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।]
3 Replies to “ইনোসেন্টের শেষ কিস্তি : কান পেতে রই”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
chomotkar lagche
বিরতিহীনভাবে পড়লাম। অসাধারণ লেগেছে। পুরা গল্পটা পড়ার সময় কেমন একটা ঘোরের ভিতর ছিলাম। কষ্ট করে, অনেক সময় ধরে লিখে বইটি শেয়ার করার জন্য ‘মুনির হাসান’ স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আশা করবো স্যার তার এই সেবা অব্যাহত রাখবেন 🙂
এক টানে পড়ে ফেললাম, ভাল লাগল, ধন্যবাদ আমাদের সাথে অনুবাদ শেয়ার করার জন্য