আন্তর্জাতিক আলোক দিবস ২০১৯
আলো ও সর্বক্ষেত্রে আলোর প্রায়োগিক দিক নিয়ে আয়োজিত একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ এই আন্তর্জাতিক আলোক দিবস। বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন থেকে শুরু করে চিকিৎসাশাস্ত্র, যোগাযোগ এমনকি শক্তির উৎস হিসাবে আলোর ভূমিকা ও এর বহুমুখী প্রয়োগ অনুধাবন ও মূল্যায়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এ আয়োজন করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের বিশাল পরিসর সমাজের বিভিন্ন অংশকে একসঙ্গে এসে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। এই কর্মযজ্ঞ একই সঙ্গে ইউনেস্কোর “শিক্ষা, সমতা ও শান্তি” অর্জনের লক্ষ্যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং শিল্প-সংস্কৃতির একইসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে।
আলোক দিবসের উদ্যোক্তা ও আয়োজক
আন্তর্জাতিক আলোক দিবস আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল বেসিক সায়েন্স প্রোগ্রাম বা আইবিএসপি। এই আয়োজনের পরিচালনা কমিটিতে ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্যবৃন্দ। প্রতিটি দেশের একটি করে সহযোগী সংগঠন ন্যাশনাল নোড হিসেবে কাজ করে। ওই সংগঠন মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের সকল আয়োজন সমন্বয় করে। বাংলাদেশের ন্যাশনাল নোড হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি (এসপিএসবি)।
আলোক দিবসের তারিখ
২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ মে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৬০ সালের এই দিনে প্রথমবার পরীক্ষাগারে পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী থিওডর মাইমান সফলভাবে লেজার রশ্মি তৈরি করতে সক্ষম হন। কীভাবে একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যোগাযোগ, চিকিৎসা ও অন্য অনেক ক্ষেত্রে একই সঙ্গে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে, লেজার তার একটি চমৎকার উদাহরণ। যদিও আন্তর্জাতিক আলোক দিবসের উদ্দেশ্য শুধু বিজ্ঞান নয় বরং শিল্প-সংস্কৃতি এবং উন্নয়নসহ সকল ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থে আলোর প্রয়োগ নিয়েই আলোক দিবস কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আলোক দিবসের প্রধান যত বিষয়
ফোটোনিকস
বিজ্ঞানের ধারনা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু আলো। শত শত বছর ধরে আলো আর তার বৈশিষ্টসমূহ বিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় তুলে এসেছে। ইবনে আল হাইথাম থেকে আইনস্টাইন পর্যন্ত সকলেই আলো নিয়ে কাজ করে গেছেন। গামা রশ্মি থেকে রেডিও তরঙ্গ, আলোকবর্ণালী আমাদের সামনে তুলে ধরেছে বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য থেকে আজকের পৃথিবী বদলে দেয়া প্রযুক্তি পর্যন্ত। ন্যানোফোটোনিক কিংবা কোয়ান্টাম অপটিকসের উচ্চতর গবেষণা মেলে ধরেছে নতুন সব আবিষ্কারের সুযোগ আর বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা। আলোকভিত্তিক প্রযুক্তি আর ফোটোনিকস সরাসরি মানবজাতির কাজে লাগছে, দিচ্ছে তথ্যভান্ডারে অবাধ প্রবেশাধিকার, টেকসই উন্নয়ন ও উচ্চতর জীবনমান। ফোটোনিকস ভিত্তিক শিল্পগুলো হয়ে উঠছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। উন্নততর ঔষধ, কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা ও শক্তি উৎপাদনে ফোটোনিকসের ব্যবহার সমাজে নিয়ে আসছে ইতিবাচক পরিবর্তন। দৃষ্টিশক্তি উন্নয়নের প্রযুক্তি থেকে হাতের স্মার্টফোনটি, মহাকাশ পর্যবেক্ষন প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ইন্টারনেট বিপ্লবের ফাইবার অপটিক কেবল – ফোটোনিকসের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেন সর্বব্যাপী।
আলো ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা
আলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগ সমাজের সমাজের উন্নয়ন ও ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। ক্রমবর্ধনমান সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার্থে এর প্রয়োজনীয়তাও অসীম। বিশ্বের শক্তি উৎপাদন, টেকসই উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্য সংরক্ষনে ফোটোনিকস ব্যবহারিক ও সাশ্রয়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা “দারিদ্র দূরীকরন, অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহন” অর্জনের সংগ্রামেও ফোটোনিকস এক অন্যতম হাতিয়ার। ফোটোনিকস বিশ্বের নাগরিকদের ইন্টারনেট ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত রাখে। ব্যবসা ও শিক্ষার এক অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়েছে এখন ফোটোনিকস। এই নেটওয়ার্ক জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার, শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা তথা শান্তি নিশ্চিত করে। আলোকপ্রযুক্তি চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম চাবিকাঠি। রোগনির্নয় থেকে শুরু করে উন্নত রোগনিরাময় প্রক্রিয়া ও গবেষণা, সবকিছুতেই রয়েছে আলোকপ্রযুক্তির বিবিধ ব্যবহার। রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তি জন্ম দেয় টেকসই কৃষিব্যবস্থার, যা বিশ্বের ক্ষুধা নিবারনের অন্যমত হাতিয়ার। একই সাথে টেকসই কৃষিব্যবস্থা জলাশয় ও সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার অন্যতম নিয়ামক। আধুনিক আলোকব্যবস্থা জীবনযাত্রার মানোয়ন্নে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব সমাধান দিতে পারে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মনিটর করা ও এর প্রভাব অনুমান করার জন্য আলোক ভিত্তিক কার্যকর সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা
আলো একটি অনুপ্রেরণামূলক বিষয় হওয়ায় তরুণদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করার উৎকৃষ্ট উপায়। বিশ্বব্যাপী শিশুদের উদ্দ্যেশ্যে করা আলোক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা কর্মসূচি, লিঙ্গ বৈষম্যজনিত সমস্যা তুলে ধরে এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশকে কেন্দ্র করে শিক্ষা্র সুযোগ গড়ে তোলে।
উদ্ভাবন ও উদ্যোগ
বিজ্ঞান ও আলোর বহুবিধ প্রয়োগ স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় উদ্ভাবনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে আসছে, এমনকি সংকটপূর্ণ পরিবেশেও। আলো ও এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও শিক্ষা নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী করার পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠারও প্রেরণা দেয়।
সংস্কৃতি
আলো মানুষের সংস্কৃতিতে যুগ যুগ ধরে প্রভাব ফেলে আসছে, এবং এখনও ফেলছে। আলো ও সংস্কৃতির যোগসূত্রকে ইসলামের স্বর্নযুগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত স্টাডি করলে বিজ্ঞান, শিল্প ও মানবিকতার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন আলোয় চেনার এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভালভাবে বোঝার ও জানার সুযোগ হয়ে ওঠে। আলো সবসময়ই শিল্প-সাহিত্য ও মানুষের চিন্তাধারায় বড় ভূমিকা রেখে এসেছে। আলোর এই থিম তাই বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরির মাধ্যমে এই দুই জগতের মধ্যকার অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে দেয়ায় অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
আলোক দিবসের আয়োজন
বিশ্বব্যাপী আলোক দিবস উদযাপিত হচ্ছে। অর্ধশতাধিক দেশে কয়েক শত আয়োজনের মাধ্যমে মানব জীবনে আলো ও আলোক প্রযুক্তির অবদানকে উদযাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সমন্বয়ে আয়োজিত হচ্ছে নানান অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশে যত আয়োজন
বাংলাদেশের আলোক দিবসের কার্যক্রমের সমন্বয়ক হিসেবে দিবসটি এসপিএসবি নানা আয়োজনে পালন করছে। আয়োজনগুলোর মধ্যে রয়েছে, আলোর দ্যুতি, শিশু-কিশোরদের আলোক ভাবনা, অনলাইন কুইজ, আলো ও আলোক প্রযুক্তি সম্পর্কে বক্তৃতা।
আলোর কথামালা
আমরা আলোর মধ্যে বাস করি। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহুর্ত আমরা আলোর মধ্যে থাকতে চাই। কিন্তু আলোকে নিয়ে কতটা ভাবি? আমাদের দেখা আলোরই না দেখা একটা রূপ আছে। যে রূপ অসম্ভব চমকপ্রদ। যার অনেক কিছুই হয়ত আমরা সাধারণভাবে ভাবি না। ওই রূপটা কেমন তা নিয়েই এই আলোর কথামালা। আন্তর্জাতিক আলোক দিবস ২০১৯ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির নানা আয়োজনের একটি এই আলোর কথামালা। এই আলোর কথামালায় বক্তৃতা দিবেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সভাপতি, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বক্তৃতার শিরোনাম: দেখা আলো না দেখা রূপ
বক্তা: অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি
সময় ও তারিখ: বিকাল ৩:০০ টা, শুক্রবার, ১৭ মে ২০১৯
স্থান: বিসিএস ইনোভেশন সেন্টার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, ৩৩/বি, ধানমণ্ডি আ/এ, রোড ০৪, ঢাকা ১২০৫
বক্তৃতা সম্পর্কে আরও জানা যাবে ফেসবুক ইভেন্টে:
https://www.facebook.com/events/552102288647977/
আলোর দ্যুতি
হাতে-কলমে আলো সম্পর্কিত ধর্মগুলোর অভিজ্ঞতা অর্জনের আয়োজন আলোর দ্যুতি। শিক্ষার্থীরা স্কুলে-কলেজে আলো সম্পর্কে যা কিছু শিখে, যেমন প্রতিফলন, প্রসরণ, সমাবর্তন, অপবর্তন পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন, এসবকিছু একদম হাতে কলমে শেখার আয়োজন এই আলোর দ্যুতি। দেড় ঘণ্টার এই আয়োজনে আলোর মূল ধর্মগুলোর প্রতিটির ধারাবাহিক এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বইয়ে পড়া আলোকে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে।
স্থান: মাকসুদুল আলম বিজ্ঞানাগার, ২১০/২ শেলটেক নিড়িবিলি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা
তারিখ: ১৬ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার
সময়: দুপুর ২:০০-৪:০০ টা
আলো ও আলোক প্রযুক্তি কুইজ
আলো ও আলোক প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে এই অনলাইন কুইজটি আয়োজন করা হয়েছে।
বিষয়: আলো ও আলোক প্রযুক্তি
অংশগ্রহণকারী: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
শিশু-কিশোরদের আলোর উপস্থাপনা
স্থান: মাকসুদুল আলম বিজ্ঞানাগার, ২১০/২ শেলটেক নিড়িবিলি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা।
সময়: ১৬ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, দুপুর ৩:৩০-৪:৩০ টা
বিষয়: আলো আমাদের কী কাজে লাগে?
আলোক দিবসের আহবান
আলো নিয়ে এই আয়োজন শুধু আমাদের নয়, আলোর ভুবনের প্রতিটি মানুষের। তাই আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ১৬ মে প্রথম আন্তর্জাতিক আলোক দিবস উদযাপনে অংশ নিতে। সেজন্য আপনি যেমন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, তেমনি নিজেও উদ্যোগী হতে পারেন দিবসটি উদযাপনে কোন কিছু করতে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করতে পারেন আলোর এক্সপেরিমেন্টের সেশন আলোর দ্যুতি, আলোচনা করতে পারেন আলো নিয়ে, ছোট করে আয়োজন করতে পারেন কুইজ প্রতিযোগিতা অথবা এমন কোনকিছু। এজন্য একাডেমিক কোন সহায়তার প্রয়োজন হলে আমরা সানন্দে থাকব আপনার পাশে, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
আমরা মনে করি, অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে জেতা যায় না। অন্ধকারকে দূর করতে হলে আলো জ্বালাতে হয়। আন্তর্জাতিক আলোক দিবস উপলক্ষে আপনাদের সবার কাছে আমাদের আহবান, আসুন অন্ধকারকে দূর করতে আমাদের চারপাশে আলো জ্বালি। আমাদের সবার জীবন আলোকিত হোক।
লেখা – ইব্রাহিম মুদ্দাদসের