এই কর্মযজ্ঞ বা উদ্ভাবন তবে কে করিবে?
তিন অদম্য তরুণ মিলে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নামের একটি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। লক্ষ্য হলো দারিদ্র্যের কারণে পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় সাহায্য করা। সহায়তার মধ্যে কেবল আর্থিক সহায়তা থাকে না, বরং এইচএসসি পরীক্ষার পর তাঁদের ঢাকায় এনে ভর্তির সহায়ক কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় থাকার জন্য সাময়িক হোস্টেলও খোলা হয়। চলতি বছরে এ রকম ২৯১ জন শিক্ষার্থীর ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সম্প্রতি। তাঁদের বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গের। অন্যরা বরিশাল ছাড়া অন্যান্য বিভাগের। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম কর্মজীবনে কে কে তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করতে চান? একটি হাতও ওঠেনি!
আমি অবাক হইনি। কারণ, কয়েক মাস ধরে তারুণ্যের যেকোনো আয়োজনে আমি এই প্রশ্নের এমন উত্তরই পেয়ে আসছি। মাস দুয়েক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শীর্ষস্থানীয় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করে। সেই সংলাপের একটি প্যানেল সদস্য হিসেবে আমি একই অবস্থা দেখেছি। একজনকেও পাওয়া যায়নি, যে কিনা তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করতে ইচ্ছুক। চট্টগ্রামে একটি ‘ক্যারিয়ার সামিটে’ কেবল ব্যতিক্রম দেখেছি। ২৫০ জন উপস্থিতির মধ্যে ১ জন তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। ভাবা যায়?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টির কারণ জানতে চেয়েছিলাম। অধিকাংশ তরুণ-তরুণী তৈরি পোশাকশিল্পে তঁাদের অনাগ্রহের যে কারণগুলো দেখিয়েছেন, সেগুলো খুবই আশ্চর্যজনক। যেমন তঁারা বলেছেন, শিল্প-পরিবেশ কর্মসহায়ক নয়, পরিবারকে বেশি সময় দেওয়া যায় না, কাজের তুলনায় বেতন কম, প্রমোশনের সুযোগ কম ইত্যাদি। আমার জানা তথ্যের সঙ্গে এসবের অসংগতি টের পেয়ে তাই আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হলো। বিশ্বের গ্রিন ফ্যাক্টরি হিসেবে চিহ্নিত পোশাক কারখানার বেশির ভাগই কিন্তু বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক কালে যে কয়টি কারখানায় গিয়েছি, কোথাও আমি ‘কাজের পরিবেশ নেই’ এমন অভিযোগের সত্যতা দেখিনি। রানা প্লাজা ঘটনার পর এখন কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারটি অনেক বেশি সামনে চলে এসেছে।
আমার ধারণা, কারখানায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যার হার তৈরি পোশাকশিল্পে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ অফিসেই আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে ওভারটাইম পাওয়া যায়। পদোন্নতি ও বেতন–ভাতার ব্যাপারটিও আমার জানাশোনার সঙ্গে মেলে না। আমি দেখেছি, মাত্র ১৩ বছরে নবীন কর্মী থেকে কান্ট্রি ম্যানেজার হওয়া যায় এই শিল্পে। আর দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করলে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপরের দিকের বেতন-ভাতা এখনো এই দেশে সর্বোচ্চ।
এসব দেখে বোঝা যায়, তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে আমাদের তরুণদের মধ্যে একধরনের বিরূপ ধারণা রয়েছে। সবার ধারণা, সেখানে শুধু সেলাই কর্মীরাই কাজ করেন। অথচ তাঁরা ভাবছেন না যে ৩০ লাখ শ্রমিককে চালানোর জন্য কত কত ম্যানেজার দরকার, পোশাকের অর্ডার পাওয়ার জন্য কত কত জায়গায় দেনদরবার করতে হয়, সেই জামার কাপড় বিশ্বের কত কত জায়গা থেকে কিনে আনতে হয়, আর অন্যান্য দেশের পোশাকশিল্পের সঙ্গে লড়াই করে কাজ ছিনিয়ে আনতে কত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।
তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতি আমাদের মেধাবী তরুণ-তরুণীদের এই অনাগ্রহের ফলাফল সহজে অনুমেয়। মিডল ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের পদ তাই চলে যাচ্ছে বিদেশিদের কাছে। সিপিডির হিসাবে প্রায় ১৬ শতাংশ কারখানায় বিদেশি কর্মীরা কাজ করেন। এঁদের ৭০ শতাংশই এসেছেন ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও চীন থেকে। প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রায় তাঁরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স এ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। মেধাবী তরুণদের পান না বলে শিল্পমালিকেরা তাঁদের ম্যানেজার বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যাপারটা যে এখানে শেষ হবে তা নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে পোশাকশিল্পের চেহারা কিন্তু বদলে যাচ্ছে। অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশনের কারণে কায়িক শ্রমনির্ভর শিল্প কিন্তু ক্রমাগত ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে যাবে। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া দ্বিতীয় ঢাকা ফ্যাশনলজি সামিটে জানানো হয়েছে, এই রূপান্তরের শিকার হবে অনেক পদ। যেমন নিট ও সুইং মেশিন অপারেটর, প্রোডাকশন ম্যানেজার কিংবা কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার। অন্যদিকে এই খাতে নতুন যে দক্ষতার দরকার হবে, তার সিংহভাগজুড়ে থাকবে ডিজিটাল সাক্ষরতা, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার চালানোর যোগ্যতা, রোবটিকস কন্ট্রোল, ইআরপির দক্ষতা, ডিজিটাল ডিজাইন ও উৎপাদন-দক্ষতা এবং সর্বোপরি বস্ত্র প্রকৌশল। তার মানে এখনকার চেয়ে আরও বেশি মেধাবীদের দরকার হবে আগামী দিনগুলোতে তৈরি পোশাকশিল্পে।
শুধু কর্মে নয়। ওই ফ্যাশনলজি সামিটে গিয়ে দেখেছি আমাদের দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের আধুনিকায়ন ও ডিজিটালাইজেশন নিয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা সবাই আমাদের সীমানার বাইরের লোক। দেখলাম একটি আমেরিকান স্টার্টআপ কোম্পানি আমাদের পোশাকশিল্পের মেয়েদের ডিজিটালি দক্ষ করে গড়ে তোলার পাইলট কর্মসূচি পালন করছে। না, সেখানেও আমি আমাদের তরুণদের দেখিনি। যাঁদের দেখেছি, তাঁরা সংখ্যায় খুবই অল্প।
আমাদের উদ্ভাবনী তরুণদের বড় অংশই হয়তো অন্য কোথাও তাদের শ্রম, মেধা দিচ্ছে। এ কারণে আশ্চর্য হলেও সত্য যে আমাদের কোনো সফটওয়্যার এখনো সব তৈরি পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত হয় না। যেসব প্রতিষ্ঠান অটোমেশন করেছে, তাদের অধিকাংশই বিদেশি সফটওয়্যারনির্ভর। টিকে থাকার লড়াইয়ে আমাদের কারখানাগুলোকেও কিন্তু কারখানা ৪.০ বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী হতে হবে।
প্রোডাকশন লাইনগুলোতে আমাদের তরুণ উদ্ভাবকদের আগ্রহ দেখাতে হবে। কেমন করে আমাদের কারখানাগুলো তাদের দক্ষতা বাড়াবে, কেমন করে সার্কুলারিটি বাড়ানো যাবে, কীভাবে আমরা নিজেদের তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ড পরিচিত করতে পারব বিশ্বে। এসবই সম্ভব হবে যদি আমাদের মেধাবী ও উদ্ভাবনী তরুণেরা তৈরি পোশাকশিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে না থাকেন। আর তৈরি পোশাকশিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবা দরকার, কীভাবে তঁাদের আগ্রহী করে তোলা যায় এই শিল্পের ব্যাপারে। তা কর্মে হোক বা উদ্ভাবনে।
নতুবা এই কর্মযজ্ঞ বা উদ্ভাবন তবে কে করিবে?
[১০ জুন ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত]